ভবিষ্যতে খাদ্যের যোগান ঠিক রাখার জন্যে হয়তো ভার্টিকাল ফার্মিং-এর এসব উদ্ভাবনের ওপর নির্ভর করতে হবে আমাদের।
শহরের মানুষ খাদ্যের জন্যে শহরের বাইরের অঞ্চলের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে থাকে। শহরে খাদ্যের যোগান আসে, হয় আশেপাশের গ্রাম থেকে অথবা বহু দূরের কোনো কৃষিভিত্তিক অঞ্চল থেকে।
কাশ্যপ ব্যাস
ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং
এত দূর থেকে এই বিপুল পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী আনার জন্যে খাবারের প্যাকেজিং, সংরক্ষণ এবং পরিবহনের ঝামেলা পোহাতে হয়। খাদ্যের গুণাগুণ যেন অক্ষুণ্ণ থাকে আর যেন একদম টাটকা খাবার শহরে পৌঁছানো যায়, সে কারণে ব্যয় করতে হয় প্রচুর অর্থ। এই শ্রম আর অর্থ দুইই বেঁচে যেত, যদি আমরা শহরেই খাদ্য উৎপাদন করতে পারতাম। কিন্ত যেখানে জমির দাম এত বেশি, সেখানে কি তা করা সম্ভব?
এ ধরনের সমস্যার সমাধান করতে পারে ভার্টিকাল ফার্মিং।
চাষাবাদের অসাধারণ এক পদ্ধতি হিসেবে ভার্টিকাল ফার্মিং এখনও খুব নতুন। কিন্ত ভবিষ্যতে এর বিশাল সম্ভাবনা আছে। কীভাবে?
ভার্টিকাল ফার্মিং কী?
নাম শুনতে যেমনটা মনে হচ্ছে, ভার্টিকাল ফার্মিং তেমনই। অর্থাৎ, ভবনের মতো উলম্ব কোনো কাঠামোতে চাষাবাদ করার জন্যে বিশেষ এক পদ্ধতি হলো ভার্টিকাল ফার্মিং।
এ পদ্ধতিতে বহুতল কোনো ভবনে সহজেই চাষাবাদ করা যাবে। বড় পরিসরে ভার্টিকাল ফার্মিং করার জন্যে অনেকগুলি ফ্লোর একসাথে ব্যবহার করা যেতে পারে। ফ্লোরগুলি একই বিল্ডিংয়ের হতে পারে, আবার নাও পারে।
ভার্টিকাল ফার্মিং এর জন্যে বিল্ডিং-এর ফ্লোরগুলি অনেকটা অফিস ব্লকের মত ব্যবহার করা যাবে। পরিত্যক্ত ওয়্যারহাউজ, ব্যবহৃত শিপিং কন্টেইনার, গ্রিনহাউজ অথবা বিল্ডিং-এ বড় পরিসরে চাষাবাদ করার কথা ভাবাই যায় না। অথচ এ সবই ভার্টিকাল ফার্মিং-এর জন্যে উপযোগী।
এছাড়া ছোট আকারেও ভার্টিকাল ফার্মিং সম্ভব। নিজের ঘরে বা বাগানে কম খরচে ভার্টিকাল ফার্মিং করা যায়। শহরাঞ্চলে, অর্থাৎ যেখানে ফসল ফলানোর মত খালি জমি নেই, সেখানে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ভার্টিকাল ফার্মিং।
ভার্টিকাল ফার্মিং আমাদের জন্যে দীর্ঘমেয়াদী এক সমাধান হয়ে উঠতে পারে কয়েকটা কারণে। এর একটা বড় কারণ হলো সাধারণ চাষাবাদে যে পরিমাণ পানি খরচ হয়, এ পদ্ধতির চাষাবাদে তা ৯৫% পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব।
এর কারণ হচ্ছে ব্যবহৃত পানির অধিকাংশ পুনরায় ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া এই পদ্ধতির ফার্মিংয়ে পানির বাষ্পীভবন কম হয় বলেও পানি বেঁচে যায়।
আরেকটা বড় বিষয় হচ্ছে কম জমির অধিক ব্যবহার হয় ভার্টিকাল ফার্মিং-এ। একইসাথে মাটির গুণাগুণ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। ‘ভার্টিকাল ফার্মিং ইনস্টিউট’ এর মতে, ভার্টিকাল ফার্মিং-এর জন্যে বরাদ্দ করা প্রতি বর্গ মিটার (১০.৭৬ বর্গফুট) ফ্লোর স্পেস থেকে ৫০ বর্গমিটার (৫৩৮ বর্গফুট) জমিতে সাধারণ চাষাবাদের সমপরিমাণ সবজি উৎপাদন করা সম্ভব।
