কারও জন্য উদ্বেগ দেখানোর সময়, কেউ কি আপনাকে বলেছে যে আপনি বেশি সহমর্মিতা দেখান অথবা আপনি বেশি সহানুভূতিশীল হয়ে যাচ্ছেন? অনেক সময় “সহানুভূতি” আর “সহমর্মিতা” শব্দ দুটি একটা অন্যটার বদলে ব্যবহার করা হয়। যদিও এদের অর্থ কিন্তু এক না। এই শব্দ দুটি অন্য মানুষের আবেগের প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার ভিন্ন ভিন্ন ধরন বোঝায়। এটা কেবল ভাষার পার্থক্যই না, বরং আমরা যদি শব্দ দুটির অর্থগত পার্থক্য বুঝতে পারি, সেটা অন্যদের সাথে আমাদের যোগাযোগ এবং সহানুভূতি প্রকাশের ধরনও বদলে দিতে পারে।
সহমর্মিতা আর সহানুভূতি হচ্ছে অন্যদের আবেগের প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়া। তবে সহানুভূতি হল নিজের অবস্থানে থেকে কারো আবেগকে বোঝা। আর সহমর্মিতা হল অন্য ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে তার আবেগকে অনুভব করা।
ক্যাথারিন চ্যান
চলুন বিস্তারিতভাবে জানার চেষ্টা করি, কীভাবে সহানুভূতি সহমর্মিতার চেয়ে আলাদা। আমরা আরও দেখব, বাস্তব জীবনে এই দুই অনুভূতি কেমন ভাবে প্রকাশ পায়। আর এগুলির বিষয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তরও খুঁজে দেখবো।
সহানুভূতি বনাম সহমর্মিতা
যদিও দুটি শব্দই আবেগ বিষয়ক পরিস্থিতি বোঝাতে ব্যবহার করা হয়, তবে অর্থের পার্থক্য আছে বলে এগুলিকে একটা আরেকটির পরিবর্তে ব্যবহার করা ঠিক নয়।
অন্য মানুষের পরিস্থিতির প্রতি কীভাবে আমরা আবেগ প্রকাশ করি এবং সেটাকে অনুভব করি—সেখানেই হচ্ছে শব্দ দুটি ব্যবহারের মধ্যে বড় পার্থক্য।
সহানুভূতি হল কারো দুঃখ বা কষ্ট বুঝতে পেরে তার প্রতি সমবেদনা বা উদ্বেগ দেখানো।
আর সহমর্মিতার মানে হল কারো আবেগকে এমনভাবে বোঝা যেন নিজেই তাদের চিন্তা, অনুভূতি আর অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করছে।
কীভাবে পার্থক্যটা মনে রাখবেন
সহানুভূতির অর্থ মনে রাখার সহজ উপায় হল দোকানের শুভেচ্ছা কার্ড সেকশনের কথা ভাবা। কেউ খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে গেলে যখন আমাদের তার জন্য খারাপ লাগে, তখন অনেক সময় আমরা সান্ত্বনা দেয়ার জন্য “সিমপ্যাথি” বা সহানুভূতি কার্ড দিই।
অর্থাৎ, এখানে আপনি নিজেকে তার জায়গায় কল্পনা করছেন না, কিংবা ভাবছেনও না যে তার পরিস্থিতিতে থাকলে আপনার কেমন লাগত। তাই আপনার মধ্যে সহানুভূতি আসতে পারে, কিন্তু সেটা সহমর্মিতার মত গভীর নাও হতে পারে।
কম বোঝা বনাম গভীরভাবে বোঝা
যখন আমরা কারো দুঃখজনক অবস্থার প্রতি সহানুভূতি দেখাই, তখন তার জন্যে আমাদের খারাপ লাগে। তার কেমন লাগছে সেটা নিয়ে আমরা ভাবি, অনুভব করার চেষ্টা করি। কিন্তু আসলেই সে কী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেটা আমরা গভীরভাবে বুঝতে পারি না।
অন্যদিকে, কারো পরিস্থিতির প্রতি সহমর্মিতা দেখানোর মানে হল নিজের সময়, মনোযোগ আর মানসিক শক্তি দিয়ে তাদের আবেগ সম্পূর্ণভাবে বোঝার চেষ্টা করা।
নিজেদের দৃষ্টিকোণ বনাম অন্যদের দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা
সহানুভূতি হল কারো খারাপ খবর শুনলে সেটা নিয়ে নিজের অনুভূতি শেয়ার করা, “সরি” বলা।
কিন্তু সহমর্মিতার সময় আমরা তাদের আবেগের গভীরে ঢুকে যাই এবং নিজেদের সেই অবস্থায় কল্পনা করি। এটা আমাদের অনুভূতির ব্যাপার না, বরং আমরা নিজেকে তাদের জায়গায় বসিয়ে কল্পনা করি, যেন আমরা সেই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি এবং তাদের মতই অনুভব করছি।
ধরুন, আপনার বন্ধু বলছে তার পোষা কুকুরটি সম্প্রতি মারা গেছে। আপনি সহানুভূতি দেখিয়ে বলবেন, “তোমার ক্ষতির জন্য আমি দুঃখিত।”
কিন্তু আপনি যদি সহমর্মিতা দেখান, তাহলে আপনি নিজের প্রিয় পোষা প্রাণী হারানোর কথা কল্পনা করবেন। তখন যে শোক আর বেদনা আসবে, সেটা অনুভব করবেন।
মজার তথ্য: এই শব্দগুলির উৎপত্তি কোথা থেকে?
