কম্পিউটার, সেলফোন ও ইন্টারনেট নির্ভর ২১ শতকের ডিজিটাল পৃথিবীকে সম্ভব করে তোলার পিছনে প্রকৃতির কোন উপাদানটির ভূমিকা সবচেয়ে বেশি?

উত্তর খুবই সহজ, বালু বা বালি। বালি থেকে প্রাপ্ত কোয়ার্টজ কণা বা বিশুদ্ধতম সিলিকা কণার সাহায্যে তৈরি মাইক্রো চিপগুলিই কাজ করে আমাদের ল্যাপটপ, সেলফোন, ট্যাবসহ অন্যান্য অপরিহার্য প্রযুক্তির মস্তিষ্ক হিসেবে। আর এই বিশুদ্ধতম সিলিকণ কণার সবচেয়ে বড় সরবহরাহকারী অঞ্চল হল উত্তর ক্যারোলাইনার একটি ছোট্ট অনুন্নত শহর ‘স্প্রুস পাইন’।

অয়ার্ড ডটকমে প্রকাশিত ভাইনস বেইজার-এর একটি প্রবন্ধে উঠে আসে পৃথিবীর বৃহত্তম সিলিকন সরবরাহকারী এই শহরের অনেক অজানা তথ্য। স্প্রুস পাইন শহর হিসেবে ছোট হতে পারে, কিন্তু এই ছোট্ট শহর থেকে আহরিত সম্পদের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে ২১শতকের হাই-টেকনোলজির কেন্দ্রভূমি হিসেবে পরিচিত ‘সিলিকন ভ্যালি’ অঞ্চলটি।   

স্প্রুস পাইন শহর হিসেবে ছোট হতে পারে, কিন্তু এই ছোট্ট শহর থেকে আহরিত সম্পদের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে ২১শতকের হাই-টেকনোলজির কেন্দ্রভূমি হিসেবে পরিচিত ‘সিলিকন ভ্যালি’ অঞ্চলটি।

আমেরিকার উত্তর ক্যারোলাইনা’র ছোট্ট একটি শহর স্প্রুস পাইন। শহরটি দেশের অন্যান্য শহরের তুলনায় অনুন্নত। কিন্তু স্প্রুস পাইনকে ঘিরে যে পাহাড়গুলি রয়েছে সেগুলি মহামূল্যবান ও আকর্ষণীয় শিলায় পরিপূর্ণ। এরমধ্যে কিছু শিলা শিল্প কারখানায় এদের ব্যবহারের কারণে মূল্যবান। কিছু মূল্যবান শুধুমাত্র বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের জন্যে। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান হল কোয়ার্টজ। স্প্রুস পাইন হল বিশ্বের সবচেয়ে বিশুদ্ধ কোয়ার্টজের উৎস।

কোয়ার্টজ হল সিলিকন ডাইওক্সাইড কণার অপর নাম। আরো সহজ করে বললে, এগুলি হলো এক ধরণের বালুকণা। কম্পিউটার চিপ তৈরিতে যে সিলিকন ব্যবহার করা হয় তার প্রধান উৎস হল এই কোয়ার্টজ। সমূহ সম্ভাবনা আছে যে আপনার ল্যাপটপ বা সেল ফোনে যে চিপ রয়েছে তা তৈরি করা হয়েছে স্প্রুস পাইনের নদী তীরবর্তী কোয়ার্টজ কণা ব্যবহার করে।

সমূহ সম্ভাবনা আছে যে আপনার ল্যাপটপ বা সেল ফোনে যে চিপ রয়েছে তা তৈরি করা হয়েছে স্প্রুস পাইনের নদী তীরবর্তী কোয়ার্টজ কণা ব্যবহার করে।

২১ শতকে সিলিকনের গুরুত্ব অন্যান্য শতকের তুলনায় বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ডিজিটাল যুগে আমরা যেখানে কাজ করি, যে বিনোদন গ্রহণ করি, যেভাবে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করি তার সবই সম্ভব হয়েছে ইন্টারনেট, কম্পিউটার, ট্যাব, সেল ফোন ইত্যাদির মাধ্যমে। আর সিলিকন ছাড়া এসব কিছুই সম্ভব হত না।