ভার্টিকাল ফার্মিংয়ের আরেকটা দিক হচ্ছে, পরিবেশের জন্যে ক্ষতিকর কীটনাশক ও বালাইনাশক ছাড়াই এখানে ফসল উৎপাদন করা যায়। তাছাড়া যেহেতু এখানে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে চাষাবাদ করা হয়, তাই সারা বছরই ফসল উৎপাদন করা যায়।
এখন শহরাঞ্চলে নতুন একটা বিপর্যয়ের কথা শোনা যায়। এর নাম দেয়া হয়েছে ‘ফুড ডেজার্ট’ বা খাদ্যের মরুভূমি। এই অবস্থা তখনই সৃষ্টি হয়, যখন জনবহুল এলাকায় টাটকা ফলমূল ও শাকসবজির সংকট দেখা দেয়। এর সমাধান হতে পারে ভার্টিকাল ফার্মিং।
ভার্টিকাল ফার্মিং-এর মূল আইডিয়া হচ্ছে শহরের মানুষ যাতে তাজা খাবার খেতে পারে। যেহেতু কম জমিতে অধিক ফসল ফলানো সম্ভব, তাই শহরের ভেতরেই তাজা শাক সবজি ও ফলমূল উৎপাদন করা যায় এই পদ্ধতিতে। এতে শহরের বাসিন্দাদের জন্যে বেশি দামে দূর-দুরান্ত থেকে খাবার আমদানি করা লাগে না।
যেভাবে কাজ করে ভার্টিকাল ফার্মিং
ভার্টিকাল ফার্মিং-এর বিভিন্ন মডেল রয়েছে। কাঠের তক্তা দিয়ে একের পর এক তাক বানিয়ে সেখানে চাষাবাদ করা যায়। এছাড়া গ্রিনহাউজে বা ওয়্যারহাউজের ভেতরে করা যায় চাষাবাদ। এমনকি বহুতল ভবনের পুরোটা ভার্টিকাল ফার্মিং-এর জন্য ব্যবহার করার মডেলও নিয়ে আসছে উদ্ভাবকরা।
‘ইডেন গ্রিন টেকনলোজি’ নামের এক প্রতিষ্ঠানের মতো অনেকেই বিশেষভাবে ডিজাইন করে এমন টাওয়ার তৈরি করছে, যেখানে গাছ লাগানোর জন্যে প্ল্যান্ট কাপ বসানো হয়। এছাড়াও আরো বড় আকারের চাষাবাদের জন্যে ‘হাইড্রোপনিক সিস্টেম’ নামের এক পদ্ধতিতে ঘরের ভেতরের জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যাতে সারা বছর তা চাষাবাদের অনুকূলে থাকে।
ভার্টিকাল ফার্মিংয়ের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এখানে তাপমাত্রা, আলো এবং আর্দ্রতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকে। প্রচলিত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে গেলে যেমন খরা, অতিবৃষ্টি বা বন্যার কারণে বিশাল ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে, তেমনি ভার্টিকাল ফার্মিং-এ ঠিকমতো জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ফলন অনেক কমে যেতে পারে।
ভার্টিকাল ফার্মিং-এর আরো বেশ কয়েকটি উদাহরণ আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি তুলে ধরা হলো এই আলোচনায়।
যেভাবে ভার্টিকাল ফার্মিং শুরু করবেন বা এতে বিনিয়োগ করবেন
আপনার যদি ভার্টিকাল ফার্মিং-এ আগ্রহ থাকে বা এটি শুরু করতে চান, তাহলে আপনার হাতে বেশ কয়েকটি অপশন আছে। অবশ্য তা নির্ভর করে আপনি কতদূর আগাতে চান, তার ওপর। বাণিজ্যিকভাবে না করে কেবল নিজের প্রয়োজনে ফার্মিং করতে চাইলে সেই উপায়ও আপনার হাতে আছে।
