আমার অন্যতম অপছন্দের খাবারগুলির মধ্যে একটা হচ্ছে ওটমিল। যত যা’ই দেই এতে, যতভাবেই বানাই, ওটমিলের স্বাদই মুখে লাগে। এই স্বাদ আমার ভালো লাগে না। ওটমিল বা ওটস আমাদেরকে আমার আম্মা খাওয়াইতো একদম ছোটবেলায়। বেশি করে দুধ দিয়া রান্না কইরা। তখন বোধহয় ভালোই লাগত।

এখন যদিও জিনিসটা বিস্বাদ লাগে, কিন্তু এর পুষ্টিগুণের কারণে ওটমিলের প্রতি গোপনে কিছুটা ভক্তি ও সম্মানই আছে আমার। আমি ফুড আর নিউট্রিশন নিয়ে বিভিন্ন লেখাপত্র পড়তে পছন্দ করি। এইটা আমার পরিচিতরাও জানেন। তাই নানা সময় বিভিন্ন খাদ্য বিষয়ক পরামর্শ লাগলে তারা আমাকে জিজ্ঞেস করেন। তাদের যখন কেউ অসুস্থ হয় বা স্বাস্থ্য ভালো করার পরামর্শ চায়, আমি সবার আগে দেখি সেইটা খাওয়া দিয়া কীভাবে সমাধান করা যায়। যেহেতু আমি ডাক্তার না, অনলাইনে বিশ্বস্ত সোর্স দেখে খাদ্য ও পুষ্টি নিয়াই বলতে পারব।

ওটসের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে প্রথম কিছুটা জানতে পারি বছর তিনেক আগে। প্রসেসড খাবার খাওয়া হইত অনেক। স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাইতেছিল। দিনের বেশির ভাগ সময় টায়ার্ড থাকতাম। তখন ভাবলাম ভালো খাবারে সুইচ না করলে অল্পদিনে মারা যাবো। কিন্তু স্বাদ তো একবারে বদলানো যাবে না, কাজটা ধীরে ধীরে করতে হবে।

প্রথমে যেইটা করলাম, আমার পদ্ধতি অনুসারে, কোনো কিছু বাদ না দিয়া একটা হেলদি কনস্ট্যান্ট অপশন অ্যাড করব বলে ঠিক করলাম। তারপর অনলাইনে খোঁজ করা শুরু করলাম সেই অপশনটা কী হইতে পারে।

প্রতিদিন কী কী ধরনের খাবার খাই তা বোঝার চেষ্টা করলাম আগে। দেখলাম, একটা বড় জিনিস আমি দীর্ঘসময় ধরে বাদ দিয়ে যাচ্ছি, সেটা হলো―ফাইব্রাস খাবার।

যেইটা এখন আমার শরীরে কোনো সিরিয়াস প্রভাব না ফেললেও, কয়দিন পর হয় হার্ট অ্যাটাক হবে নাইলে অন্য ভাবে অল্পদিনে মারা যাইতে হবে। তা আমি চাই নাই।

কোনো কিছু বাদ না দিয়া একটা হেলদি কনস্ট্যান্ট অপশন অ্যাড করব বলে ঠিক করলাম


তখনই ওটমিল’কে খুঁইজা নেওয়া, ওটমিলের ব্যাপারে পড়া শুরু করা। সঙ্গে অন্যান্য ফাইব্রাস খাবার যেমন, প্রতিদিন ১টা করে কলা খাওয়ার যে অভ্যাস আমার সেইটা তখনই চালু হয়ত। কিডনি বিন, কাঠবাদাম প্রতিদিন ৫টা, চিয়া সিড, মিষ্টি আলু, কুমড়ার বীজ, ডাল প্রতিদিন অল্প অল্প করে খাওয়া শুরু করি।

এই খাবারগুলি অ্যাড করার চেঞ্জ বডিতে, অন্যান্যদের ক্ষেত্রে কী হয় জানি না, আমি চোখে পড়ার মতই দেখছি। প্রথমত আমার বাওয়েল সিস্টেম বা হজম ক্ষমতা অনেক বেড়ে গেল। টায়ার্ড কম লাগত, অনেক অ্যানার্জি পাইতাম কাজে।