পৃথিবীর স্থলভাগের বেশিরভাগ অংশের বালুকণাই কোয়ার্টজ দিয়ে গঠিত। এটি সিলিকা নামেও পরিচিত। কম্পিউটার চিপ, ফাইবার-অপটিক ক্যাবলসহ অন্যান্য হাই-টেক হার্ডওয়ার তৈরিতে বিশুদ্ধ সিলিকন ডাই অক্সাইড একটি অপরিহার্য উপাদান। এই পণ্যগুলি তৈরিতে যে পরিমাণ কোয়ার্টজ ব্যবহার করা হয় তার পরিমাণ খুবই অল্প। কিন্তু এই অণুমাত্র কোয়ার্টজ ব্যবহারের ফলাফল ব্যাপক।

স্প্রুস পাইন খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ হওয়ার কারণ এর অনন্য ভৌগলিক ইতিহাস। ৩৮০ মিলিয়ন বছর আগে এই অঞ্চলটি বিষুবরেখার দক্ষিণে অবস্থিত ছিল। ভূপৃষ্ঠের নিচে অবস্থিত প্লেট টেকটোনিক আফ্রিকা মহাদেশকে পূর্ব আমেরিকার দিকে ঠেলে সরিয়ে নিয়ে যায়। ফলে সমুদ্র তলবর্তী ভূত্বক সরে আসে উত্তর আমেরিকা মহাদেশের নিচের দিকটায়। এর ফলে যে তাপের সৃষ্টি হয় তা ছিল ২,০০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের চাইতেও বেশি। যার কারণে ভূপৃষ্ঠের নিচে ৯ থেকে ১৫ মাইলের মধ্যবর্তী যত শিলা ছিল তার সবই গলে যায়।

এই গলিত শিলাগুলি আশেপাশের শিলাখণ্ডগুলির ফাটলের মধ্যে প্রবেশ করে ‘পেগমাটাইটস’ নামে এক ধরনের পদার্থে পরিণত হয়। এই গলিত শিলাগুলি ঠাণ্ডা হয়ে জমাট বাঁধতে সময় লাগে প্রায় ১০০ মিলিয়ন বছর। ইতিমধ্যে আপাল্যাচান পর্বতের নিচের প্লেটগুলি উঠে আসে উপরের দিকে। ফলে পেগমাটাইটগুলি চলে আসে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের কাছাকাছি।

ন্যাটিভ আমেরিকানরা এই অঞ্চলের ‘মিকা’ নামক উজ্জ্বল খনিজকে সমাধিস্থলের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যে ব্যবহার করত। আমেরিকান উপনিবেশিকেরা এই পর্বতগুলিতে বসতি স্থাপন করে ১৮০০ সালের দিকে। কিছু খনিজ সন্ধানকারী ব্যক্তি এই খনিজ সম্পদগুলি নিয়ে ব্যবসার চেষ্টা করেন। কিন্তু যোগাযোগের ব্যবস্থা করুণ হওয়ায় তেমন সুবিধা করতে পারেননি।

সিলিকা
নর্থ ক্যারোলিনার শার্লট-এ খনন করা এই উচ্চ-গ্রেডের সিলিকা নমুনার মতো শিলাগুলি আধুনিক কম্পিউটার চিপের ভিত্তি।

এই অঞ্চলের খনিজ সন্ধান বেগবান হয় ১৯০৩ সালের দিকে, যখন ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে কোম্পানি এই পর্বতগুলির মধ্যদিয়ে একটি রেললাইন বসায়। একবার যখন বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগের পথ খুলে গেল, তখন খনন কাজ শুরু হল পুরোদমে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই অঞ্চলের খনিজ সম্পদগুলির চাহিদা ব্যাপক আকার ধারণ করে। আর স্প্রুস পাইনের অর্থনীতিতে আসে সমৃদ্ধি। ১৯৪০ সালের দিকে শহরটি আকার ও আয়তন ৪ গুণ বেড়ে যায়।

এই দশকের শেষ দিকে টেনিসি ভ্যালি কর্তৃপক্ষ একদল বিশেষজ্ঞকে স্প্রুস পাইনে পাঠায় এই অঞ্চলের খনিজ সম্পদের উৎসগুলির আরো উন্নয়ন ঘটানোর উদ্দেশ্যে। এই বিশেষজ্ঞ দল মিকা ও ফেল্ডস্পার, এই দুই ধরনের খনিজের উপরে বেশি গুরুত্ব দেয়। কারণ তখনকার সময়ে এই দুটি খনিজের অর্থনৈতিক গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। তবে অন্যান্য খনিজ পদার্থ থেকে এই দুটি খনিজকে পৃথক করার প্রক্রিয়াটি ছিল জটিল।

