বাংলাভাষীদের দৈনন্দিন কথাবার্তায় ইংরেজি মরফিম (e)d-এর জায়গা নেয়ার বিষয়টি নতুন নয়। “আপনি কি ম্যারেড?”, “আমি খুব এক্সাইটেড”, “উনি খুব ট্যালেন্টেড”—এমন বাক্য আমরা অহরহই বলে থাকি।

গল্প উপন্যাসেও দেখা যায় এমন পদের ব্যবহার, উদাহরণ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘কুবেরের বিষয় আশয়ে’, পাই, “কিন্তু আমি তখন কনফার্মড বেকার।” সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোট গল্প ‘রাতপাখি’তে (মুহূর্তকথা) পাওয়া যাবে, “ফ্লাইট ক্যানসেলড হয়ে গেল” ইত্যাদি। সংবাদপত্রেও বিরল নয় তেমন পদ, আনন্দবাজারে পাই, “ফেসবুকে রীতিমত ট্রোলড হতে হয়েছে তাঁকে” (২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭) এবং “কনফার্মড ট্রেনের টিকিট বাতিল করতে আর ঝক্কি সামলাতে হবে না যাত্রীদের” (২৭ মার্চ, ২০১৬) ইত্যাদি।

বিশেষ্য, ক্রিয়াপদ এবং এমনকি বিশেষণ পদের ঋণের বিষয়টি তত উৎসাহব্যঞ্জক নয়, কারণ তা সচরাচরই ঘটে থাকে। কিন্তু প্রত্যয় পর্যায়ের ঋণ একটি বিশেষ ঘটনা বটে, বিরল না হলেও সহজে তা ঘটে না, এবং এই ঋণের পেছনে এক বা একাধিক কারণের সহযোগ থাকে।

এই আলোচনায় সে(সকল) সহযোগী নিয়ামকগুলো আবিষ্কারের প্রয়াস নিয়েছি। প্রয়াসের প্রথমেই বলে নিতে চাই, উপরোক্ত উদাহরণগুলো ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বাংলায় এসে থাকলেও একটা অভিন্ন সূত্রে বেঁধে দেয়া যায়। এই অভিন্ন সূত্রটি হল তারা সবাই বিশেষণ পদের ভূমিকায় আছে—তারা (e)d প্রত্যয়যোগে হয় ক্রিয়া থেকে, নয় বিশেষ্য থেকে আগত। এই সূত্রেই বাংলায় সেগুলো রপ্তানি হতে পেরেছে অবিকল, কেননা, বাংলাতেও এমনই একটি সূত্র আছে যা দিয়ে (ক্রিয়া-)বিশেষ্য থেকে বিশেষণ তৈরি হয়। নিচে ওই দুই সূত্রের তুলনা করছি।

ইংরেজি (e)d প্রত্যয়টি ক্রিয়াপদকে past participle করে, যা সাধারণত অতীতে ঘটা, তবে ঘটমান নয়, ক্রিয়াপদের সঙ্গে যুক্ত হয়। যেমন, I played, I have/had played ইত্যাদি। আবার অনেক ক্রিয়াপদে এই past participle ফর্মটি বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেমন marry থেকে married, এবং excite থেকে excited; আবার কখনো-সখনো এই ঝোঁকে বিশেষ্যের সঙ্গে (e)d প্রত্যয় যোগে বিশেষণ তৈরি হয়েছে, যেমন talented পদটি।

বাংলায় দেখব (ই)ত প্রত্যয়টি (ক্রিয়া-)বিশেষ্যের কিংবা রূপমূলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিশেষণ তৈরি করেছে। উদাহরণ যেমন, করা, কৃত; ধরা, ধৃত; বিক্রয়, বিক্রীত; ভয়, ভীত ইত্যাদি। ফলে, আমার ধারণা, আমি বিবাহিত, আমি উত্তেজিত বাক্যগুলোর পরিবর্তে আমি ম্যারেড, আমি এক্সাইটেড বাক্যগুলো সহজেই বাংলা বাক্যালাপে জায়গা পেয়ে গেছে। এবং আমি ভীত এমন পথ ধরে এসেছে আমি ট্যালেনটেড বাক্যটিও।