এজন্যে সুবিধা অনুযায়ী কাস্টমাইজড ভার্টিকাল ফার্মিং সেটআপ নিজের ঘরেই বসাতে পারেন। এই লেখায় এমন কিছু মডেল নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। আর যদি বড় আকারের ভার্টিকাল ফার্মিং-এ আগ্রহী হন, সেক্ষেত্রেও অন্য কোনো ফার্মে বিনিয়োগ করতে পারেন। অথবা নিজে মূলধন যোগাড় করেও ফার্মিং শুরু করতে পারেন। শুরুতে মোটা অংকের টাকা বিনিয়োগ করা লাগলেও ভবিষ্যতে এই বিনিয়োগ বেশ লাভজনক হয়ে উঠতে পারে।
নিচের তালিকায় থাকা কিছু প্রতিষ্ঠান বড় পরিসরে আগের থেকেই প্যাকিং আর রেডি করে রাখা ভার্টিকাল ফার্মিং-এর সেটআপ সরবরাহ করে। প্রয়োজন অনুসারে দ্রুতই সেসব ফার্ম থেকে ফসল উৎপাদন করা যায়। প্রচলিত পদ্ধতিতে চাষাবাদের বিভিন্ন কৌশলের সাথে মিলিয়েও এসব ফার্মে ফসল উৎপাদন করা যায়।
ভার্টিকাল ফার্মিংয়ের কয়েকটি উদাহরণ
এখন পর্যন্ত আমরা এই প্রযুক্তির প্রাথমিক বিষয় বা বেসিক নিয়ে জেনেছি। এখন আমরা ভার্টিকাল ফার্মিং-এর কয়েকটি কৌশল সম্বন্ধে জানবো। এখনও প্রতিনিয়ত নতুন সব কৌশল আর পদ্ধতির উদ্ভাবন হচ্ছে, যার সবগুলি নিয়ে এখানে আলোচনা করা হয়নি। কোনো ধরনের ক্রমের ভিত্তিতেও এই তালিকা সাজানো হয়নি।
১. হাইড্রোপনিকস: মাটি ছাড়া চাষাবাদ
হাইড্রোপনিক আসলে চাষাবাদের বেশ পরিচিত একটা পদ্ধতি। বর্তমানে অধিকাংশ ভার্টিকাল ফার্মে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে এবং সময়ের সাথে সাথে এই পদ্ধতি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই পদ্ধতিতে গাছপালা মাটিতে না ফলিয়ে পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ পানিতে ফলানো হয়। এজন্যে গাছের শেকড় পুষ্টিগুণ মিশ্রিত পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয় এবং সেই পুষ্টি ব্যবহার করে গাছ বড় হয়ে ওঠে। হাইড্রোপনিকস এর মাধ্যমে আবাদ করতে হলে প্রতিনিয়তই গাছের অবস্থার ওপর নজর রাখতে হয়।
২. অ্যারোপনিকস: মাটি ছাড়া অল্প পানি ব্যবহার করে চাষাবাদ
ভার্টিকাল ফার্মিং-এর অন্যতম আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে অ্যারোপনিকস। ১৯৯০ এর দশকে নাসা সর্বপ্রথম গাছপালা বড় করার জন্যে মহাকাশে এই পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। এখানে গাছের জন্যে কুয়াশা বা জলীয় বাষ্পপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। গাছের বীজ বপণ করা হয় ফোমভর্তি পটের মধ্যে, সেখানেই গাছ বেড়ে ওঠে। গাছের জন্যে প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা থাকে। আর পুষ্টিসমৃদ্ধ কুয়াশা থেকে গাছ তার প্রয়োজনীয় পানি ও খনিজ পদার্থ সংগ্রহ করে। পটের ভেতরে থাকা ফোমের সাপোর্টে গাছের শেকড় ও কাণ্ড বড় হয়।
