এই পাত্রটি আসলে আমি নিজেই। যদিও আমার দ্বিতীয় বিয়ে করবার আশু কোনো সম্ভাবনা আমি দেখি না, তবুও সকল বাজারেই স্বীয় স্বীয় উৎপাদন বা পরিষেবার বাজারদর দেখার যে উত্তেজনা সেই উত্তেজনা আমাকেও কাহিল করে দেয় কখনো কখনো। বিয়ের বাজার আদতেই খুব জটিল বাজার। বিয়ের সম্পর্ক সম্ভবত আরো ঘোরালো-প্যাঁচালো। ফলে বাজারদরে আমি যেমনই সাব্যস্ত হই না কেন, আরেকবার সেই রাস্তা গ্রহণের সম্ভাবনা আপাতত দৃষ্ট হয় না। কিন্তু এই টীকাটিতে প্রসঙ্গটি আসছে সঙ্গত কারণেই; ওই যে উত্তেজনা!

মধ্যবিত্ত দ্বিলিঙ্গ বিয়ের যে ব্যবস্থাপনা সেখানে দৈনিক পত্রিকার গুরুত্ব অত্যন্ত মৌলিক পর্যায়ের। অন্তত ঔপনিবেশিক কাল থেকে, দৈনিক পত্রিকার গোড়ার কাল থেকেই, এই মাধ্যমটির জোরদার ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। বাংলাভাষী মুখ্য শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা ও কোলকাতাতে আকছার লাগাতার এই বিজ্ঞাপনগুলো প্রকাশিত হয়ে আসছে। সাহিত্যবিচারে এই বিজ্ঞাপনগুলো অনবদ্য। কুড়ি থেকে চল্লিশটি শব্দের মধ্যে আকাঙ্ক্ষিত পাত্র/পাত্রীর বৈশিষ্ট্যের যে লিপিমালা আঁকা হয়ে থাকে তা দুর্দান্ত সম্পাদনা-সামর্থ্যের প্রকাশ ঘটায়। ইংরাজিতে যাকে বলে প্রিসিশন এবং কাস্টমাইজেশন, তার একটি দৃষ্টান্তমূলক দলিল এই বিজ্ঞাপনমালা। পত্রিকাগুলোও অত্যন্ত কার্যকরী ও দয়ালু মন নিয়ে অকাতরে বিজ্ঞাপনগুলো দিয়ে থাকে; এবং দিয়ে থাকে সাধারণত একটা নির্দিষ্ট পাতায় বা পাতাযুগলে। ফলে এই বাজারে নামবার জন্য আপনার প্রকৃতই রমরমা বাজারে ঢোকার সুযোগ ঘটে। এমন নয় যে, আপনি এক পাতায় দুটি পাত্র দেখে আবার আরেক পাতায় ছটি পাত্র দেখবেন, মানে পড়বেন। আপনি কলামের পর কলাম লাগাতার, অবিরাম কেবল পাত্র বা পাত্রীই পাঠ করতে থাকবেন।

খোলা পাতায় এরকম অভিপ্রকাশকেই খোলাবাজার বলে থাকতে পারে; বিয়ের বাজার আর কি। অধুনা, বাংলাদেশের মুখ্য পত্রিকাগুলো এই বিজ্ঞাপনগুলোকে সংকুচিত করে দিয়েছে। জানা যায় না যে তাতে বিয়ের সংখ্যা কমেছে কিনা। কিংবা মাত্রাতিরিক্ত বিয়ের কারণেই তারা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মতো এই বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ করেছে কিনা। তবে পশ্চিমবাংলায় তা এখনো জমজমাট আছে। এটা চিত্তাকর্ষক যে পশ্চিমবঙ্গীয় মধ্যবিত্ত দ্বিলিঙ্গ বিয়েসমূহে পাত্র বা পাত্রীর সম্ভাব্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রায়শই গুষ্টির আদিনিবাসও একটা শর্ত। যেমন, পূঃ বঃ বৈশ্য ৫ ফু ৯ ই আইটি বিদেশফেরত পাত্রের জন্য অমুক তমুক… এরকম কোনো বাণীমালা পেলে প্রিসিশনচর্চার এই মাধ্যমে আপনার ধরে নিতে হবে এই বিদেশফেরত কোনো বিদেশিনীকে বিবাহ করতে চাইছেন না; বরং তিনি আসলে পূর্ববঙ্গীয় বংশোদ্ভূত কোনো নারীকেই বিবাহোন্মুখ্। তবে এসব বিজ্ঞাপন সাধারণত পরিবারের তরফে হয়ে থাকে। ফলে প্রিসিশন বা ডিজায়ারের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব পাত্রটিকে, এই উদাহরণে, দেয়া ঠিক হবে না।