স্থানীয়রা এতদিন হাতে চালিত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেই মিকা ও ফেল্ডস্পার পৃথক করত। পৃথকীকরণের পরে যে কোয়ার্টজ অবশিষ্ট থেকে যেত তাকে অদরকারী মনে করা হত। বড়জোর বিভিন্ন ধরণের নির্মাণ কাজে সেগুলি ব্যবহৃত হত।

আরো পড়ুন: ইউভাল নোয়াহ হারারি: প্রযুক্তি কেন স্বৈরাচারের পক্ষে

টিভিএ বিশেষজ্ঞরা নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটি’র গবেষকদের সাথে যৌথভাবে খনিজ পৃথকীকরণের আরো সহজ ও দ্রুত এক পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। একে বলা হয় ফ্রথ ফ্লোটেশন। ভূবিজ্ঞানী গ্লোভারের ভাষ্যমতে, “এই প্রক্রিয়াটি শিল্প ক্ষেত্রে বিপ্লব নিয়ে আসে। পরিবার ভিত্তিক ছোট শিল্প থেকে এটি বৃহৎ ও বহুজাতিক শিল্পে পরিণত হয়।”

স্প্রুস পাইনে প্রাপ্ত খনিজগুলির মধ্যে ‘ফেল্ডস্পারই’ প্রথম কর্নিং গ্লাস কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ারদের আকৃষ্ট করে। তখনও অবশিষ্ট কোয়ার্টজকে অপ্রয়োজনীয় বাই-প্রোডাক্ট হিসেবেই বিবেচনা করা হত। কিন্তু কর্নিং কোম্পানির ইঞ্জিনিয়াররা এর গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। তারা গ্লাস ফ্যাক্টরিতে এর ব্যবহার শুরু করেন। সেইসাথে রেলপথে এগুলিকে নিউইয়র্কে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেন।

স্প্রুস পাইনের কোয়ার্টজ ব্যবহারের মাধ্যমে কাচ শিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জনটি আসে ১৯৩০ সালে। পালোমার অবজারভেটরি তখনকার সময়ের সবচেয়ে বড় টেলিস্কোপ তৈরির দায়িত্ব দেয় কর্নিং কোম্পানিকে। এটি তৈরিতে প্রায় ২০ টন পরিমাণ কোয়ার্টজ ব্যবহার করা হয়। টেলিস্কোপটি ১৯৪৭ সালে অবজারভেটরিতে বসানো হয়। বিভিন্ন নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয় ও মহাবিশ্বের আয়তন পরিমাপ করতে এই টেলিস্কোপের অবদান ছিল অভূতপূর্ব।

ট্রানজিস্টরের অন্যতম আবিষ্কারক উইলিয়াম শকলে

১৯৫০ সালে ক্যালিফর্নিয়ার একদল ইঞ্জিনিয়ার একটি যন্ত্র আবিষ্কারের কাজ শুরু করেন যা কম্পিউটার শিল্পের ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ট্রানজিস্টরের অন্যতম আবিষ্কারক উইলিয়াম শকলে বেল ল্যাবস থেকে বেরিয়ে গিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার মাউনটেন ভিউতে নিজের একটি কোম্পানি চালু করেন। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে এই অঞ্চলের দূরত্ব খুব বেশি ছিল না। জেনারেল ইলেকট্রনিক ও আইবিএম-এর মত প্রতিষ্ঠানগুলিও পাশেই অবস্থিত ছিল। নতুন কোম্পানিটির নাম দেয়া হয় হিউলেট-প্যাকার্ড। এই অঞ্চলটি তখন পরিচিত ছিল সান্তা ক্লারা ভ্যালি নামে। পরবর্তীতে এটিই বিখ্যাত হয়ে ওঠে ‘সিলিকন ভ্যালি’ হিসেবে।  

সেই সময়ে ট্রানজিস্টর মার্কেটের ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে ওঠে। টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টস, মোটোরলা এবং অন্যান্য কোম্পানির মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয় কে কত ছোট ও কার্যকর ট্রানজিস্টর তৈরি করতে পারে। আমেরিকার প্রথম কম্পিউটার ‘এনিয়াক’ তৈরি করা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। এটি ছিল ১০০ ফুট লম্বা ও ১০ ফুট উঁচু। আর এটি ব্যবহার করতে ১৮,০০০ ভ্যাকুয়াম টিউব লাগত।   

ট্রানজিস্টরের আবিষ্কারের ফলে এই টিউবগুলি প্রতিস্থাপন করা ও যন্ত্রগুলিকে আরো শক্তিশালী করা সম্ভব হয়। ট্রানজিস্টর তৈরিতে সেমিকন্ডাক্টরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর সেমিকন্ডাক্টর তৈরিতে ব্যবহৃত অন্যতম দুটি উপাদান হল জার্মেনিয়াম ও সিলিকন।