ভার্টিকাল ফার্মিং-এর জন্যে সবচেয়ে উপযোগী পদ্ধতিগুলির একটি হচ্ছে অ্যারোপনিকস। কেননা এতে সাধারণ চাষাবাদের চেয়ে ৯০% কম পানির প্রয়োজন হয়। এমনকি হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের চেয়েও এতে কম পানি লাগে। আর যেহেতু পুষ্টি উপাদান কুয়াশার মধ্যে মিশ্রিত থাকে, তাই এটা বার বার ব্যবহার করা যায়। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এই পদ্ধতিতে গাছপালা বেশি পরিমাণে ভিটামিন এবং মিনারেল সংগ্রহ করতে পারে। তাই কম সময়ে গাছপালা পুষ্টিগুণে বেড়ে ওঠে। আর পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন পাওয়ার ফলে গাছপালা সতেজ আর সবল হয়।
৩. অ্যাকুয়াপনিকস: একই সাথে মাছ ও ফসল চাষ
ভার্টিকাল ফার্মিং-এর এই পদ্ধতিতে ঘরের ভেতরে থাকা পানিতে একই সাথে মাছ এবং ফসলের চাষ করা হয়। মাছের বিষ্ঠা থেকে পুষ্টি উপাদান নিয়ে গাছ এখানে বেড়ে ওঠে। অন্যদিকে মাছের পানিতে থাকা বর্জ্য এসব ফার্মের গাছ ব্যবহার করার ফলে পানিও পরিশোধিত হয়ে যায়। ফলে পরিশোধিত সেসব পানি বার বার ব্যবহার করা যায়। এতে পানির খরচ কমে যায়। মাছ ও গাছ ছাড়াও এই সিস্টেমে অণুজীবেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যাদের কাজ হলো মাছের বর্জ্যকে গাছের উপযোগী পুষ্টি উপাদানে রূপান্তরিত করা।
৪. লোকাল: যেখানে রান্না, সেখানেই ফসল উৎপাদন
বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান আইকিয়া’র (IKEA) সহযোগিতায় তাদের ‘স্পেস টেন ইনোভেশন ল্যাব’-এ উদ্ভাবিত একটি পদ্ধতির নাম হচ্ছে ‘লোকাল’। এখানে হাইড্রোপনিকস পদ্ধতিতে গাছপালা বড় করা হয়। আর কৃত্রিম আলো হিসেবে ব্যবহার করা হয় এলইডি লাইট। একে পপ-আপ ফার্মিং সিস্টেমও বলা হয়। খুব অল্প পরিসরে এখানে চাষাবাদ করা হয়।
এই পদ্ধতির পরিকল্পনাকারীদের মতে, মাটিতে চাষাবাদ করার চেয়ে লোকাল ফার্মিং-এর মাধ্যমে গাছপালা বড় হতে ৩ গুণ কম সময় লাগে। তাদের তৈরি ডেমো বা প্রদর্শনীর জন্যে বানানো একটি মডেলে ফার্মের সামনে স্থাপিত একটা ‘সালাদ বার’ দেখা যায়, যাতে গাছ থেকে শাকসবজি নিয়েই সাথে সাথে সালাদ পরিবেশন করা যায়। ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), মেশিন লার্নিং এবং সেন্সর ব্যবহার করে এই সিস্টেমকে আরো আধুনিক করা হবে বলে আশা করা যায়, যেটিকে গুগল হোম-এর মতো ডিভাইসের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
৫. অ্যারোফার্মস: ভার্টিকাল ফার্মিংয়ের স্মার্ট টেকনিক
২০০৪ সালে ‘অ্যারোফার্মস’ নামে একটি কোম্পানি তাদের প্রডাক্ট বাজারে আনার মধ্য দিয়ে ভার্টিকাল ফার্মিং-এর জগতে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। মূলত অ্যারোপনিক পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন এনে গড়ে তোলা এই পদ্ধতিতে সংযুক্ত করা হয়েছে জেনেটিকস, ফুড সেফটি, পুষ্টিবিজ্ঞান এবং ইঞ্জিনিয়ারিং।
‘অ্যারোফার্মস’-এর ভাষ্যমতে, “আমাদের বাণিজ্যিক ফার্মগুলি সারা বছরজুড়ে উৎপাদন করে যেতে পারবে, এর জন্যে আবহাওয়া বা ঋতু কোনো বিষয় না। আমরা এখন পর্যন্ত ৫৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ নিয়ে কাজ করেছি, যার মধ্যে আছে সবুজ শাকসবজি, বিভিন্ন রকম বেরি ফল, টমেটো ইত্যাদি।”
ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে বিপ্লব আনার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হলো স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন তাজা শাকসবজি, ফলমূল যাতে স্থানীয়রা খেতে পারে আর তা যেন একইসাথে খেতে সুস্বাদু, পুষ্টিসম্পন্ন আর নিরাপদ হয়। চাষাবাদের কাজটা যাতে পরিবেশবান্ধব হয়ে ওঠে, সেটাও তাদের লক্ষ্য।
৬. প্ল্যান্টস্কেইপার: বিল্ডিং-এর মধ্যেই বাসিন্দাদের জন্যে ফসল ফলানোর ব্যবস্থা
‘প্ল্যান্টাগন’ নামের একটি সুইডিশ ফুড টেক কোম্পানি এমন উদ্ভাবনী আইডিয়া নিয়ে এসেছে যে, একই বিল্ডিংয়ে বসবাসকারীদের জন্যে অফিস স্পেস থাকবে আর সেখানেই চাষাবাদ করা যাবে।
মূলত এই প্রজেক্টে ‘অকে অলসন’ নামের এক উদ্ভাবকের ভার্টিকাল গ্রিনহাউজ-এর ধারণারই বাস্তবায়ন করেছে তারা। ২০০৮ সালে অলসনের কাছ থেকে তার এই উদ্ভাবনের কপিরাইট কিনে নিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।
এই ব্যবস্থায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফসল ফলানোর বক্সগুলি বিল্ডিংয়ের ওপরের তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে কৃত্রিম আলোর কোনো প্রয়োজন হয় না। এই সিস্টেম যেকোনো বিল্ডিং-এ স্থাপন করা যায় অথবা নতুন কোনো বিল্ডিংকে এর উপযোগী করে তৈরি করা যায়।
কোম্পানিটি সুইডেনের ‘লিংকোপিং’ নামক স্থানে একটি বিল্ডিং-এ তাদের প্রজেক্ট প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছিল। তারা আশাবাদী যে, সেই বিল্ডিংয়ে উৎপাদিত খাদ্য দিয়ে ৫,০০০ মানুষের চাহিদা মেটানো যাবে। এ পদ্ধতিতে সূর্যের আলো, তাপমাত্রা, বাতাসের গুণাগুণ এবং ফসলের জন্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টির মতো সবকিছুই স্বয়ংক্রিয়ভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ফলে খরচও অনেক সাশ্রয় হয়। এই প্রযুক্তির সফল বাস্তবায়ন হলে তা সিঙ্গাপুর, হংকং এবং যুক্তরাষ্ট্রের মত প্রযুক্তিনির্ভর দেশগুলিতে জনপ্রিয়তা পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
৭. ভার্টিক্রপ: শহর অঞ্চলের জন্যে পরিবেশবান্ধব চাষাবাদ
২০০৯ সালে টাইম ম্যাগাজিন ভার্টিক্রপ মেথডকে সে সময়ের পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবনের স্বীকৃতি দিয়েছিল।
জনবহুল এলাকাতে চাষাবাদ করার এই পদ্ধতি প্রচলিত চাষাবাদের চেয়ে ২০ গুণ বেশি ফসল উৎপাদন করতে পারে, কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতিতে চাষাবাদের তুলনায় এতে মাত্র ৮% পানির প্রয়োজন পড়ে।