“Sympathy” আর “Empathy” শব্দদুটোর শেষে যে “-pathy” অংশ আছে, সেটা এসেছে গ্রিক শব্দ “pathos” থেকে। “Pathos” মানে হল “আবেগ, অনুভূতি বা অনুভব।”
বিচার করা নাকি বিচার না করা
সহানুভূতি হচ্ছে কারও পরিস্থিতি নিয়ে একটা ভাসা ভাসা ধারণা নেওয়া। তাই এক্ষেত্রে কাউকে বিচার করে ফেলা সহজ। অন্যদিকে, সহমর্মিতা মানুষকে অন্য কারো চিন্তা আর অনুভূতির মধ্যে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। ফলে তখন বিচার করার প্রবণতা কমে যায়।
যেমন ধরুন আপনার বোন জানাল, সে ডিভোর্স নিচ্ছে। আপনি সহানুভূতি দেখিয়ে বললেন, “কী একটা খারাপ খবর! ভাগ্নেটার জন্য তো এটা অনেক কঠিন হবে। একটা ব্রোকেন ফ্যামিলির মধ্যে ওকে বড় হতে হবে।”
অন্যদিকে একটা সহমর্মী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, “তুমি যদি এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাও, আমাকে জানিও। আমি এই পুরোটা সময় তোমার পাশে থাকব।”
অযাচিত উপদেশ নাকি মন দিয়ে শোনা
সহানুভূতি দেখানোর সময় আমরা নিজে অন্যের আবেগ অনুভব করি না। তাই যখন আমরা কারও সমস্যা শুনি, তখনই আমাদের মধ্যে তাড়াতাড়ি একটা সমাধান দেয়ার তাড়না কাজ করে। কেননা তার জন্য আমাদের মনে করুণা জাগে। আমরা নিজেদের এই আবেগ দমিয়ে রাখি। কারণ আমরা আসলে জানি না, তার মধ্যে কী চলছে। তাদের অভিজ্ঞতা বোঝার চেয়ে একটা সমাধান দিয়ে দেওয়াই আমাদের জন্য সহজ।
কিন্তু যখন আমরা কারও সাথে সহমর্মিতা দেখাই, তখন আমরা তার অভিজ্ঞতার সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত হই। আমরা তাকে বুঝতে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি, তার কথা মন দিয়ে শুনি, তাদের মুখের অভিব্যক্তি আর শরীরের ভাষা বোঝার চেষ্টা করি। আর তার প্রয়োজনের প্রতি সংবেদনশীল আচরণ করি।
কোনটি ভাল—সহানুভূতি না সহমর্মিতা?
সহানুভূতি বা সহমর্মিতার মধ্যে একটা বেশি ভাল, একটা কম ভাল, এমন বলা যাবে না। ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা আর পরিস্থিতিতে এদের আলাদা ব্যবহার আছে। তবে আসল কথা হল, মানসিক আর আবেগগত সুস্থতার জন্যে আমাদের দুটিরই দরকার।
কখন সহমর্মিতা দেখাতে হয়
অন্যদের সাথে গভীর আর অর্থবহ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহমর্মিতা খুব দরকারি। আপনি যদি আরেকজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি না বুঝতে পারেন, তাহলে তার সাথে ঠিকভাবে যোগাযোগ করা এবং সমস্যা সমাধানে এক সাথে কাজ করা অনেক চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে।
যখন কেউ চায় আপনি তাকে বুঝুন, তখন সহমর্মিতা কাজে লাগান
সঙ্গীর সাথে ঝগড়া হওয়ার পরে আপনারা যদি একে অপরের দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতি সহমর্মী না হন, তবে এই ঝগড়া মেটানো কঠিন হয়ে যাবে। যখন নিজে্রা একটা টিম হিসেবে কাজ করার বদলে নিজে কতটা সঠিক সেটা প্রমাণ করার জন্য মনোযোগী হয়ে পড়েন, তখন সম্পর্কে আরও বড় দূরত্ব তৈরি হবে।
সহমর্মিতার ক্লান্তি
তবে, যদি আপনি সব সময় অন্যদের অনুভূতির ব্যাপারে উদ্বিগ্ন থাকেন তবে আপনার সহমর্মিতাজনিত ক্লান্তি হতে পারে। এতে আপনার শক্তি কমতে থাকে। আপনার মধ্যে অসাড়তা চলে আসে, এমন কি আপনার বার্ন আউটও হতে পারে। আপনি অসহায় এবং নিজের ভেতরে আরও কম সহমর্মিতা অনুভব করতে পারেন। আর এতে আপনি সহমর্মিতাজনিত মানসিক চাপের ঝুঁকিতে পড়েন।
কখন সহানুভূতি দেখানো উচিত
মোবাইল ফোন আর সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে, যেকোনো সময়ে আমরা মানুষের কষ্টের খবরের মুখোমুখি হই। পৃথিবীতে কী ঘটছে তা নিয়ে সহজেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়া যায়।
সহানুভূতির মাধ্যমে আমরা আবেগতাড়িত না হয়েও বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারি এবং সচেতন থাকতে পারি।
সহানুভূতির সঙ্গে বিভিন্ন নৈতিক ও সামাজিক আচরণের সম্পর্ক রয়েছে যেমন সহযোগিতা, ভাগাভাগি, বৈষম্য কমানো, সহায়তা, সহানুভূতি দেখানো, আর অন্যকে সুরক্ষা দেওয়া।
সহানুভূতি আর সহমর্মিতা কি এক জিনিস?