তার কারণ ফাইবার বাওয়েল সিস্টেম ঠিক রাখে। নিজে ধীরে ধীরে হজম হয়, এবং হজম ক্ষমতা বাড়ায়। এর অন্য বড় দিকগুলি হচ্ছে, রেগুলার ফাইবার খেলে আপনার কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ বা হার্টের রোগের ঝুঁকি কমবে। বেশিদিন বাঁচবেন, রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

তো তখন অন্যান্য ফাইব্রাস খাবারের সঙ্গে ওটমিলও অল্প অল্প করে প্রতিদিন খাওয়া চেষ্টা করলাম।

ওটমিলের কথা বলতে গিয়া একটা জরুরি বিষয় মনে পড়ল, ভাত। সেইটা আগে বলে নেই। চাল তো অনেক রকম আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে সাদা চাল আর লাল চাল। এখন কথা হচ্ছে আপনি কোনটা খাবেন?

চালের ৩টা পার্ট থাকে। শব্দগুলির ইংরেজিটা জানি আমি, যেহেতু আর্টিকেলগুলি ইংরেজিতে পড়ছি। চালের ৩টা অংশ থাকে―ব্র্যান, জার্ম আর এন্ডোস্পার্ম।

ব্র্যান হচ্ছে চালের ফাইব্রাস অংশ আর এন্ডোস্পার্ম হচ্ছে কার্ব। রাইস ব্র্যান অয়েলের কথা মনে পড়ে? চালের এই বাইরের দিক থেকে সেকেন্ড লেয়ার ‘ব্র্যান’ থেকেই তেলটা সংগ্রহ করা হয়।

তো যেইটা বলতেছিলাম, চালের এই ব্র্যানের অংশটাই ফাইব্রাস। বা ফাইবার দিয়ে তৈরি। লাল চালে এই তিনটা অংশই থাকে। যার কারণে আপনি চালের কার্ব, ফাইবার আর অন্যান্য পুষ্টি উপাদানগুলি পান। সাদা চালে এন্ডোস্পার্ম বাদে বাকি সবচেয়ে দরকারি দুইটা অংশ ব্র্যান আর জার্ম ফেলে দেয়া হয়। ফলে সাদা চাল খাইলে আপনি খাচ্ছেন শুধু কার্ব। ফাইবার পাচ্ছেন না। আর এক কাপ সাদা চালের গ্লিসেমিক ইনডেক্স ৬৬, লাল চালে তা ৫৫ (কোনো খাবার খাওয়ার পরে তা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কত দ্রুত বা কত ধীরে বাড়ায়, এর স্কেল ০-১০০)। যে কারণে ডায়াবেটিস পেশেন্টদের জন্য সাদা চালের চেয়ে লাল চাল ভালো।

রেগ্যুলার ফাইবার খেলে আপনার কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ বা হার্টের রোগের ঝুঁকি কমবে


তো আলাদা ভাবে বলতে গেলে, ওটমিল বা ওটস প্রতিদিন খাওয়ার অনেক উপকারিতা আছে। তার সঙ্গে যদি কিছু ফল-মূল, নাট বাটার, সিডস আর আস্ত বাদাম অ্যাড করে নিতে পারেন তাইলে এর পুষ্টিগুণ অনেক বেড়ে যায়।

অনেকে হলুদ, মরিচ দিয়ে কিছুটা খিচুড়ির মতো রান্না করে খাইতে পছন্দ করেন ওটস। আমি এভাবে খাই নাই কখনো। তবে ফল আর বাদাম যোগে খাওয়া আমার মতে বেটার। বিশেষত সকালে, যারা বিজি লাইফ লিড করেন, অফিসে যাইতে হয়, নাস্তা করার সময় তাড়া থাকে বলে হেলদি কিছু ভাবতে পারেন না। বা আলাদা করে ফল, বাদাম খাওয়ার সময় হয় না, খেয়াল থাকে না।

এইরকম হলে আগের রাতে ওটমিল বানায়া ফ্রিজে রাইখা দেন, আমি বলব। সকালে উইঠা শুধু টপিংগুলি, মানে ফলমূল-বাদাম-সিড-নাট এগুলি অ্যাড করে খেয়ে নিলেন। আর এখন তো রোজা, সেহেরির জন্য ওটমিল খুব ভালো অপশন।

ওটমিল স্লো কার্ব। হোল গ্রেইন রুটি, ব্রাউন রাইস এগুলিও স্লো কার্ব। স্লো কার্ব মানে, হজম হইতে সময় লাগে। রিফাইন্ড কার্ব (সাদা ভাত, আটা, চিনি) যেমন খাওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে হঠাৎ রক্তে সুগারের পরিমাণ বাড়ায়া দেয়, এগুলি তা করে না।

