আধুনিক কালে (সামাজিক) গবেষণা পদ্ধতি বলতে প্রথমেই আপনার ধরে নিতে হবে যে তেমন কোনো আপ্তজ্ঞান আপনার থাকা চলবে না। কোনো বৌদ্ধিক উপলব্ধিও থাকা চলবে না। এমনকি যাকে কমনসেন্স বলে সেটাও কম থাকলে ভাল। বা কমনসেন্স দিয়ে আগানোর ইচ্ছা না-থাকা ভাল। আপনার গবেষণা করে-করে অনুসিদ্ধান্ত বলতে হবে; উপলব্ধি বলতে হবে। আপনার তামাম অভিব্যক্তিই গবেষণালব্ধ হলে ভাল।
আপনি একজন সামাজিক গবেষক—এর থেকে আমরা কী বুঝব? আমরা বুঝব যে আপনি সামাজিক কম, এবং গবেষক বেশি। এমনকি আপনাকে অসামাজিক সাব্যস্ত করে আগালেই বরং আপনার পেশাজীবিতা সম্বন্ধে সর্বাপেক্ষা সঠিক ধারণা করা হতে পারে। এখন আপ্তজ্ঞান বা বৌদ্ধিক উপলব্ধি না থাকার বিষয়টা নিয়ে কিছু বিশদ আলাপ করা দরকার।
ধরা যাক ছাগল। আপ্তজ্ঞান থেকে বা বৌদ্ধিক উপলব্ধি থেকে বলা যেতে পারে, “সকল ছাগলের দাড়ি থাকে না।”
না, এটা না, ধরুন বলা হয়ে থাকে, “ছাগল দিয়ে হালচাষ হয় না।” আপনি সামাজিক গবেষক হলে এটা বলতে পারবেন না। না বলাই উত্তম, এমনকি না-বলাই কাঙ্ক্ষিত। (হালচাষকে সামাজিক ঘটনা হিসেবে দেখা চলবে)। আপনার বলতে হবে, “গবেষণায় দেখা গেছে, ছাগল দিয়ে হালচাষ হয় না।” এমনকি গবেষক হিসেবে আপনি যদি সত্যিই প্রতিপত্তি চান, তাহলে আপনার বলতে পারলে ভাল যে, “আমার গবেষণায় আমি যা দেখেছি, তাতে ছাগল দিয়ে হালচাষ হয় না।” তার মানে আপনার গবেষণা থাকতে হবে। হ্যাঁ আপনারই থাকতে হবে।
আমাদের আলোচ্য সামাজিক গবেষণাটিতে তাহলে জমি ছাড়াও ছাগল লাগবে। এক্ষেত্রে অন্তত দুটি প্রমাণ সাইজের ছাগল আপনার যোগাড় থাকা ভাল। তবে চারটি থাকলে আরও ভাল। ছাগলদের মতিগতি ও ক্লান্তি সম্বন্ধে যেহেতু নিশ্চিত করে আগাম কিছু বলা যায় না। আর ধরুন বিঘা চারেক জমি; সেটাও আপনার নাগালে থাকতে হবে। তো ছাগলের জনসংখ্যা নিয়ে লোকে আপনাকে নানান ধরনের শলাপরামর্শ দিতে থাকতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে, নিশ্চিত থাকুন, সামাজিক গবেষণায় নানান মাপের পপুলেশন থাকতে পারে। দুটি বা চারটি ছাগল বা মানুষও কিছু গবেষণায় যথেষ্ট রিসার্চ-পপুলেশন। সামাজিক ছাগল বিষয়ক জ্ঞান প্রকাশ করার জন্য শ’ পাঁচেক ছাগলকে গবেষণাধীন বানাতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সেটাও আরেকটা চিন্তাধারা বা স্কুল। কিন্তু দুটি-চারটি ছাগলও রিসার্চ-পপুলেশন হতে পারেন। সেই চিন্তাধারাও আছে শাস্ত্রে। কিন্তু গবেষণা থাকতেই হবে। নো আপ্তজ্ঞান। আপ্তজ্ঞান মানেই ডিডাকশন। আধুনিক গবেষণা ডিডাকশনকে প্রায় স্পেকুলেশনের মতো খারাপ করে দেখে।
তো, তারপর আপনি সেই ছাগলবৃন্দকে নিয়ে সেই জমিতে যাবেন, বুঝিয়ে সুজিয়ে। পর্যাপ্ত খাবার-দাবার সঙ্গে নেবেন। “ছাগলে কী না খায়” ভেবে নিলেও ভুল করবেন আপনি। একটা মানানসই মাপের হালও আপনার ইতোমধ্যে বানিয়ে ফেলা লাগবে।