ভার্টিক্রপ পদ্ধতিতে কনভেয়ার সিস্টেমে ট্রে-এর মধ্যে ফসল ফলানো হয়। এর আরেকটা উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে গাছের জন্যে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম, দুই ধরনের আলোর ব্যবস্থা রাখা হয়। এতে ফসলের জন্যে নিয়ন্ত্রিত এবং ‘ক্লোজড-লুপ’ পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়, যাতে দ্রুততম সময়ে ফসল উৎপাদন করা যায়। তাছাড়া এই সিস্টেমে কোনো প্রকার কীটনাশক বা বালাইনাশক ব্যবহার করা হয় না। ফলে উৎপাদিত শাকসবজির গুণাগুণ ও স্বাদ অটুট থাকে।
৮. মডিউলার ফার্মস: যেকোনো জায়গায় ফসল ফলানোর পদ্ধতি
‘মডিউলার ফার্মস’ নামের একটি কোম্পানি এই পদ্ধতি নিয়ে কাজ করেছে। ইনডোর এই সিস্টেম-এর সাহায্যে যেকোনো আবহাওয়ায়, যেকোনো জায়গায় তাজা শাকসবজি চাষাবাদ করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, এই পদ্ধতিতে এমন সব কাস্টমাইজেশন সম্ভব, যাতে চাষাবাদ সংক্রান্ত অনেক ধরনের কাজে এটি ব্যবহার করা যায়। এতে অল্প সময়েই চাষ করার জন্যে ফসলের সংখ্যা আর ফলনের পরিমাণ বাড়ানো যায়।
এই পদ্ধতিতে চাষের জন্যে ব্যবহার করা হয় স্টিলের কন্টেইনার। তবে জাহাজে ব্যবহার করা কন্টেইনার রিসাইকেল করে ব্যবহার করা হয় না। বরং বিশেষভাবে এসব কন্টেইনার বানানো হয়, যেটা ফার্ম, প্রত্যন্ত কোনো এলাকা বা ঘনবসতি পূর্ণ শহরাঞ্চলের মতো যেকোনো জায়গায় স্থাপন করা যায়। প্রত্যেকটা কন্টেইনারে সব ধরনের সুবিধা থাকে। আলোর ব্যবস্থা, পানির ব্যবস্থা, পানি শোধনাগার, আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে গাছপালা সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্যে যা যা দরকার, তার সব ব্যবস্থা থাকে কন্টেইনারের ভেতরে। এর জন্যে শুধু পানি আর বিদ্যুতের সংযোগের দরকার হয়।
৯. কিউবিক ফার্মিং সিস্টেমস: পরিবেশবান্ধব ফার্মিংয়ের নতুন ভবিষ্যৎ
ভার্টিকাল ফার্মিং-এর ক্ষেত্রে অসাধারণ আরেকটা উদ্ভাবন হচ্ছে ‘কিউবিকফার্মস’। এই পদ্ধতি সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়। অন্য কিছু পদ্ধতির মতো এখানেও বিশেষ ট্রে-এর মধ্যে উদ্ভিদ রাখা হয়, যেগুলি ভি আকারের গতিপথে চলাচল করতে পারে। এর মাধ্যমে মূলত নিয়ন্ত্রিতভাবে গাছের জন্যে প্রয়োজনীয় আলোর ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিতে হাইড্রোপনিকস প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। স্টিল কন্টেইনারের ভেতরে তৈরি এই সিস্টেমে আরো থাকে পানি, আলো, পুষ্টি উপাদান এবং ভেতরের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। প্রত্যেকটা কাঠামো ব্যবহারকারীর চাহিদা অনুসারে তৈরি করা হয় আর সম্পূর্ণ কার্যকর অবস্থায় যেকোনো জায়গায় নিয়ে গিয়ে স্থাপন করা যায়।
১০. জিপগ্রো: আধুনিক কৃষকদের জন্যে ভার্টিকাল ফার্মিং পদ্ধতি
ভার্টিকাল ফার্মিং জগতে আরো একটা নতুন উদ্ভাবন নিয়ে এসেছে জিপগ্রো নামের একটি প্রতিষ্ঠান। গ্রিনহাউজ নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পরে তারা হাইড্রোপনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভার্টিকাল ফার্মিং-এর এই পদ্ধতি তৈরি করেছে, যার সাহায্যে কম খরচে অনেক ফসল উৎপাদন করা যায়।
