খেলাধুলা নিয়ে কোনোকালেই আমার কোনো আগ্রহ ছিলো না। শুধু আমার না, আমার বাসার কারোই কোনো আগ্রহ নাই।
ঘটনা ২০১০ সালের। আমি তখন ক্লাস সেভেনে।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আশেপাশের সবখানে সারি সারি পতাকা ঝুলতেছে। আর যেদিকে যাই সেদিকেই “ওয়াকা ওয়াকা” না হয় “গিভ মি ফ্রিডম” বাজতেছে। বুঝলাম, ফুটবল বিশ্বকাপ আসছে। স্কুলে গিয়ে দেখি সব বান্ধবীরা আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল দু’দলে ভাগ হয়ে গেছে। ফুটবল নিয়ে উত্তেজনার শেষ নাই কারো।
এমনিতে আমরা কেউই কখনো পেপার-টেপার পড়ি না। কিন্তু বিশ্বকাপ আসার পর থেকে সবাই ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করার আগেই পেপার নিয়ে বসতাম! ফুটবল নিয়ে যত রকম জিনিসপত্র দেয়া থাকতো সব মুখস্থ করতাম। স্কুলে যাওয়ার পর শুরু হইতো পরীক্ষা—কে প্লেয়ারদের সম্পর্কে কত বেশি জানে! মেসির হাইট কত, রোনালদোর কয়টা গার্লফ্রেন্ড, কাকার বউ দেখতে কী রকম সব আমাদের মুখস্থ ছিল।
আমার বান্ধবীরা ড্রয়ার ঘেটে ঘেটে, মা বাবার সাথে ঘ্যান ঘ্যান করে—কোনোরকমে সবাই একটা করে ডাইরি বানায়ে ফেলছে। ডাইরির ভিতর থাকতো প্রিয় প্লেয়ারদের ছবি (পেপার কেটে কেটে নেয়া হইত) আর ছবির নিচে লিখা থাকতো বিভিন্ন রংয়ে বিভিন্ন ঢংয়ে “আই লাভ ইউ” টাইপ কথা। কয়েকজন সুন্দরী মাখন টাইপ বান্ধবী আবার অতি উৎসাহে স্কেল দিয়ে হাতের উপর কেটে কেটে প্লেয়ারদের নামের প্রথম অক্ষর লিখছিলো (বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই M, K আর R দেখা যাইতো)। আমিও মহা উৎসাহে ড্রয়ার ঘেটে ঘেটে আর্জেন্টিনার পতাকাটা বের করে, হুইল পাউডার দিয়ে ধুয়ে, পরিষ্কার করে বাসার সামনে লাগায়ে দিলাম।
রাতের বেলা বাবা এসে দেখছে বাসার সামনে আর্জেন্টিনার পতাকা। বাসার কারো সাথেই বাবার খুব একটা খাতির নাই। আমি বাবাকে কোনোরকম পাত্তা না দিয়ে মুখে মুখে কথা বলতাম। পতাকা দেখে বাবাও বুঝে গেছে যে এটা আমার কাজ। আমাকে ডেকে জিগ্যেস করছে, তুমি আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করো?
আমি বুক ফুলায়ে বলছি, হ্যাঁ।
বাবা ভুরু কুচকায়ে জিগ্যেশ করছে, কেন?
সাথে সাথে আমি কাচুমাচু হয়ে গেছি। মনে মনে বলতেছিলাম, আসলে তো কোনোটাই সাপোর্ট করি না। বাসায় আর্জেন্টিনার পতাকা ছিল তাই লাগায়ে দিছি। ব্রাজিলের থাকলে ব্রাজিলেরটা লাগাইতাম।
আমার চেহারা দেখে বাবা হেসে ফেলছে, আর্জেন্টিনার পতাকা লাগাইতে কে বলছে? ক্লাসের বান্ধবীরা?