প্রতিদিন একটা করে কলা খাইলে অনেক অ্যানার্জি পাবেন৷ বিশেষজ্ঞরা সকালে কলা খাইতে না করে। সকালে কলা খাইলে ক্ষুধা লাগে দ্রুত আর ক্লান্ত হয়ে যাবেন। কারণ একটা পাকা কলার প্রায় ২৫ পার্সেন্টই চিনি। খাওয়ার পর পর অনেক অ্যানার্জি পাবেন, কিন্তু পরে ক্লান্ত লাগবে। এজন্য আমি বিকালের পরে, বা সন্ধ্যায় কলা খাই। এবং শুধু কলা খাওয়ার বদলে, সঙ্গে দই বা টোস্ট খাওয়া ভালো। তাতে কলার প্রাকৃতিক চিনি শোষণ করা সহজ হয় শরীরের জন্য।

তো, ওটমিল খাবার হিসেবে ভারি খাবার না, কিন্তু ক্ষুধা দূর করে আর ক্লান্তি আসে না। একই সঙ্গে নানান পুষ্টিগুণে ভরপুর। এতে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন, ফাইবার, মিনারেল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে। ওটমিল ব্লাড সুগার লেভেল কমায় ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। ওজন কমাইতেও সাহায্য করে।

ওটসে ফলমূল হিসেবে সিজনাল ফলগুলি অনায়াসে ব্যবহার করতে পারেন। আমি কলা, ডালিম, আপেল এগুলি অ্যাড করি খেলে। সকালে খাইলে কলা বাদ দেই। আপনি চাইলে আপনার যা যা ভালো লাগে দিয়ে নিতে পারেন। অনেকে ওটসে পিচ, স্ট্রবেরি, ড্রাগনফ্রুট, কিউয়ি, ব্লুবেরি পছন্দ করেন। এই ফলগুলির কিছু কিছু এখন আমাদের দেশেই উৎপাদিত হয়। কিছু আবার ইস্পোর্টেড। যেগুলি পাওয়া যায় না, ‘স্বপ্ন’ ‘মিনা বাজার’ ‘ইউনিমার্ট’ ‘আগোরা’র মত সুপার শপ থেকে সংগ্রহ করতে পারেন।

পাকা মিষ্টি ফল ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটা মিষ্টি ফল, আর বাকিগুলি এর চেয়ে কম মিষ্টি এমন হওয়া ভালো৷ কারণ ফলের চিনিও বেশি পরিমাণে খাইলে আপনার ক্লান্ত লাগবে।

যাদের ডায়াবেটিস আছে, পাকা ফলে তাদের গ্লুকোজ বেড়ে যাইতে পারে। এই দিকটা একটু খেয়াল রাখতে হবে। পাকা ফল অ্যাড করার ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ ও ঠিক করে দেয়া পরিমাণ অনুসরণ করা ভালো।

ওটসে বাদাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে কাঠবাদাম আস্ত বা ক্রাশ করে দিতে পারেন, ওয়ালনাট ব্যবহার করতে পারেন। বাদাম হার্টের জন্য খুব ভালো৷ রক্তের জমাট বেঁধে যাওয়ার ঝুঁকি কমায়। রক্ত জমাট বেঁধে গেলে হার্ট অ্যাটাক হয়।

যদি কিছু ফল-মূল, নাট বাটার, সিডস আর আস্ত বাদাম অ্যাড করে নিতে পারেন তাইলে এর পুষ্টিগুণ অনেক বেড়ে যায়


বাদাম রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড ও খারাপ কোলেস্টেরল বা এলডিএলও (LDL) কমায়। তাছাড়া বাদামে থাকে ওমেগা-3 ফ্যাটি এসিড, ফাইবার, ভিটামিন ই, ও এল-আর্জিনিন (এইটটা ধমনীর প্রাচীরকে নমনীয় রাখে, ফলে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে না, রক্তের স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় থাকে)।

সিড হিসেবে চিয়া সিড, ফ্ল্যাক্স সিড, তিলের বীজ, সূর্যমুখী বীজ, কুমড়ার বীজ এগুলি ব্যবহার করতে পারেন। সিড বা বীজ ফাইবারের খুব ভালো উৎস। এগুলিতে আছে দুই রকমের হেলদি ফ্যাট (মনোআনস্যাচুরেটেড ও পলিআনস্যাচুরেটেড), ওমেগা-3, ভিটামিন, প্রোটিন ও মিনারেল।

