জীবনে বড় কোনো ভুল করা বা কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আমরা নিজেদের প্রতি খুব কঠিন মনোভাব ধারণ করি। যেমন, যদি আমাদের প্রথম কয়েকটি সম্পর্ক ভেঙে যায়, আমরা ধরে নিই আমাদের সারাজীবন নিঃসঙ্গ থাকবে হবে। যদি আমরা কোনো একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে চাকরি জীবনে প্রবেশের পর আবিষ্কার করি যে এই কাজটি আমাদের ভালো লাগছে না, তাহলে পুরো ব্যাপারটি আগে থেকে অনুধাবন করতে না পারার কারণে নিজেদের ব্যর্থ ভাবতে শুরু করি।


জেমস ক্লিয়ার


অথবা, কোন বই লিখতে, নন-প্রফিট কাজ করতে, বা মূল্যবান কিছু তৈরি করতে গিয়ে যদি শুরুতে হোঁচট খাই, তবে ধরে নেই যে আমাদের দিয়ে এসব ভালো কাজ করা সম্ভব নয়।

এইসব ক্ষেত্রে, অর্থাৎ যখন আমরা জটিল ও বহুমাত্রিক কোনো কাজ করতে যাই তখন ভুল করা মানে হল আসলে সঠিক কাজটি করা।

 

প্রথম সিদ্ধান্ত বনাম শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত

আমরা অনেক সময় আমাদের প্রথম সিদ্ধান্তকেই সর্বশেষ সিদ্ধান্ত ভেবে বসে থাকি। যদিও এটি খুবই স্বাভাবিক যে আপনার প্রথম সিদ্ধান্ত বা প্রচেষ্টা ত্রুটিপূর্ণ বা ভুল হতে পারে। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এই কথাটি বিশেষ ভাবে সত্যি।

যেমন, বিয়ের জন্যে সঠিক পাত্র/পাত্রী নির্বাচন করা। জীবনে প্রথম বার যে মানুষটির সাথে প্রেম করেছিলেন তার কথা মনে করুন। এই মানুষটি কি আপনার জীবন সঙ্গী হওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ছিল? একই ভাবে, আরো পিছনে ফিরে গিয়ে আপনার প্রথম ক্রাশের কথা মনে করুন। নিজের জন্য সঠিক সঙ্গী বাছাই করা খুবই জটিল। আর প্রথম চেষ্টায়ই পেয়ে যাবেন এটা ভেবে নেয়াটা অযৌক্তিক। প্রথমজনই যে শেষজন হবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।

ক্যারিয়ার বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও এই কথাগুলি সত্যি। ২২ বছরের আপনি কতটা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারবেন ৪০, ৩০ বা এমনকি ২৫ বছর বয়সে আপনার জন্যে সবচেয়ে ভালো চাকরি কী হবে? এই সময়ের মধ্যে আপনি আরো কত কিছু শিখবেন ও জানবেন তা ভেবে দেখুন।

আমাদের জীবনে আমরা অনেক পরিবর্তন ও বিকাশের স্তর পেরিয়ে আসি। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জীবনের গতিবিধি সব সহজেই নির্ধারিত হয়ে যাবে এটা ভেবে নেয়ার দরকার নেই।

একই যুক্তি প্রযোজ্য ব্যবসার বেলায়ও। আপনার প্রথম ব্যবসায়িক পরিকল্পনাই আপনার সেরা পরিকল্পনা হবে এমনটি ঘটার সুযোগ খুবই কম। এটি সম্ভবত খুব একটা ভালো পরিকল্পনাও হবে না, সেরা হওয়া তো দূরের কথা। অন্ট্রেপ্রিনিয়ার বা উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে এটাই বাস্তবতা।

সঙ্গী খোঁজা থেকে শুরু করে ক্যারিয়ার বাছাই, সব জটিল ব্যাপারেই আপনার প্রথম চেষ্টাটি আপনাকে শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিবে।

 

ভুল করা নিয়ে ৫টি শিক্ষা

আমরা যতটা ভেবে নিই, ভুল করা আসলে ততটা খারাপ কিছু নয়। আমরা সবাই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে ভুল করি বা করবো। এই ভুলের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা ৫টি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।