এ তো গেল বিধেয় বিশেষণ (predicative adjective) এর কথা। কিন্তু ক্রিয়াপদে যখন ব্যবহার হচ্ছে, তখন কী হচ্ছে তা দেখা যাক। ইংরেজি ক্রিয়াপদ to troll (someone)-এর বাংলা ঋণ (কাউকে) ট্রোল করা। এটা বাংলা ক্রিয়াপদের বিন্যাস সম্মত, আরো উদাহরণ যেমন মিস করা, ফান করা। এখানে ইংরেজি ক্রিয়াপদ troll, miss এবং বিশেষ্যপদ fun এসে বাংলার বিখ্যাত যুক্তপদী ক্রিয়ায় রূপ নিয়েছে, যেখানে প্রথম পদটি হয় বিশেষ্য দ্বিতীয় পদটি হয় ক্রিয়া। যেমন, রান্না করা, সাঁতার কাটা, ঘুষ খাওয়া, ব্যথা পাওয়া ইত্যাদি। কিন্তু এই সূত্রে ট্রোলড বা কনফার্মড হওয়া কীভাবে জায়েজ হয়? জায়েজ হয়, কারণ যুক্তপদী ক্রিয়া আরেক ভাবেও গঠিত হয় বাংলায়, যেখানে প্রথম পদটি (ক্রিয়া-)বিশেষণ, যেমন ব্যথিত হওয়া, প্রহৃত হওয়া, নিশ্চিত হওয়া, বিক্রীত হওয়া, অপমানিত হওয়া, ভীত হওয়া ও ক্লান্ত হওয়া ইত্যাদি।

এই আলোচনাতে আমরা দেখেছি এই ঋণগুলোর উৎপাদনশীল ব্যবহার আছে। যথা, কনফার্ম এবং ট্রোল করা অন্যদিকে কনফার্মড এবং ট্রোলড হওয়া। এখন আমরা দেখব, (ই)ত প্রক্রিয়াটির চাপে অতিরেকও হয়। যেমন, ইংরেজি mature কথাটা যখন he is really mature বাক্যে ব্যবহৃত হয়, তখন তা বিশেষণ। বাংলায় তা “আসলেই সে ম্যাচিউর” বললেই হয়। কিন্তু আমরা অনেকেই বলি “আসলেই সে ম্যাচিউরড।” আমরা এখানে mature কে ক্রিয়া হিসাবে ঋণ করে e(d) লাগিয়ে (ক্রিয়া-) বিশেষণ করে নিই। এটা (ই)ত যোগে বিশেষণ বানানোর ঝোঁকবশত বলেই ধারণা হয়।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, এমন (e)d বাদ দিয়ে কি ঋণ নেয়া যায় ওই সব ক্ষেত্রে? আমার প্রাথমিক ধারণা ক্রিয়াপদের ক্ষেত্রে যায় বই কি। যেমন, আনন্দবাজারের বাক্যদুটি (e)d বাদ দিয়ে বলা যেতে পারে, “ফেসবুকে রীতিমত ট্রোলের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে” এবং “কনফার্ম করা ট্রেনের টিকিট বাতিল করতে আর ঝক্কি সামলাতে হবে না যাত্রীদের।” আর বিধেয় বিশেষণের বেলায় পুরো পদটির বাংলা থাকে। সেখানে ম্যারেড, এক্সসাইটেড, টায়ার্ড, ট্যালেন্টেড সরাসরি ঋণ, একটি সাধারণ বিশেষণ পদের মতই এর ব্যবহার—এগুলো ব্যবহার করার বিকল্প পথ ইতোমধ্যেই সঙ্কীর্ণ হয়ে গেছে। অর্থাৎ ব্যবহার করলে অবিকল ব্যবহার করাই এখন চল।

কভার ফটো – গ্রেটার অস্টিনের বাঙালি এসোসিয়েশন (বাগা) আয়োজিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০১৭ উদযাপন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দিচ্ছেন আহমেদ শামীম। ছবি. সুলতান আহমেদ