ওমেগা-3 এক ধরনের ফ্যাটি এসিড। শরীর, চোখ আর মস্তিষ্কের জন্য খুব ভালো। জানলে হয়তো অবাক হবেন, ওমেগা-3 ডিপ্রেশন আর অ্যাংজাইটি কমাতেও সাহায্য করে। হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। বয়স সংক্রান্ত রোগ বা সমস্যা, যেমন আলঝেইমারের ঝুুঁকি কমায়।

শরীরে ওমেগা-3 লেভেল বাড়াইতে চাইলে ফ্ল্যাক্স সিড দানা আকারে খাওয়ার চেয়ে গুঁড়া করে খাইতে পারেন, গুঁড়া করে খাওয়া বেশি কাজে দেয়।

ওটসে পিনাট বাটার ব্যবহার করলে খেতে ভালো লাগবে, সঙ্গে ওটসের স্বাদেও পরিবর্তন আসবে। আমি দুই চামচ পিনাট বাটার ব্যবহার করি ওটসে৷

পিনাট বাটারে ওমেগা-6 নামের ফ্যাটি এসিড থাকে থাকে, যেইটা এলডিএল (LDL) বা রক্তের খারাপ গ্লুকোজ কমায়। এবং এইচডিএল (HDL) বা রক্তের ভালো গ্লুকোজ বাড়ায়। তাছাড়া, পিনাট বা চিনা বাদাম ‘আর্জিনিন’ নামের অ্যামিনো এসিডের প্রাকৃতিক উৎস। যেইটা আবার হার্টের রোগের ঝুঁকি কমায়।

ওটসে বাড়তি চিনি না দেয়া ভালো। বিশেষত সাদা চিনি। একদমই মিষ্টি না হইলে না, এমন হইলে হালকা ব্রাউন সুগার , সবচেয়ে ভালো হয় খাঁটি মধু দিতে পারলে।

যাদের ডেইরি বা দুধ দিয়ে বানানো খাবারে সমস্যা হয়, সাধারণ দুধের বদলে বিভিন্ন প্ল্যান্ট বেজড মিল্ক ব্যবহার করতে পারেন। যেমন: আমন্ড মিল্ক, সয়া মিল্ক, কোকোনাট মিল্ক। এইগুলিতেও চিনি মেশানো থাকতে পারে। পেছনে উপাদানের তালিকায় চিনি আছে কিনা, থাকলেও কতটুকু আছে দেখে নিয়েন। সবচেয়ে ভালো হয় আনসুইটেন্ড নিতে পারলে।

তবে এই মিল্ক অপশনগুলি কিনে খেতে না চাইলে বাড়িতে নিজ হাতে সহজেই তৈরি করে নিতে পারবেন। ইউটিউবে প্রচুর ভিডিও পাবেন কীভাবে নারিকেলের দুধ তৈরি করতে হয়, কীভাবে কাঠ বাদাম পেস্ট বা কাঠবাদামের দুধ বানাইতে হয়।

এইভাবে যদি ওটস খাইতে পারেন, তাহলে আপনার অনেক উপকার হবে। প্রথমত আপনি আপনার হার্ট সুস্থ রাখার জন্য অনেক বড় পদক্ষেপ নিলেন। দ্বিতীয়, আপনার ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

আমি যেমন ওটস থেকে আরো আরো হেলদি অপশনে সুইচ করতে পারছি, আপনিও পারবেন। স্বাস্থ্য ঠিক করা বা নিজের শরীরকে প্রায়োরিটি দেওয়াকে কখনো চাপ আকারে নেয়া যাবে না। তাইলেই বার বার ফেইল করবেন। একটা একটা করে চেঞ্জ করেন। প্রথমেই বাদ দিতে না পারলে একটা হেলদি অপশন অ্যাড করেন, তারপর ধীরে ধীরে আনহেলদিটা বাদ দেয়ার প্র্যাকটিস শুরু করেন। এইভাবে করে নিজেকে চাপ না দিয়া বরং উপলব্ধি করে এবং শরীরকে-মনকে অভ্যস্ত করানোর মাধ্যমে যখন কোনো রুটিনে যাবেন, সেইটা স্থায়ী হবে।