বাংলা পত্রিকার উদাহরণ দিয়েছি বলেই এটা ধরে নেয়া ঠিক হবে না যে ইংরাজি পত্রিকাগুলো বিবাহবাজারে বঞ্চিত। বরং চিত্রটা বেশ স্বতন্ত্রভাবেই বিপরীত। ইংরাজি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন আসার মানেই হলো এই যে, মধ্যবিত্ত (ও দ্বিলিঙ্গ) বিয়ের ক্ষেত্রে এখানকার বিজ্ঞাপনদাতারা, যদি বাঙালি হয়ে থাকেন, তাহলে কয়েকটি ঘোষণা ইতোমধ্যেই দিয়ে দিয়েছেন। প্রথমত, তাঁরা আরো সচ্ছল আরো শিক্ষিত আরো কসমোপলিটান পরিবার চান। দ্বিতীয়ত, হয়তো তাঁদের আন্তঃরাজ্য (ভারতের কথাই হচ্ছে) বিবাহতে অরুচি নাই। তৃতীয়ত, তাঁরা হয়তো টার্গেট বেয়াই পরিবারকে নিজেদের খান্দান ও প্রজন্মীয় অগ্রগতি সম্বন্ধে ধারণা দিচ্ছেন। চতুর্থত, পরিবারের অভ্যন্তরে কথ্য বাংলার তুলনায় যে কথ্য ইংরাজিই অধিকতর চর্চিত সেই মর্মে হবু পুত্রবধূ বা জামাতাকে আগাম প্রস্তুত করছেন। ইত্যাদি। তবে এটা ঠিকই যে, ইংরাজি বিজ্ঞাপনগুলোতে পূঃবঃ বা পঃবঃ বর্গসমূহের প্রাদুর্ভাব কম।

যাহোক, কথা হচ্ছিল উবার নিয়ে। উবার প্রসঙ্গ এখনো আসেনি। বিয়েতে উবারের গুরুত্ব আসলে আমি এর আগে ভাবিওনি কখনো। এ বিষয়ে অগ্রজ মিত্রকলিগ চলচ্চিত্র অধ্যয়নের অধ্যাপক মৈনাক বিশ্বাস আমাকে প্রথমে জ্ঞাত ও চিন্তিত করেন। আমার বর্তমান বিয়ে থেকে যে স্ত্রী আছেন তিনিও ছিলেন সেই বৈঠকে। মৈনাক জানান যে পাত্রপাত্রী বিজ্ঞাপনে তাঁর নজরে পড়েছে উবারের যাত্রী রেটিং পর্যন্ত উল্লেখকৃত হয়েছে। আমার স্ত্রী আছেন, এবং সামনেই আছেন, তাই আন্দাজ করা যায় পাত্র হিসেবে আমাকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য মৈনাক প্রসঙ্গটি তোলেননি। বরং একটা সাধারণ সামাজিক সৌজন্যময় সান্ধ্যকালীন চাচক্রের প্রসঙ্গ ছিল সেটি। বৈঠকটি ২০১৮ সালের শেষের দিয়ে হয়ে থাকতে পারে। এই সন্ধ্যার আগে আমার ঘুণাক্ষরে ধারণা ছিল না যে উবারযাত্রায় ড্রাইভারের বাইরে যাত্রীরও রেটিং বিধি আছে। আমার অজ্ঞতায় মৈনাককে বিচলিত দেখাল না; আমার স্ত্রীর ভঙ্গিতেও আমি বুঝলাম না তিনি জানতেন কিনা। অধ্যাপক আমার সেলফোনটি নিয়ে দেখাতে উদ্যত হলেন কোথায় যাত্রী হিসেবে আমি রেইটকৃত। আমার ফোনের অকুস্থলে পৌঁছে তিনি সম্ভবত বিস্মিত হলেন। কারণ দেখা গেল আমার রেটিং ৫.০০।

একটু আগেই আমরা ধাবিত হচ্ছিলাম পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনে এই অভূতপূর্ব ও দৃষ্টান্তমূলক প্যারামিটার/মানদণ্ডের সংযোজন নিয়ে। সেটা একটা গুরুতর ভাবনা করার বিষয় বটে। কিন্তু যেই না আমি ৫.০০ যাত্রী হিসেবে আবিষ্কৃত হলাম, কিছুক্ষণের জন্য ওঁরা দুজনই বুঁদ হয়ে রইলেন আমার এই অনন্য অর্জন বিষয়ে। আমার স্ত্রী একটা সম্ভাবনার কথা বললেন। আসলে দুটো। একটা হলো আমি খুব কম উবারে চড়ি বলে এটা হয়ে থাকতে পারে। আরেকটা হলো, আমি সকল ড্রাইভারের সঙ্গে লঘু গালগল্প করার চেষ্টা করি বলে এটা হয়ে থাকতে পারে। তুলনায় মৈনাক, আমাকে গুরুত্ব দিয়ে আমার অর্জনের জন্য আমাকে অভিবাদন জানালেন। আর এই অনন্যতা যে আমাকে তাঁর চোখে-পড়া ৪.৬৭ পাত্রের তুলনায় অধিকতর আকর্ষণীয় বিবাহপাত্রের মর্যাদা দেয় তাও মনে করিয়ে দিলেন। আমি আমার বিবাহযোগ্য ৫.০০ স্ট্যাটাসটির আশু কী অনুবাদ করব বুঝতে না-পেরে বসে রইলাম। এখন চুলচেরা বিচারে মনে হচ্ছে, আমি ভ্যাবদা মেরে থেকে থাকতে পারি। তখন, ওই সন্ধ্যা।