শকলে’র জীবনী লেখক জয়েল শার্কিন-এর ভাষ্যমতে, শকলে বুঝতে পেরেছিলেন উপাদান হিসেবে জার্মেনিয়ামের তুলনায় সিলিকন অনেক বেশি কার্যকর। তাই তিনি সিলিকন নিয়ে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তার প্রতিষ্ঠানটি ছিল সেমিকন্ডাক্টর বিষয়ক গবেষণা ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রথম ও সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। শকলে’র দেখাদেখি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলিও জার্মেনিয়াম বাদ দিয়ে সিলিকন নিয়ে গবেষণা শুরু করে। শার্কিনের মতে, শকলে যদি সিলিকন নিয়ে গবেষণা করার সিদ্ধান্ত না নিতেন তাহলে আমরা হয়ত এখন সিলিকন ভ্যালি নিয়ে আলোচনা না করে জার্মেনিয়াম ভ্যালি নিয়ে আলোচনা করতাম।

আরো পড়ুন: টেক্সট নেক সিনড্রোম ও মেরুদণ্ডের ক্ষতি

শকলে নিঃসন্দেহে জিনিয়াস ছিলেন। কিন্তু কর্মকর্তা হিসেবে তেমন সুবিধার ছিলেন না। তাই কয়েক বছরের মধ্যেই অনেক মেধাবি ইঞ্জিনিয়ার তার কোম্পানি ছেড়ে নিজেদের একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। এদের মধ্যে একজন ছিলেন রবার্ট নয়েস। নয়েসের বয়স তখন ত্রিশেরও কম। কিন্তু ট্রানজিস্টর তৈরিতে তার দক্ষতার জন্যে তিনি ইতিমধ্যেই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন।  

১৯৬৮ সালে রবার্ট নয়েস নিজের একটি নতুন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এর নামকরণ করা হয় ‘ইনটেল’।

১৯৫৯ সালে নয়েস ও তার সহকর্মীরা অনেকগুলি ট্রানজিস্টরকে আঙুলের নখের মত ছোট হাই-পিওরিটি সিলিকনের মধ্যে স্থাপন করার কৌশল আবিষ্কার করেন। নাসা তাদের মহাকাশ গবেষণার কাজে নয়েসের তৈরি নতুন এই মাইক্রোচিপ ব্যবহার করতে শুরু করে। এই মাইক্রোচিপের চাহিদা এত বৃদ্ধি পায় যে নয়েস-এর কোম্পানি প্রতিবছর ১৩০ মিলিয়ন ডলার আয় করতে শুরু করে।

১৯৬৮ সালে নয়েস এই কোম্পানি ছেড়ে নিজের একটি নতুন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এর নামকরণ করা হয় ‘ইনটেল’। কম্পিউটার চিপ উৎপাদন শিল্পে শীঘ্রই এই প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে।

ইনটেল-এর প্রথম চিপ বাজারে আসে ১৯৭১ সালে। এতে মোট ২,২৫০টি ট্রানজিস্টর সংযুক্ত ছিল। এখনকার কম্পিউটারে যে চিপ ব্যবহার করা হয় তাতে বিলিয়নেরও বেশি ট্রানজিস্টর সংযুক্ত থাকে। এই ছোট্ট চিপগুলিই হল আমাদের কম্পিউটার, ইন্টারনেটসহ পুরো ডিজিটাল বিশ্বের মস্তিষ্ক। বালু থেকে উৎপন্ন সিলিকন দ্বারা নির্মিত এই চিপগুলিই হল গুগল, অ্যামাজন, অ্যাপল, মাইক্রোসফট সহ সমস্ত কম্পিউটার সিস্টেমগুলির ভিত্তি।

সিলিকন খুঁজে পাওয়া খুবই সহজ। পুরো পৃথিবীজুড়েই এটি পাওয়া যায়। অক্সিজেনের সাথে যুক্ত হয়ে সিলিকন ডাই অক্সাইড গঠনের মাধ্যমে প্রকৃতির সর্বত্রই এটি ছড়িয়ে আছে। এই সিলিকন ডাই অক্সাইডকেই বলা হয় কোয়ার্টজ। সমস্যা হল প্রকৃতিতে সিলিকনকে কখনোই বিশুদ্ধরূপে পাওয়া যায় না। এটি সব সময়ই যৌগ হিসেবে উপস্থিত থাকে। যৌগ থেকে সিলিকনকে পৃথক করে নেয়াটা বেশ জটিল কাজ।