এই দুই শব্দকে প্রায়ই একে অপরের জায়গায় ব্যবহার করা হয়। দুটিতেই অন্য কারো আবেগ বুঝে নেওয়া, গভীরভাবে সংযুক্ত হওয়া, বিচার না করে শোনা, ধৈর্য রাখা আর সম্মান দেখানোর বিষয় থাকলেও এদের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে।
সহানুভূতি দেখাতে প্রয়োজন কিছু করে দেখানো
সহমর্মিতা যেখানে কেবল অন্যের আবেগ অনুভব করার বিষয়, সেখানে সহানুভূতির মাধ্যমে অন্যকে সাহায্য করার এবং এই জন্য একটা বাস্তব পদক্ষেপ নেয়ার ইচ্ছা তৈরি হয়। আপনি যখন কারও কষ্ট ও দুর্দশা কমাতে চান, এর অর্থ আপনি তার পরিস্থিতির প্রতি সত্যিই সহমর্মী।
ধরুন আপনার বন্ধু ক্যানসারের চিকিৎসার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আপনি যখন তার বাজার-সদাই করে দেন, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান, তার প্রয়োজনের প্রতি যত্নশীল ও মনোযোগী থাকেন সেটাই হচ্ছে তার প্রতি আপনার সহানুভূতির প্রকাশ।
আরও সহানুভূতিশীল ও সহমর্মী হওয়ার উপায়
সম্পর্ক গড়ে তোলা আর মানসিক সুস্থতার জন্য সহানুভূতি ও সহমর্মিতা অনুভব করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কিছু টিপস দেওয়া হল যেগুলি চর্চা করে আপনি আরও সহানুভূতিশীল ও সহমর্মি হতে পারবেন।
শরীরী ভাষা, মুখের অভিব্যক্তি পড়তে শিখুন
শুরুতেই অদরকারী পরামর্শ দেওয়ার আগে নিজেকে তার জায়গায় কল্পনা করুন আর ভাবুন তার কী প্রয়োজন হতে পারে।
মনোযোগী ও সক্রিয় শ্রোতা হওয়ার চর্চা করুন। প্রশ্ন করুন, অন্য মানুষটির মনে কী চলছে তা বোঝার চেষ্টা করুন।
আত্ম-পর্যালোচনা করুন যে কীভাবে চারপাশের পরিবেশ, পরিস্থিতি আপনার বিশ্বাস, মূল্যবোধ, বিচারবোধ আর দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করেছে।
কারও উদ্বেগ বা কষ্টকে আবেগ দিয়ে অনুভব করুন এবং স্বীকৃতি দিন।
নিজের আবেগ সম্পর্কে জানুন এবং কীভাবে তা শনাক্ত করতে হয় তা শিখুন।
মূল কথা
সহানুভূতি আর সহমর্মিতার মধ্যে পরিষ্কার পার্থক্য আছে। যদিও এদের কোনোটাই একটা আরেকটার চেয়ে বেশি ভাল নয়। তবে পরিস্থিতি অনুযায়ী আবেগ প্রকাশের কোন মাধ্যমটি ব্যবহার করা উচিত, সেটা বোঝা জরুরি।
যদি আপনার কাছে আবেগ সামলানো বা অন্যের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করা কঠিন মনে হয়, তাহলে আপনি থেরাপির সাহায্য নিতে পারেন। এটি আপনার আবেগ বুঝতে, সম্পর্কগুলি আরও শক্তিশালী করতে, যোগাযোগ দক্ষতা উন্নত করতে এবং আবেগগত সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।
সহানুভূতি বনাম সহমর্মিতা—পার্থক্য কোথায়?