টাইম ম্যানেজমেন্ট (সময় ব্যবস্থাপনা) কঠিন হতে পারে। আপনার জীবনে যা জরুরি, আর যা গুরুত্বপূর্ণ — এ দুটি বিষয় অনেক সময় আলাদা হয়ে থাকে। এই বিষয়টি আপনার স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি আমাদের কখনোই জরুরি বলে মনে হয় না। তবে শেষ পর্যন্ত আমাদের জীবন কিন্তু এসবের উপরই নির্ভর করে।
- না, আজ জিমে যাওয়া জরুরি নয়। কিন্তু এটি আপনার দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- না, আপনি আজ স্ট্রেসে (মানসিক চাপে) মারা যাবেন না। কিন্তু যদি স্ট্রেস ঠিকভাবে সামলাতে না পারেন, তাহলে ভবিষ্যতে বড় বিপদে পড়তে পারেন।
- না, বেঁচে থাকার জন্য এখনই প্রাকৃতিক ও অপ্রক্রিয়াজাত খাবার খেতে হবে এমন নয়। কিন্তু এসব খাবার ভবিষ্যতে ক্যান্সার ও নানা রোগের ঝুঁকি কমিয়ে দেবে।
তাহলে এই ব্যাপারে আমরা কি কিছু করতে পারি? সবার কাছেই দিনে ২৪ ঘণ্টা থাকে। তাহলে কীভাবে এই সময়টাকে আরও ভালভাবে কাজে লাগানো যায়?
জেমস ক্লিয়ার
আর সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন, স্বাস্থ্যকর ও সুখী জীবন যাপনের জন্য আমরা কীভাবে সময়কে ম্যানেজ করব? যাতে নিজেদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হওয়া কাজগুলি করতে পারি? আর একইসাথে জরুরি দায়িত্বগুলিকেও সামলাতে পারি?
আমি নিজেও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। আপনার মতই লড়ছি। তবে আমার অভিজ্ঞতায় এমন ৩টি টাইম ম্যানেজমেন্ট টিপস আছে, যা বাস্তব জীবনে সত্যি কাজ করে। এগুলি আপনার সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করবে ও ফলপ্রসূতা বাড়াতে সাহায্য করবে।
১. যে করেই হোক, মনোযোগ ছাড়া “হাফ ওয়ার্ক” করা বন্ধ করুন
এই ডিজিটাল যুগে পুরাপুরি মনোযোগ দিয়ে যেকোনো কাজ করা খুব কঠিন। আমাদের যা করা উচিত, তার দিকে মন দিতে পারি না, খুব সহজেই আমাদের মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়। আমরা একইসাথে মেসেজ, ইমেইল আর টু-ডু লিস্ট সামলাই। সেই একই সময় অন্য কোনো একটা কাজ শেষ করার চেষ্টা করি। ফলে একটিমাত্র কাজে পুরাপুরি মনোযোগ দেওয়া খুব বিরল হয়ে গেছে।
আমি এই সময় আর শক্তির বিভাজনকে “হাফ ওয়ার্ক” বলি।
এখানে হাফ ওয়ার্কের কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো…
- আপনি একটা রিপোর্ট লিখতে বসেছেন। কিন্তু হঠাৎ ফোন চেক করেন। কোনো কারণ ছাড়াই ফেসবুক বা টুইটার অ্যাপে ঢোকেন।
- আপনি একটা নতুন ওয়ার্কআউট রুটিন শুরু করলেন। দুদিন পর আরেকটা “নতুন” ফিটনেস প্রোগ্রাম সম্পর্কে পড়লেন। সেটাও একটু চেষ্টা করে দেখলেন। কোনোটাতেই আপনি তেমন অগ্রগতি করতে পারলেন না। তাই আপনি আবার নতুন কিছু খুঁজতে শুরু করলেন।
- আপনি ফোনে কথা বলছেন। অথচ আপনার মন চলে যাচ্ছে ইমেইল ইনবক্সের দিকে।
আপনি কোথায় বা কীভাবে হাফ ওয়ার্কের ফাঁদে পড়ছেন, সেটা যাই হোক না কেন—ফলাফল একটাই। আপনি কখনোই পুরাপুরি মনোযোগ দিয়ে কাজটা করতে পারেন না। আপনি খুব কম সময়ের জন্য কোনো কাজের প্রতি নিজেকে পুরোপুরি উৎসর্গ করেন। আর সামান্য কাজ করতে অনেকখানি সময় লেগে যায়।