১.
আত্মবিশ্বাস কিংবা বুদ্ধি নয়, বরং কোন ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে নিজের ভুলগুলি বুঝতে পারাই আসলে বৃদ্ধির বা বিকাশের লক্ষণ।

এক বছর আগে নেয়া সিদ্ধান্তগুলির দিকে যদি ফিরে তাকান তাহলে দেখতে পাবেন আপনি এমন অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যা এখন বোকামি বলে মনে হচ্ছে।

এর কারণ হল আপনার বিকাশ ঘটছে। আপনি যদি একটা নিরাপত্তা বেষ্টনীতে নিজেকে আটকে রাখেন যেখানে আপনার ভুল করার কোনো সুযোগ নেই, তবে আপনি কখনোই নিজের সত্যিকারের সম্ভাবনাকে উন্মুক্ত করতে পারবেন না।

আপনি যদি প্রথম চেষ্টাতেই সেরা সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে সব জেনে ফেলেন, তাহলে আপনি নিজেকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারবেন না।

২.
যেহেতু আপনি জানেন যে আপনার প্রথম সিদ্ধান্তটি ভুল হতেই পারে, সেহেতু আপনার উচিৎ দেরি না করে কাজ শুরু করা। যত দ্রুত আপনি ভুল থেকে শিক্ষা নিতে শুরু করবেন, তত দ্রুত আপনি কোনটি সঠিক তা বুঝতে শুরু করবেন।

কারো পক্ষেই আপাদমস্তক প্রস্তুতি নিয়ে রিলেশনশিপ বা অন্ট্রেপ্রিনিয়ারশিপ শুরু করা সম্ভব নয়। তাই প্রস্তুত হওয়ার পিছনে অতিরিক্ত সময় ব্যয় না করে কাজ শুরু করে দিন। কারণ কাজের মাধ্যমেই মানুষ সবচেয়ে ভালো শিখে।

৩.
দীর্ঘ ও জটিল কাজগুলিকে ছোট ছোট সহজ কাজে ভাগ করে নিন। অনেক সময় জটিল ও সময়সাপেক্ষ কাজগুলি আয়ত্তে আনতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। কিন্তু কাজগুলিকে সহজ করে ফেলা যায় যদি সেগুলিকে আমরা ভাগ করে ফেলতে পারি।

নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী নিলস বোর একবার বলেছিলেন, “একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি তিনিই, যিনি একটি সঙ্কীর্ণ পথে যত ভুল করা যায় তার সবগুলিই করেছেন।”

৪.
নিজের প্রবৃত্তির উপর তখনই ভরসা করতে পারবেন যখন এর সপক্ষে আপনার কাছে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। ইতোমধ্যে যেসব ব্যাপারে আপনার পারদর্শিতা রয়েছে সেসব ব্যাপারে আপনি দ্রুত ও অধিকতর সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। আর অন্যান্য সকল বিষয়ে কোনটি সঠিক আর কোনটি ভুল তা যাচাই করার জন্য আপনাকে নির্ভর করতে হবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপর।

৫.
ব্যর্থ হতে পারেন কথাটার মানে এই না যে আপনি পরাজয় মেনে নিবেন বা পরাজিত হওয়ার আশা করবেন। কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এই ভয়ে হতাশাগ্রস্ত হওয়া বা হাল ছেড়ে দেয়ার কোনো মানে নেই। প্রতিবারই আপনার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করুন, কারণ আপনার প্রচেষ্টা ও প্রয়োগই শেখার প্রক্রিয়াকে চালু রাখে।

আপনি ব্যর্থ হলেও এগুলি অপরিহার্য। বুঝতে শিখুন যে ব্যর্থ হওয়ার জন্য কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না। কিন্তু যদি আপনি সঠিক হতে চান তাহলে মাঝেমধ্যে পরাজিত হতে হবে। তাই জয়ী হওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে কাজে নামুন আর নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করুন।

আপনার প্রথম সিদ্ধান্তই আপনার সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত নাও হতে পারে। তাই আত্মসমালোচনা বন্ধ করুন এবং বিকশিত হতে শুরু করুন।