বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক জেরেমি বেন্থাম (১৭৪৮-১৮৩২) এমনই লাজুক ছিলেন যে যেকোনো প্রকারের সামাজিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলতেন।

কখনোই একই সময়ে একের অধিক সাক্ষাৎকারী সহ্য করতে পারতেন না তিনি। এমনকি কোনো আগন্তুকের সঙ্গে দেখা হওয়ার বিষয় থাকলে ভয়ে তার অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। তিনি তার সমসাময়িক দার্শনিকদের প্রচুর চিঠি লিখতেন কিন্তু সেগুলি কখনোই পাঠাতেন না।

মানুষের সঙ্গের পরিবর্তে বেন্থাম প্রাণীদের সঙ্গ বেছে নিয়ে নিয়েছিলেন। বিশেষ করে তার অসংখ্য পোষা ইঁদুরগুলি দিয়ে। ইঁদুরগুলিকে সবখানে হেঁটে চলতে দিতেন, সেই ইঁদুরগুলি তার লেখা কাগজের উপর হেঁটে বেড়াত এবং তা কেটেকুটে নষ্ট করত। বেন্থামের মৃত্যুর পর তার বন্ধু আর ছাত্ররা অনেক কষ্টে ওই কেটেকুটে শেষ করা নষ্ট পাণ্ডুলিপিগুলি থেকে তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ উদ্ধার করেছেন।

তাছাড়া প্রাণহীন জিনিসপত্রকে নাম দেয়ার অদ্ভুত স্বভাব ছিল বেন্থামের। তার ব্যবহার্য গৃহস্থালির জিনিসপত্রের তিনি নাম রাখতেন। তার খুব প্রিয় একটা হাঁটার লাঠি ছিল, সেইটাকে তিনি ডাকতেন ‘ডেপল’ বলে। তার সঙ্গে নতুন সাক্ষাৎ করতে লোকেরা তো ভিমড়ি খেয়ে যেতেন যখন তাকে তার চায়ের পাত্রকে ‘ডিক’ বলে ডাকতে শুনতেন।

বেন্থাম লেখা থামিয়েছেন খুব কমই। যখনই মাথায় কোনো আইডিয়া আসত, সেটা সঙ্গে সঙ্গে লিখে ফেলতেন। আর লিখে সেটাকে পর্দা কিংবা দেয়ালে পিন দিয়ে আটকে দিতেন নইলে ফ্লোরে বিছিয়ে রাখতেন। এমন খুব কমই হয়েছে তিনি কিছু লিখছেন, তারপর লেখাটার কোথায় ছিলেন ভুলে গেছেন।

একদিন কিছু আইনি সংশোধনের কাগজ তার হাতে পড়ল। তিনি সেটার উপর লিখলেন, “এটা কী হতে পারে? এইটা কি সত্যি সত্যি কখনোই আমার বক্তব্য ছিল না?”

বেন্থাম যখন দিস্তার পর দিস্তা লিখছেন না, তখন তিনি উদ্ভাবনের কল্পনা করতেন। যেমন তিনি পানির রাইসের মত ‘কনভার্সেশন টিউব’- এর কথা ভেবেছিলেন, যেটা দুইটা বাড়ির মাঝখানে থাকবে। তারপর ‘ফ্রিজিডেরিয়াম’ ডিজাইন করেছিলেন। এটা হলো মাংস সংরক্ষণের জন্যে একধনের ইগলু আকতির ঠাণ্ডা ঘর। ঠিক যেমন তার ‘বুলক হার্টস, কাভস’, হৃৎপিণ্ড-যকৃৎ, খরগোশ-মুরগি, স্প্র্যাটস-স্মেল্টস, ওয়েস্টার-স্যামন ইত্যাদির জন্যে।

তিনি এমনকি তার উদ্ভাবিত পৃথিবীর প্রথম প্রাইভেট জেলখানা ‘পেনোপটিকন’ এর জন্যে অনেক পরিকল্পনা এঁকেছিলেন। একদম নতুন ধরনের এই জেলখানা। চাকার আকৃতির উপর ভিত্তি করে বানানো। যেটার কেন্দ্রে ইন্সপেক্টর বসানো ছিল। কিছু প্রতিফলকের সাহায্যে ভিতরে কী হচ্ছে না হচ্ছে দেখা যেত।

এই আইডিয়া তিনি পেয়েছিলেন প্যারিসের মিলিটারি স্কুলের সিস্টেম থেকে। পেনোপটিকনের উদ্দেশ্য ছিল কম খরচের এবং অল্প জিনিস ব্যবহারে পরিচালিত জেলখানা হওয়া। এর পেছনে তিনি প্রচুর সময় এবং শ্রম দেন। বহুবছর নানা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধকল পেরিয়ে অবশেষে পার্লামেন্ট থেকে এই জেলখানার জন্যে জমি কেনার অনুমতি পান। তবে ১৮১১ সালে রাজা তাকে সেই জমির অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানান। প্রজেক্টটা সেখানেই চিরদিনের মত বন্ধ হয়ে যায়।

১৮১৩ সালে সেটার ক্ষতিপূরণ বাবদ বিপুল অর্থও দেয়া হয়। কিন্তু বেন্থাম তার উদ্ভাবনকে চোখের সামনে দেখতে চেয়েছিলেন কার্যকর হতে, সে স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার দুঃখবোধ কোনো কিছই মেটাতে পারেনি।

বেন্থামের জীবদ্দশায় পেনোপটিকন কোনো বাস্তব রুপ না পেলেও একে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ডেভেলপমেন্ট হিসাবে দেখা হয়। মিশেল ফুকো তার ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ’ বইয়ে পেনোপটিকনে আধুনিক ‘নিয়মানুবর্তী’ সমাজকাঠামোর রূপক হিসেবে দেখিয়েছেন।

পরবর্তীতে ‘Pentoville’, ‘Armagh Gaol’, ‘Eastern State Penitentiary’র মত আরো কতগুলি ভিক্টোরিয়ান জেলখানা নির্মাণে পেনোপটিকনের আইডিয়া ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি এর আইডিয়াকে ওপেন হসপিটাল ডিজাইনেও পরামর্শ করা হয়। এমনকি মডার্ন অনেক ডিজাইনই পেনোপটিকন দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে বানানো, যেমন, ‘পড্যুলার’ ডিজাইন।