ব্যক্তিগত বা বাণিজ্যিক, উভয় পর্যায়েই জিপগ্রো পদ্ধতিতে সারা বছর চাষাবাদ করা সম্ভব। এমনকি যারা শখের বশে ভার্টিকাল ফার্ম করতে চান, তাদের জন্যেও এই পদ্ধতি উপযোগী। এতে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করা হয় আর পানি এমনভাবে রিসাইকেল করে ব্যবহার করা হয় যে, প্রচলিত চাষাবাদের চেয়ে ৯০%-৯৫% কম পানির প্রয়োজন পড়ে।
১১. বাওয়ারি: সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে প্রযুক্তিনির্ভর বাণিজ্যিক ইনডোর ফার্ম
‘বাওয়ারি’ নামের এই প্রতিষ্ঠান দাবি করছে, প্রচলিত চাষাবাদের তুলনায় একই পরিমাণ জমিতে ১০০ গুণ পর্যন্ত বেশি ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম তাদের এই চাষাবাদের পদ্ধতি। ফসলের জন্যে সঠিক পরিমাণ পুষ্টি, আলো, অক্সিজেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের জন্যে তারা এলইডি আলো এবং নিয়ন্ত্রিত শীতাতপ ব্যবস্থা ব্যবহার করে থাকে। এতে ক্লোজড-লুপ সিস্টেম ব্যবহৃত হওয়ায় যেমন বিশুদ্ধ পানির সাহায্যে গাছে অক্সিজেন-এর সরবরাহ ঠিক থাকে, তেমনি পানিও কম খরচ হয়।
১২. স্কাইফার্ম: বায়ু চালিত ভার্টিকাল ফার্মিং টাওয়ার
লন্ডনের ‘রজার্স স্টার্ক হার্বার প্লাস’ নামের আর্কিটেকচার ফার্ম ভার্টিকাল ফার্মিং-এর এক যুগান্তকারী ধারণা নিয়ে এসেছে। এর নাম দেয়া হয়েছে ‘স্কাইফার্ম’। অধিবৃত্ত আকারের এই টাওয়ারে ফার্মিং-এর বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতির সংমিশ্রণ করা হয়েছে। এতে যেমন মাটিতে চাষাবাদের ব্যবস্থা আছে, আবার অ্যাকুয়াপনিক বা পানিতে চাষাবাদের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। যেসব এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ আর যেসব জায়গায় আবাদি জমির সংকট রয়েছে, সেখানে প্রতিষ্ঠানটি এই প্রযুক্তি কাজে লাগাতে চাচ্ছে।
বহুতল এই কাঠামোর কিছু অংশ বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হবে। বৃত্তাকার ফ্রেমের কাঠামো এমনভাবে তৈরি করা হবে, যাতে খুব সহজে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে। এখানে একইসাথে ফসল এবং মাছ চাষ করা যাবে। মাছের পানিতে থাকা পুষ্টি উপাদান যেমন ফসলে ব্যবহার করা হবে, অন্যদিকে মাছের বসবাসের পানির জন্যে ফিল্টার বা পরিশোধনের কাজ করবে গাছপালা।
টাওয়ারের একদম নিচে থাকবে মার্কেট এবং রেস্টুরেন্ট। এর মাধ্যমে মানুষ ভার্টিকাল ফার্মিং-এর সাথে পরিচিত হবে। একইসাথে ক্রেতারা এখান থেকে উৎপাদিত ফসল বা মাছ কিনতে পারবে। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এর ওপরের অংশে স্বচ্ছ পানির ট্যাংকে বাস (Bass), তেলাপিয়া এবং বারামুন্ডির মত মাছ চাষ করা হবে। আর তার ওপরে হাইড্রোপনিক উপায়ে ফসল ফলানো হবে।