আশু বিয়ের সম্ভাবনা ছাড়াই আমি কিন্তু মনে মনে ৫.০০ দশার সেই অর্জনটিকে সৌধের মতো নিয়ে ঘুরতে রইলাম। মুখ্যত ঢাকার রাস্তায়। আমি প্রতিটা যাত্রার আগে, ও অবশ্যই পরে, আমার নতুন আবিষ্কৃত সেলফোনপর্দাস্থলে ওই নম্বরটি দেখতে থাকি। ৫.০০। জ্বলজ্বল করছে। আমি মনে মনে ভাবতে থাকি হয়তো ৫.০০ এর উপর যাওয়ার বিধান নেই বলে আমি ৫.০০ স্টার বা কিছু একটা হব। এটাও অস্বীকার করব না যে প্রতিবারই আমার গোল্ডেন ফাইভের কথা মনে পড়েছে। আমাদের কালে যেহেতু শয়ে শয়ে নম্বরে এসএসসি এইএসসির হিসেব হতো, ফলে ৫.০০ বা গোল্ডেন ৫.০০ পাওয়া স্কুল ফাইনালে সম্ভব ছিল না। সেই অপ্রাপ্তিবোধ উবারের রেটিং ঘুচিয়ে দিয়েছে বলেও মাঝেমধ্যে মনে হতো। কোনো এক অনাগত কালে আমি গোল্ডেন ৫.০০ পাব এই ভরসায় আমি উবারযাত্রার শুরুতে, ও শেষে, ওই জায়গাটায় স্পর্শ করে দেখি। দেখি, ও হাসিমুখে নতুন ড্রাইভারের সঙ্গে গালগল্প শুরু করি। সকল ড্রাইভারই যে তাঁর যাত্রীর এই প্রগলভতাতে খুশি হন তা নয়। কেউ কেউ দুই বাক্যেই পরিষ্কার বিরক্ত হন। কেউ কেউ হয়তো চালানোতে মনোযোগের কারণে আমাকে নিরস্ত করেন। কিন্তু কখনো আমার ৫.০০ হুমকির সম্মুখীন তা মনে হয়নি।

এরই মধ্যে হঠাৎ, একদিন, আমি দেখি আমি ৪.৯৭ হয়ে গেছি। আমি বসে বসে অনেক পর্যালোচনা করলাম যে কোনো ড্রাইভারের সঙ্গে কোনোদিন বচসা করেছি কিনা। মনে করতে পারলাম না। এটাও সত্য যে আমি যতবার স্মৃতিচারণে ড্রাইভারকুলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিপর্যয় মনে করতে চাইলাম, ততবারই তা এই বেদনায় শেষ হলো যে আমার ৫.০০ আর নাই। আমি ৪.৯৭ এর শ্রেষ্ঠত্বে কিছুতেই শান্তিমতো থাকতে পারছি না। আর ৫.০০-এ পুনরায় উত্তরণের রাস্তাও আর জানি না। গণিতের সাধারণ জ্ঞানে বুঝি যে ৫.০০ এর এই পতনে পুনর্বার তা অর্জন সাধারণ গড়ের সূত্রে পড়ে না। লাগাতার কারণ-অকারণ উবারে চড়লেই যে আমি আবার ৫.০০-এ উত্তীর্ণ হব তার কোনো গাণিতিক বা সামাজিক নিশ্চয়তা নেই।

কিন্তু আসলেই আমি কোনো বচসা বা অনারামদায়ক বা বিদ্বেষপূর্ণ কোনো উবারারোহণ মনে করতে পারি না। হতে পারে, কোনো গাড়িচালক আমার কথা চালাচালির আগ্রহে বিরক্ত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবনয়ন ঘটিয়েছেন আমার। হতে পারে তিনি ট্রাফিক-বিধিমালার ওই অনুচ্ছেদটি দারুণ আত্মস্থ করেছেন: “চলন্ত অবস্থায় গাড়ির চালকের সহিত কথা বলিবেন না।”

(২২ নভেম্বর ২০১৯।। রাজারহাট-গোপালপুর, কোলকাতা ১৩৬ )