হাফ ওয়ার্কের কারণেই ছুটির আগের দিন আপনি অনেক কাজ করতে পারেন। কারণ তখন আপনি পুরাপুরি মনোযোগ দিয়ে কাজ করেন। কিন্তু তার আগে পুরা সপ্তাহজুড়ে আপনি খুব কম কাজ করেন। কারণ তখন বার বার আপনার মনোযোগ নষ্ট হয়।
অধিকাংশ মানুষের মত আমিও এই সমস্যায় সবসময় ভুগি। আর এই সমস্যা কাটানোর সবচেয়ে ভাল উপায় আমি যেটা পেয়েছি, সেটা হল—একটা নির্দিষ্ট সময় শুধুমাত্র একটা কাজের জন্য রেখে দেওয়া। আর বাকি সবকিছু বাদ দেওয়া।
আমি একটা এক্সারসাইজ বেছে নিই। পুরা ওয়ার্কআউটের সময় শুধু সেটাতেই মন দিই। (যেমন: “আজ শুধু স্কোয়াট করব। অন্য কিছু হলে সেটা বাড়তি।” )
আমি কয়েক ঘণ্টা সময় বের করে নিই। কখনও পুরা একটা দিনও রাখি। সেই সময়টা আমি কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিই। তখন আমার ফোন আলাদা ঘরে রেখে দিই। ইমেইল, ফেসবুক আর টুইটার বন্ধ করে দিই।
যেকোনো রকম ডিস্ট্র্যাকশন ছাড়া এই একটা মাত্র উপায় আমার কাজে আসে। এভাবেই গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করা যায়। আর এভাবেই সেই অল্প অল্প কাজ এড়ানো যায়। ফলে হাফ ওয়ার্কও বন্ধ করা যায়।
একবার ভাবুন তো, হাফ ওয়ার্কের সময়টাকে কাজে লাগালে আপনি কত কিছু করতে পারতেন? যদি আপনি দরকারি কাজটা ঠিকমত করতেন? যেভাবে করা উচিত, সেভাবে করতেন? আর সেই হাফ ওয়ার্ক আর অকারণে মনোযোগ নষ্ট করার বিষয়গুলি বাদ দিতেন?
২. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সবার আগে করুন
দিন যত এগোয়, আমাদের বিশৃঙ্খলা আর অগোছালো ভাব তত বাড়ে। একইসাথে সারাদিনের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত আপনার মানসিক শক্তি কমিয়ে দেয়। দিনের শেষে আপনি খুব একটা ভাল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। দিনের শুরুতে আপনি যে কাজটা ভালভাবে করতে পারেন, দিনের শেষে সেটাই আর ঠিকভাবে হয় না।
আমি দেখেছি, এই একই জিনিস আমার ওয়ার্কআউটের ক্ষেত্রেও ঘটে। যত বেশি সময় ধরে ওয়ার্কআউট করতে থাকি, তত আমার মানসিক শক্তি কমতে থাকে। সেটা শেষ করা কঠিন হয়। ব্যায়ামের পুনরাবৃত্তিগুলি কঠিন লাগে। কঠিন এক্সারসাইজগুলি আরও কষ্টসাধ্য হয়ে যায়।
এই সব কারণেই, যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকে, তাহলে সেটাই সবার আগে শেষ করার চেষ্টা করি।
যদি আমার কোনো গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেল লেখার থাকে, তাহলে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই এক গ্লাস পানি খাই। তারপর সঙ্গে সঙ্গে টাইপ করা শুরু করি। যদি কোনো কঠিন এক্সারসাইজ করতে হয়, তাহলে সেটাই আমি ওয়ার্কআউটের শুরুতে করি।
যদি আপনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা সবার আগে করেন, তাহলে আপনার কখনোই এমন দিন আসবে না—যেদিন আপনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু করতে পারেননি। এমনকি যদি সব কিছু পরিকল্পনামত না-ও চলে, তবুও এই কৌশল আপনার দিনটাকে প্রোডাক্টিভ করে তুলবে। আপনি যদি প্রতিদিন সত্যিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা আগে করেন, তাহলে এই একটি প্রোডাক্টিভিটি টিপ সবকিছু বদলে দেবে।
৩. কাজের পরিসর কমান, কিন্তু শিডিউল মেনে চলুন
