এফবিআই নিয়ন্ত্রিত মেসেজিং অ্যাপের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সংঘবদ্ধ অপরাধীদের চক্রে অভিযান পরিচালনায় হাজারো অপরাধী আটক
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা এবং নিরাপত্তা সংস্থা এফবিআই পরিচালিত একটি মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে কয়েকশো অপরাধীকে চিহ্নিত এবং গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে।
গত মঙ্গলবার অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের কর্তৃপক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, তারা সংঘবদ্ধ অপরাধীদের কয়েকটা বড় চক্রের সাথে জড়িতদের গ্রেফতার করেছে। এই অপরাধীদের কেউই জানতো না যে, তারা ‘অ্যানোম’ (ANOM) নামের যে এনক্রিপ্টেড অ্যাপ্লিকেশনটি ব্যবহার করছে, সেটা গোপনে এফবিআই দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।
দীর্ঘ কয়েকমাস ধরে এই অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে মাদক চোরাচালান, অর্থ পাচার থেকে শুরু করে হত্যা পরিকল্পনার মতো অপরাধের সাথে যুক্ত অপরাধীদের উপর নজর রাখা হচ্ছিল।
এফবিআইয়ের নেতৃত্বে ‘ট্রোজান শিল্ড’ নামের একটি স্টিং অপারেশনের অংশ হিসেবে অ্যাপটি ডেভেলপ করা হয়েছিল। এছাড়াও এই অপারেশনে সঙ্গে মার্কিন ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পুলিশ সংস্থা ইউরোপোল এবং প্রায় এক ডজনেরও বেশি দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যুক্ত ছিল। ইউরোপোল থেকে জানানো হয়েছে যে, ব্ল্যাক মার্কেটের এই অ্যাপের মাধ্যমে সংগৃহীত প্রমাণের উপর ভিত্তি করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে মোট ১৬টি দেশের পুলিশ বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করেছে।
এফবিআই এবং ক্যালিফোর্নিয়ার সাউদার্ন ডিসট্রিক্ট অ্যাটর্নির কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে যে, মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই বিশ্বজুড়ে ৭০০টিরও বেশি স্থানে গ্রেফতার এবং তল্লাশির জন্যে ৯,০০০ কর্মকর্তাকে মাঠে নামানো হয়েছে।
কোকেন, গাঁজা, অ্যামফেটামিন এবং মেথামফেটামিন সহ ৩২ টনেরও বেশি মাদক, ২৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং বিশ্বের বিভিন্ন মুদ্রায় ৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের অর্থ জব্দ করা হয়েছে।
জার্মানির ইতিহাসে সর্ববৃহৎ গোপন ড্রাগ ল্যাব সহ প্রায় ৫০টিরও বেশি গোপন ড্রাগ ল্যাব ধ্বংস করা হয়েছে এই অপারেশনে।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের মতে, শেষ ৪৮ ঘণ্টায় ৫০০ জন সহ মোট ৮০০ জনেরও বেশি অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গত মঙ্গলবার সকালে নেদারল্যান্ডসে অবস্থিত ইউরোপোলের সদর দফতরে এফবিআইয়ের সহকারী পরিচালক ক্যালভিন শিভার্স বলেন, এই অপারেশনের ফলাফল আশ্চর্যজনক।
এফবিআইয়ের স্যান ডিয়েগো ফিল্ড অফিসে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্পেশাল এজেন্ট সুজান টার্নার জানান, শুধুমাত্র অপরাধমূলক কাজকর্ম করার জন্যে ব্যবহৃত ক্লোজড এনক্রিপটেড কমিউনিকেশন ডিভাইসে অনুপ্রবেশ কীভাবে করা যায়, সেটা বহুদিনের জটিলতা ছিল। বিভিন্ন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা সময়ের সাথে সাথে বাড়তে থাকা চলমান এবং জটিল এই সমস্যার মুখে প্রতিদিনই পড়ে। অপারেশন ট্রোজান শিল্ড এই সমস্যার এক উদ্ভাবনী সমাধান হাজির করেছে।
টার্নার জানিয়েছেন, অপরাধীরা প্রায়ই গোপনে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে এনক্রিপশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এতে অপরাধ সংঘটন হওয়ার আগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির কাছে তা ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ে। সংঘবদ্ধ অপরাধীদের ক্লোজড এনক্রিপটেড ডিভাইসের চাহিদার সুযোগ নিয়েছে তদন্তকারী দল। টার্নারের মতে, এটা অপরাধীদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি দুর্বলতা।