এখানে ক্রিটিক্যাল চিন্তার লোকজনের ভাবনা সম্বন্ধেও কিছু আলাপ-আলোচনা আমাদের করে নেয়া উচিত। কিছু চিন্তক থাকবেন যাঁদের জন্য এটা বলে কোনোভাবে পার পাবেন না যে “ছাগল দিয়ে হালচাষ হয় না” কিংবা “হয়” (যেহেতু আমরা আপনার গবেষণার ফলাফলটি এখনো জানি না)। বরং তাঁরা মনে করিয়ে দেবেন কোন ধরনের জমিতে কোন ধরনের হাল দিয়ে কোন ধরনের ছাগলের সাহায্যে কী ধরনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হাসিল করতে যেয়ে হালচাষের কথিত ক্রিয়াটি হলো কিংবা হলো না। একে কনটেক্সুয়ালাইজ করা বলা হয়ে থাকে। সেজন্য মানানসই মাপের হাল বিষয়টি আরো গুরুতর হয়ে আমাদের সামনে দেখা দিচ্ছে।
এরপর আপনার আরো কিছু দুরূহ পেশাগত সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপার আছে। যেমন, আপনার গবেষণাটি কত কাল ব্যপ্ত হবে। একদিনেই সেরে ফেলতে চান, নাকি ভিন্ন ভিন্ন দিন ছাগলের উপযোগিতা (ও আগ্রহ/নিষ্ঠা – হ্যাঁ হ্যাঁ ছাগলের কথাই হচ্ছে, আপনার নয়) ভিন্ন হতে পারে এমন একটা অনুমান/রিসার্চ-এজাম্পশন পরখ করে দেখতে চান সেটা একটা সিদ্ধান্তের বিষয়। আরেকটা সিদ্ধান্তের বিষয় হলো সরেজমিন গবেষণার স্বার্থে আপনি নিজেই হালদার হবেন কিনা, নাকি চাষীটাষী বলে যে লোকজন পাওয়া যায় তাঁদের ভাড়া নিয়ে আপনার গবেষণা করবেন। তো সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে শুরু করলেন। ছাগলের কাঁধে হাল জুড়ে জমিতে নামিয়ে, নিজে বা চাষীসাহায্যে, আপনার গবেষণা হলো, একদিন বা কয়েক দিন।
ছাগলের নিরন্তর চঞ্চলমতি, লাগাতার ব্যা-করণ, অনিয়ন্ত্রিত প্রক্ষালন-অভ্যাস, বেহিসাবী ক্ষুধা ইত্যাদি নানান কারণই হয়তো আপনার আবিষ্কৃত হতে থাকবে হালচাষে এদের অযোগ্যতা বিষয়ে। কিংবা হয়তো চূড়ান্ত হিসাবে, জমি ও ছাগলের তুলনামূলক আয়তন বিচারে আপনি ছাগলের হালচালে অযোগ্যতা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন। সেটাও আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। এমনকি, এটাও হতে পারে যে, আপনি আসলে অপরাপর কোনো পশুজাতির তুলনায় ছাগলকে অযোগ্য সাব্যস্ত করলেন। ওই যে ক্রিটিক্যাল বা রিলেটিভ জ্ঞানের বিষয়।
মোট কথা হলো, সামাজিক গবেষণার জগতে আমরা চাই যে, সামাজিক জ্ঞান পূর্বধারণামূলক বৌদ্ধিক উপলব্ধি বা আপ্তজ্ঞান বা এমনকি কমনসেন্সের শাসনে না থাকুক। এটা হয়ে উঠুক স্বাধীন, সার্বভৌম ও মুহূর্মুহূ পুনঃপুনঃ লাগাতার নিরন্তর পরীক্ষা বা তদন্ত-নির্ভর। আধুনিক কালে মোটের উপর সামাজিক গবেষণা সেই কাজটাই করে থাকে।
আদাবর, ১৪ আগস্ট ২০২০
প্রচ্ছদে মানস চৌধুরীর ছবি, চিত্রগ্রাহক শাহরিয়ার শাকিল শুভ