আমি আগে লিখেছিলাম, ডেডলাইনের চেয়ে শিডিউল মেনে চলা বেশি দরকারি। কিছু সময় ডেডলাইন দরকার হতে পারে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, দীর্ঘমেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হলে, শিডিউল মেনে চলাই সবচেয়ে কার্যকর।
তবে প্রতিদিনের ব্যস্ততার মধ্যে সময়সূচি মানা সহজ নয়। সোমবার, বুধবার আর শুক্রবার ব্যায়াম করার প্ল্যান করে এমন কারো সাথে কথা বলুন। তারা বলবে, প্রতিবার ঠিকঠাক সময়মত ব্যায়াম করা কতটা কঠিন।
এই অপ্রত্যাশিত ডিস্ট্র্যাকশনে পড়ে পরিকল্পনা থেকে সরে যাওয়ার প্রবণতা কাটাতে আমি একটু ভিন্নভাবে শিডিউলের দিকে তাকাই। আমি চেষ্টা করি কাজের পরিসরের চেয়ে শিডিউলকে অগ্রাধিকার দিতে। আমরা সাধারণত উল্টাটা করি। আমরা প্রথমে লক্ষ্য ঠিক করি, তারপর সময় খুঁজি।
ধরুন, আপনি আজ সকালে ঠিক করলেন বিকালে ৩ মাইল দৌড়াবেন। কিন্তু সারাদিন আপনার শিডিউল এলোমেলো হয়ে গেল। সময় হাতছাড়া হয়ে গেল। এখন আপনার হাতে ব্যায়াম করার জন্য মাত্র ২০ মিনিট সময় আছে।
এই অবস্থায় আপনার সামনে দুটি অপশন আছে।
প্রথমটা হল—“আজ আমার ব্যায়াম করার মত যথেষ্ট সময় নেই” বলা, ও তারপর হাতে থাকা অল্প সময়টা অন্য কোনো কাজে ব্যয় করা। আগে আমি সাধারণত এটাই করতাম।
দ্বিতীয় অপশন হল—কাজের পরিসর কমানো, কিন্তু শিডিউল ঠিকই মেনে চলা। আপনি ৩ মাইল দৌড়ানোর বদলে ১ মাইল দৌড়ান। অথবা ৫টা স্প্রিন্ট করেন। কিংবা ৩০টা জাম্পিং জ্যাকস করেন। কিন্তু যাই করেন না কেন, আপনি শিডিউলটা মেনে চলেন। ব্যায়ামটা করেনই। আমি দেখেছি, এই পদ্ধতি অনেক বেশি কার্যকর। প্রথম পদ্ধতির চেয়ে এতে আমি দীর্ঘমেয়াদে অনেক বেশি সফলতা পেয়েছি।
প্রতিদিনের বিচারে, ৫টা স্প্রিন্ট করতে খুব একটা সময় লাগে না। বিশেষ করে যখন আপনি ৩ মাইল দৌড়ানোর প্ল্যান করেছিলেন। কিন্তু প্রতিদিন শিডিউল মেনে চলার সামগ্রিক ফলাফল অনেক বড়। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, ব্যায়াম যত ছোটই হোক, আপনি জানেন—আজকের কাজ আপনি শেষ করবেন। এভাবেই ছোট ছোট লক্ষ্য ধীরে ধীরে জীবনের অভ্যাসে পরিণত হয়।
কাজের পরিসর আপনার প্রত্যাশার চেয়ে ছোট হলেও আজ কিছু একটা করুন।
যেসব টাইম ম্যানেজমেন্ট টিপস আসলেই কাজে লাগে
অ্যাপ স্টোর বা প্লে স্টোরে হাজার হাজার টাইম ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ আছে। আছে নানা রকম প্রোডাক্টিভিটি গ্যাজেটও। আপনি এত ক্যালেন্ডার, রিমাইন্ডার আর টাস্ক লিস্ট পাবেন যে বুঝতেই পারবেন না কোনটা ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলে সবচেয়ে কার্যকর আর ব্যবহারযোগ্য টাইম ম্যানেজমেন্ট টিপসগুলি আসলে খুবই সহজ।
আমি যখন স্বাস্থ্যকর ও প্রোডাক্টিভ জীবনযাপন করার চেষ্টা করি, তখন এই ৩টি টাইম ম্যানেজমেন্ট টিপসের ওপর গুরুত্ব দিই।
১. হাফ ওয়ার্ক বাদ দিয়ে একটি কাজে গভীর মনোযোগ দিন।
২. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সবার আগে করুন।
৩. সময়সূচি মেনে চলুন। ধীরে ধীরে অভ্যাস গড়ে তুলুন, তা যত ছোটই হোক না কেন।
আপনি কীভাবে নিজের সময় ম্যানেজ করছেন? আর কোন টিপসগুলিকে কাজে লাগিয়ে অফিসে, বাড়িতে বা জিমে ভাল কিছু অর্জন করতে পেরেছেন?