হাইড্রোপনিক সিস্টেমের ওপরে থাকবে অ্যারোপনিক সেটআপ। এখানে চাষাবাদের জন্যে কোনো মাটি ব্যবহার করা হবে না। পানির তৈরি কুয়াশা থেকে গাছপালা তাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগ্রহ করবে। আর সবচেয়ে ওপরে থাকবে বায়ুকল এবং পানির ট্যাংক, যেগুলির মাধ্যমে পুরো সিস্টেমের জন্যে প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন করা হবে।
কীভাবে একটা ফার্ম সারা বছর ধরে শহরের মানুষদের শাকসবজি, ফলমূল ও মাছের চাহিদা পূরণ করতে পারে, তার একটি আদর্শ উদাহরণ হলো স্বয়ংসম্পূর্ণ এই ফার্ম।
১৩. স্কাই গ্রিনস: পৃথিবীর প্রথম হাইড্রলিক পদ্ধতিতে চালিত ভার্টিকাল ফার্ম
সিঙ্গাপুর ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘স্কাই গ্রিনস’ যুগান্তকারী এক ভার্টিকাল ফার্মের ধারণা নিয়ে কাজ করছে। তারাই সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম হাইড্রলিক পদ্ধতিতে চালিত ভার্টিকাল ফার্ম তৈরি করেছে। এই পদ্ধতিতে গড়ে তোলা ফার্মে অপেক্ষাকৃত কম কার্বন নির্গত হয়। এখানে শাকসবজি ফলানো হয় প্রবাহিত এক ধরনের নালায়, যা ইংরেজি অক্ষর A আকৃতির একটি ঘুর্ণায়মান অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেমের মধ্যে থাকে। সারাক্ষণই এই কাঠামো ঘুরতে থাকে।
এই ফ্রেমগুলি ৩০ ফুট বা ৯ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে, যেখানে ৩৮টি পর্যন্ত নালা থাকতে পারে। প্রত্যেকটি নালার মধ্যে আলাদা আলাদা ফসল চাষাবাদ করা যায়। আর মাধ্যম হিসেবে মাটি অথবা হাইড্রোপনিক, যে কোনোটি ব্যবহার করা যায়।
সবচেয়ে নিচে থাকা গাছগুলিকে পানি দেয়া হয়, আর সবচেয়ে উঁচুতে থাকা গাছ সূর্যের আলো পায়। এভাবে সারাদিনে পালাক্রমে গাছগুলি জায়গা বদল করতে থাকে, যাতে সব গাছে সমানভাবে সূর্যের আলো ও পানি পৌঁছাতে পারে। গবেষকদের মতে, চাষাবাদের প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় এই ব্যবস্থায় পানি, মাটি এবং জ্বালানী শক্তি কম প্রয়োজন হয়।
এছাড়াও ‘স্কাই আরবান ভার্টিকাল ফার্মিং সিস্টেম’ নামের একটি পদ্ধতিতে প্রচলিত চাষাবাদের চেয়ে ১০ গুণ বেশি ফসল পাওয়া যেতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত তারা শুধু এশিয়ার বিভিন্ন শাকসবজি চাষ করছে, তবে সকল ধরনের ফল এবং শাকসবজি এই প্রযুক্তি দিয়ে উৎপাদন করা যাবে বলে তারা দাবি করে।
ভার্টিকাল ফার্মিং নিয়ে যাদের আগ্রহ, তাদের জন্যে আজ এতটুকুই।
শহরের জনসংখ্যা যত বাড়ছে, ততই তাজা খাবারের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। আর এই সমস্যার সমাধান করতে পারে ভার্টিকাল ফার্মিং। এখন সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে শুরু করে সুন্দর আবাসিক এলাকা, সবখানেই ভার্টিকাল ফার্মিং-এর ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। হয়তো এটাই হবে কৃষির নতুন ভবিষ্যৎ।
২/৫/২০২১
অনুবাদ: আমিন আল রাজী