প্রথমে বিশুদ্ধ সিলিকা বালু নিতে হয়। এই সিলিকা কাচ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। তারপর এই কোয়ার্টজে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা হয়। ফলে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে অক্সিজেন পৃথক হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন উপাদানটিকে বলা হয় সিলিকন মেটাল। এই সিলিকন মেটাল হল ৯৯ ভাগ বিশুদ্ধ সিলিকন।

কিন্তু হাই-টেক প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত সিলিকাকে হতে হয় ৯৯.৯৯৯৯৯৯ ভাগ বিশুদ্ধ। আর কম্পিউটার চিপে ব্যবহৃত সিলিকাকে হতে হয় প্রায় ৯৯.৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯ ভাগ বিশুদ্ধ।

এত বিশুদ্ধ সিলিকন উৎপাদনের জন্যে সিলিকন মেটালকে অনেকগুলি জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রথমে সিলিকন মেটালকে দুইটি যৌগে বিভক্ত করা হয়। একটি হল সিলিকন টেট্রাক্লোরাইড। এটি অপটিক্যাল ফাইবার তৈরিতে ব্যবহৃত একটি প্রধান উপাদান। অন্যটি হল ট্রাইক্লোরোসিলেইন। এটিকে আবার রূপান্তর করা হয় পলিসিলিকনে। পলিসিলিকন হল অতিমাত্রায় বিশুদ্ধ সিলিকন যা সোলার সেল ও কম্পিউটার চিপ তৈরির প্রধানতম উপাদান।

সিলিকা
ইউনিমিন নামের কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালে। ধাপে ধাপে এই প্রতিষ্ঠানটি স্প্রুস পাইনের সমস্ত খনি কিনে নেয় এবং অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলিকে হঠিয়ে দেয়। এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের সবচেয়ে বিশুদ্ধ কোয়ার্টজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান।

বর্তমানে একটিমাত্র কোম্পানি স্প্রুস পাইনের কোয়ার্টজ উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে। ইউনিমিন নামের কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালে। ধাপে ধাপে এই প্রতিষ্ঠানটি স্প্রুস পাইনের সমস্ত খনি কিনে নেয় এবং অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলিকে হঠিয়ে দেয়। এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের সবচেয়ে বিশুদ্ধ কোয়ার্টজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান।    

বিগত কয়েক বছরে ‘কোয়ার্টজকোর্প’ নামের অন্য একটি প্রতিষ্ঠান স্প্রুস পাইন মার্কেটের একটি ছোট্ট শেয়ার কিনতে পেরেছে। পৃথিবীর খুব কম অঞ্চলেই স্প্রুস পাইনের মত বিশুদ্ধ কোয়ার্টজ পাওয়া যায়। আপাতত ইউনিমিন-ই এই শিল্পের বেশিরভাগটুকু নিয়ন্ত্রণ করছে।  

প্রতিবছর সারা বিশ্বে বিশুদ্ধ কোয়ার্টজের উৎপাদন হয় প্রায় ৩০,০০০ টন। একমাত্র ইউনিমিন-ই জানে স্প্রুস পাইনে প্রতিবছর কতটুকু কোয়ার্টজ উৎপাদন করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি তাদের উৎপাদনের কোনো হিসাব প্রকাশ করে না। গোপনীয়তার জন্যে এই প্রতিষ্ঠানটি বিখ্যাত।

আরো পড়ুন: মানুষের আয়ুর সীমা—১৫০ বছর?

ইউনিমিন এমনকি মিনারেলস রিসার্চ ল্যাবোরেটরির কোনো গবেষককেও খনির ভিতরে প্রবেশ করতে দেয় না। কারখানার মেরামত করতে আসা কন্ট্রাকটরদেরকে গোপনীয়তা রক্ষা করার শর্তযুক্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হয়। প্রতিষ্ঠানটি কন্ট্রাকটরদের মধ্যে কাজ আলাদা আলাদা ভাবে ভাগ করে দেয় যেন কেউ ব্যক্তিগতভাবে খুব বেশি কিছু জানতে না পারে। ঠিক একই কারণে কারখানা চালানোর জন্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও কেনা হয় একাধিক কোম্পানি থেকে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীদের সাথে অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানের লোকদের সামাজিক মেলামেশাও নিষিদ্ধ।

অয়ার্ড অবলম্বনে দীপ্র আসিফুল হাই