আমি—না না আমিই লাগাইছি। আর্জেন্টিনা ভালো খেলে তাই।
বাবা—কে বলছে আর্জেন্টিনা ভালো খেলে? ভালো দল হচ্ছে জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন এগুলা। এগুলা সাপোর্ট করবা।
শুনে আমি ঠোঁট বাঁকায়ে চোখ ছোট ছোট করে বলছি, আপনি কেমনে জানেন? আপনাকে তো জীবনেও ফুটবল খেলা দেখতে দেখি নাই। সারাদিন তো খালি রেসলিং দেখেন। বাবা বিরক্ত হয়ে বলছে, ক্লাবের ফুটবল খেলা দেখি না আমি।
আমার বাবা খুবই ভীতু টাইপ লোক ছিল। কখনো যদি অনেক দূরে রাস্তায় গাড়ির টায়ারও ফাটতো তাতেই বাবা তাড়াতাড়ি বাসার দরজা জানলা বন্ধ করে দিত। আশেপাশে কোথাও একটু জোরে চেচামেচি হইলেই যে বাবা পুরাই শঙ্কিত হয়ে যাইত সেই বাবাই সারাদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমাদের পুরানো নষ্ট টিভিতে রেসলিং দেখতো! এইটা নিয়ে বাসার সবাই চুপি চুপি হাসাহাসি করলেও আমি উনার সামনেই হা হা হি হি করতাম!
ফুটবল নিয়ে যেহেতু আমি আর বাবা দুইজনেই খুব সিরিয়াস সেহেতু একদিন আমাদের দুইজনের মনে হইল একটা ভাল টিভি কেনা দরকার। এই পুরান ফালতু টিভি দিয়ে আর কত! আমি নতুন টিভি কেনার প্রস্তাব নিয়ে মা’র কাছে রান্নাঘরে গেলাম। মা তো পুরাই রেগে আগুন! “তোর বাবার যা মন চায় করুক গা। আমি কোনো টাকা পয়সা দিতে পারবো না।” সবকিছু শুনে বাবা আমাকে বলল যে উনি মাকে ম্যানেজ করবে। ম্যানেজ অবশ্য করতে পারে নাই। বাবা নিজের টাকা দিয়েই টিভি কিনে আনছিল।
বাবা আমাকে ফুটবল বিষয়ে বিভিন্ন জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা করত কিন্তু আমি সেগুলা কানে নিতাম না। বাবার প্রিয় দল ছিলো জার্মানি। আমি আর বাবা রাত জেগে খেলা দেখতাম। আর একজন আরেকজনকে শুকনা মুখে জ্ঞান দিতাম। ততদিনে বান্ধবী আর পেপারের কল্যাণে আমি মোটামুটি অনেক কিছু জানি। তবে আমার যাবতীয় জ্ঞান ওই প্লেয়ারদের প্রিয় খাবার, হাইট আর গার্লফ্রেন্ডের নামের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। তো আমি আর বাবা প্রতিদিন রাতে খাওয়া-দাওয়া করে খেলা দেখতে বসতাম। আমাদের ওই বাসাটায় অনেক মশা ছিলো। রাত জেগে খেলা দেখতে গিয়ে আমার আর বাবার মোটামুটি খবর হয়ে যাইত। তার উপর মা’র ঘ্যানঘ্যানানি তো আছেই। কোনো এক অজানা কারণে মশারা আমাকে খুব একটা কামড়ায় না। বাবা বলত, আমাকে নাকি মশারা কামড়ায় ঠিকই আমিই নাকি টের পাই না।
খেলা দেখার সময় মাঝে মাঝে কারেন্ট চলে যাইতো। তখন আমি আর বাবা একজন আরেকজনের উপর সব রাগ ঝাড়তাম! আমাদের ঝাড়াঝাড়ি শুনে মা’র ঘুম ভেঙে যেত তারপর দুই জন মিলেই মা’র গালিগালাজ শুনতাম।