এফবিআই জানিয়েছে যে, তারা একশো’রও বেশি দেশের ৩০০টির চেয়েও বেশি অপরাধীদের সিন্ডিকেটের কাছে এই অ্যাপ পৌঁছাতে পেরেছিল। ফলে ১২,০০০ এরও বেশি ডিভাইসে অ্যাপটি ইন্সটল করানো সম্ভব হয়। ফ্রান্সের বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে যে, অ্যানোম অ্যাপ্লিকেশন যুক্ত ডিভাইসগুলি প্রায় ২ বছরেরও বেশি সময় ধরে ছড়ানো হচ্ছিল। ফলে এজেন্টরা অপরাধীদের মধ্যকার যোগাযোগের ওপর কড়া নজর রাখতে পারছিল।
ক্যালিফোর্নিয়ার সাউদার্ন ডিসট্রিক্ট এর ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি র্যান্ডি গ্রসম্যান বলেন, নিজেদের ডিভাইসের গোপনীয়তার ওপর অ্যানোম-এর পরিচালক, পরিবেশক এবং এজেন্টদের এত বেশি আস্থা ছিল যে, তারা সম্ভাব্য গ্রাহকদের কাছে বেশ খোলামেলাভাবেই অ্যাপটির প্রচারণা শুরু করে। তারা ব্যাপারটা এভাবে তুলে ধরেছিল, যেন অ্যাপটি অপরাধীরাই অপরাধীদের জন্যে তৈরি করেছে। অথচ তাদের ডিভাইসগুলি মূলত এফবিআইয়ের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল।
অস্ট্রেলিয়ার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, বর্তমানে চলমান অভিযানটি তিন বছর ধরে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এই অভিযানে তারা ২২৪ জনকে গ্রেপ্তার এবং চার টনেরও বেশি মাদকদ্রব্য এবং ৩৫ মিলিয়ন ডলার জব্দ করেছে। নিউজিল্যান্ডের পুলিশ জানিয়েছে যে, তারা মোট ৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে এবং কয়েক মিলিয়ন ডলারের মাদক আর সম্পত্তি জব্দ করেছে।
সংঘবদ্ধ অপরাধচক্রের বিরুদ্ধে কাজ করা নিউজিল্যান্ডের পুলিশের একটি অংশের নেতৃত্বদানকারী ডিটেকটিভ সুপারইন্টেন্ডেন্ট গ্রেগ উইলিয়ামস এ নিয়ে তার মতামত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ২০১৮ সালে প্রথম এই স্টিং অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয়। সেই বছরই অপরাধীদের ব্যবহৃত ‘ফ্যান্টম সিকিউর’ নামের একটি গোপন অ্যাপ বাজেয়াপ্ত করা হয়।
উইলিয়ামস জানান, সেই অ্যাপটি বাজেয়াপ্ত হওয়ার পরে অপরাধী চক্রের বাজারে যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়। অ্যানোম অ্যাপ দ্রুতই সেই শূন্যতা পূরণ করে ফেলে। তার মতে, এফবিআই এই গোপন অপারেশনের মাধ্যমে যেই সাফল্য দেখিয়েছে, সেটা এককথায় প্রকাশ করার মতো না।
এদিকে সুইডেনের ন্যাশনাল ক্রিমিনাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রধান লিন্ডা স্টাফের এক বিবৃতি থেকে জানা যায় যে, দেশটির পুলিশ এর মাধ্যমে অন্তত এক ডজন পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধ করতে পেরেছে। এছাড়াও তাদের মতে, তারা অপরাধী নেটওয়ার্কের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতাকেও আটক করতে পেরেছে।
গত মঙ্গলবার ফিনল্যান্ডের পুলিশ জানিয়েছে যে, তাদের অভিযানে কয়েক শতাধিক মানুষকে আটক করা হয়েছে। এছাড়াও কয়েক ডজন বন্দুক এবং নগদ কয়েক হাজার ডলার সমমূল্যের নগদ অর্থ সহ ৫০০ কেজিরও বেশি মাদক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
একই দিনে জার্মান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী পরিচালিত এই অভিযানের অংশ হিসেবে দেশটির পুলিশ ৭০ জনেরও বেশি সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আটক এবং বেশ কিছু স্থান তল্লাশি করেছে। ফ্রাঙ্কফুর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর অফিস থেকে জানানো হয়েছে যে, গত সোমবারের অভিযানের বেশিরভাগই ‘হেসেন’ অঙ্গরাজ্যে পরিচালনা করা হয়েছে।
গত মার্চ মাসে আরেকটি এনক্রিপ্ট করা চ্যাট সিস্টেম ক্র্যাক করে প্রায় কয়েক ডজন অপরাধীকে আটক এবং ১৭ টনেরও বেশি কোকেন জব্দ করেছিল বেলজিয়ামের পুলিশ। সাম্প্রতিক অভিযানে আরও বেশি অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।
সিবিএস নিউজ অবলম্বনে ফারহান মাসউদ