যেদিন যেদিন আর্জেন্টিনার ম্যাচ থাকত ওইদিন আমি আর বাবা একটু বেশিই আয়োজন করে খেলা দেখতাম। আর্জেন্টিনা যখন গোল খাইত তখন বাবা আমার দিকে আড়চোখে তাকায়ে মুচকি মুচকি হাসত আর যখন আর্জেন্টিনা গোল দিত তখন আমি বাবার দিকে তাকায়ে মুচকি মুচকি হাসতাম। জার্মানির খেলা নিয়ে আমি অবশ্য কখনোই বাবার দিকে আড়চোখে তাকানো বা মুচকি মুচকি হাসি দেই নাই।
তারপর এলো সেই দিন—আর্জেন্টিনা বনাম জার্মানির খেলা। বাবা তো সেইরকম খুশি। আমাকে একেবারে বোল্ড আউট করে ছাড়বে সেই কনফিডেন্স নিয়ে খেলা দেখতে বসছে। আমিও জোর গলায় ডায়ালগ দিচ্ছি—গোল যখন দিয়েছি, গোল আরো দেব জার্মানিকে হারিয়ে ছাড়ব ইনশাল্লাহ! দুই গোল খাওয়ার পর মোটামুটি আমার খেলা দেখার এনার্জি শেষ। কিছুক্ষণ বাবার মুচকি হাসি দেখার পর খেলা না দেখেই উঠে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ছি। খেলা শেষ হওয়ার পর দেখি বাবা বাসার সামনে থেকে পতাকাটা খুলে নিয়ে আসছে, এই নাও যত্ন করে রাখো। আগামীবার আবার লাগাইও।
স্কুলের ব্রাজেলিয়ান বান্ধবীরা টিফিন বক্সে মিষ্টি ভরে নিয়ে আসছিল আমাদেরকে খাওয়ানোর জন্য। আমার অন্যান্য আর্জেন্টাইন বান্ধবীরা রাগে-দুঃখে ওদেরকে গালিগালাজ করলেও আমি হাসিমুখেই মিষ্টিগুলা খাইছিলাম। মিষ্টি খাওয়ার কারণে অবশ্য আমাকে আর্জেন্টাইনরা নির্লজ্জ বলে গালিগালজ দিছিল। এরপর ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার বিদায়ের পর আমরা সবাই যখন মোটামুটি খেলা বুঝে গেছি তখন সবাই স্পেন হয়ে গেছি। বান্ধবীরা সব বুঝতে পারল মেসি কিংবা কাকা না ক্যাসিয়াস আর ভিয়াই আসলে সুন্দর হ্যান্ডসাম প্লেয়ার।
ওয়ার্ল্ডকাপ শেষ হওয়ার পর আমাদের সবার খুব খুবই মন খারাপ হইছিল। কারণ এখন আবার সবাইকে পড়াশোনা শুরু করতে হবে। আমরা সবাই চোখ ছলছল করতে করতে বলাবলি করি “আগামি সপ্তাহ থেকে সেকেন্ড টার্ম পরীক্ষা—সিলেবাস কতদূর?”
এরপর অবশ্য অভ্যাস মতো কয়েকদিন রাত জেগে বাবার সাথে রেসলিং দেখার চেষ্টা করতাম! কিন্তু একদিন বাবার ধমক খাওয়ার পর এরপর দিন থেকে দশটা বাজলেই ঘুমায়ে যাওয়ার ভান করতাম।
চার বছর অনেক লম্বা সময়। কয়েকদিন আগে একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি এদিকে-সেদিকে পতাকা ঝুলতেছে। ফুটবল বিশ্বকাপ আসছে। ফেসবুক ভরে গেছে পতাকা, গালিগালাজ আর পরিসংখ্যানে। তবে এই বিশ্বকাপ যে সেই বিশ্বকাপ সেটা বুঝতে আমার মোটামুটি কষ্ট হচ্ছিল।
শাকিরার ওয়াকা ওয়াকা নাই।
কী যেন একটা থিম সং হইছে বটে কিন্তু সেটার এক দুই লাইনের বেশি আমার কানে আসে নাই।
ক্লাস সেভেন নাই।
মাখন টাইপের বান্ধবীরা নাই।
আমার আর্জেন্টিনার পতাকাটাও এই চার বছরের ঠেলায় হারায়ে গেছে।
এই বাসায় মশা নাই।
সবচেয়ে বেশি নাই যেটা সেটা হচ্ছে বাবার আর আমার ফুটবলের দিনগুলা।
মিস ইউ বাবা।