প্রযুক্তির স্বর্গরাজ্য খ্যাত সিলিকন ভ্যালিতে এখন অমরত্বের বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে। বড় বড় প্রযুক্তি শিল্পের অনেক বড় বড় নাম মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্যে এবং দীর্ঘায়ু লাভের জন্য প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছেন।

স্মার্টফোনের অপারেটিং সিস্টেমকে আপগ্রেড করে যেভাবে ফোনটিকে পুনরায় সচল করা হয় ঠিক সেভাবেই দীর্ঘায়ু লাভের কোনো পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে চাইছেন তারা।


এমিলি উইলিংহাম
সায়েন্টিফিক আমেরিকান, ২৫ মে ২০২১


তথাপি যদি মৃত্যুকে হ্যাক করা না যায় এবং দীর্ঘায়ুর সর্বদাই একটা সীমা থেকে যায়, আমরা যাই করি না কেন তখন কী হবে?

ভাগ্যক্রম এবং বংশগতির সমন্বয়ে যদি আমরা ক্যান্সার, হৃদরোগ বা বাসের ধাক্কায় মারা না যাই তবে আমরা কতদিন বাঁচতে পারব এই প্রশ্নটি নিয়ে এখন গবেষকরা চিন্তা করছেন।

তারা জানান যে, আমরা যদি মারাত্মক কোনো রোগে আক্রান্ত না হই বা দুর্ঘটনায় মারা না যাই এবং পুরোপুরি সুস্থ-স্বাভাবিকভাবেও জীবন-যাপন করতে পারি তাও আমাদের আয়ু সর্বোচ্চ ১২০ থেকে ১৫০ বছর হবে। এর বেশি আমাদের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।

কারণ সময়ের সাথে সাথে আমাদের শরীরও ক্ষয়ে যায় এবং আমাদের বিপাক প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে। গত ২৫ মে নেচার কমিউনিকেশনস-এ প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে এমনটাই জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ এজিং অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট-এর পরিচালক হিদার হুইটসন বলেন, “তারা এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করছেন যে ‘যদি সব কিছু সত্যিকার অর্থেই ভালো চলে, এবং একটি চাপমুক্ত পরিবেশে থাকে তাহলে মানুষের দীর্ঘতম আয়ু কত হতে পারে?’” তিনি অবশ্য এই গবেষণা দলে ছিলেন না। তিনি আরো বলেন, এই গবেষণায় মানুষের অন্তর্নিহিত “বুড়িয়ে যাওয়ার স্বাভাবিক গতি” ধরা পড়েছে যা মানুষের জীবনকালকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয় এবং মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।

সিঙ্গাপুর ভিত্তিক কোম্পানি গেরো-র গবেষক টিমোথি পিরকভ এবং তাঁর সহকর্মীরা এই গবেষণার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং রাশিয়ার তিন দল মানুষের উপর “বুড়িয়ে যাওয়ার গতি” পর্যবেক্ষণ করেন। স্থিতিশীল স্বাস্থ্য থেকে বিচ্যুতিগুলি মূল্যায়নের জন্য, তারা তাদের রক্তে কোষের সংখ্যায় পরিবর্তন এবং প্রতিদিন কত কদম হাঁটা হচ্ছে তাজীবন হিসাব রাখেন এবং বয়সভেদে তাদের বিশ্লেষণ করেন।

তাদের গবেষণায় দেখা যায়, রক্তকণিকা এবং হাঁটাচলার পরিমাণ উভয় ক্ষেত্রেই প্যাটার্নটি একই। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কোনো রোগ ছাড়াই অজানা কারণে একটা সময়ের পরে গিয়ে শরীরের রক্তে কোষের সংখ্যা কমে যেতে থাকে এবং চলাফেরার গতিও ধীর হয়ে আসে। আর কোনো মারাত্মক রোগ না হলে এবং বুড়িয়ে যাওয়ার এই স্বাভাবিক গতি স্থিতিশীল থাকলে একজন মানুষ সর্বোচ্চ ১২০ থেকে ১৫০ বছর পর্যন্ত আয়ু পেতে পারেন।

এ যাবতকালের রেকর্ড অনুযায়ী পৃথিবীর সর্বকালের সর্বাধিক বয়স্ক ব্যক্তি ছিলেন ফ্রান্সের জেন ক্যামো। যিনি ১৯৯৭ সালে ১২২ বছর ১৬৪ দিন বয়সে মারা গেছেন। [এ বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে। সে অনুসারে জেন ক্যামো সম্ভবত ১৯৩৪ এ মারা গিয়েছিলেন। এবং পরে নিজের পরিচয় গোপন করে মায়ের পরিচয় গ্রহণ করেন তার মেয়ে।  – সম্পাদক, সাম্প্রতিক]

Jeanne Louise Calment (১৮৭৫-১৯৯৭)

গবেষকরা আরও জানতে পেরেছেন যে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরের ক্ষয়-ক্ষতি সেরে উঠতেও ক্রমবর্ধমান হারে বেশি সময় লাগতে থাকে। হুইটসন বলেন যে, এই ফলাফলটা বোধগম্যই। একজন সুস্থ-স্বাভাবিক তরুণ ব্যক্তি সহজেই শারীরিক ক্ষয়-ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য দ্রুত শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু একজন বয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রে “সবকিছু একটু দুর্বল হয়ে যায়, শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া কিছুটা ধীর হয়ে আসে এবং এমনকি অকেজো হয়ে পড়ে”, যেমন কোনো অসুস্থতা যখন রক্তচাপে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে।

রক্তচাপ এবং রক্তকোষের সংখ্যার পরিমাপের মতো পরিমাপগুলির একটি সুস্থ পরিসীমা রয়েছে। অন্যদিকে, হুইটসন উল্লেখ করেন, কোন বয়সে কে কত কদম হাঁটছেন তা অত্যন্ত ব্যক্তিগত বিষয়। পিরকভ এবং তাঁর সহকর্মীরা এমন একটি ভ্যারিয়েবল বেছে নিয়েছিলেন যা রক্তকোষের সংখ্যার থেকে একদমই আলাদা এবং তা স্বত্ত্বেও সময়ের সাথে সাথে তা একই ক্ষয় আবিষ্কার করেছে। যা থেকে বোঝা যায়, মানবদেহের বিভিন্ন এলাকায় বুড়িয়ে যাওয়ার একটি বাস্তব প্রক্রিয়া সবসময়ই চলমান থাকে।

এই গবেষণার সহকারি গবেষক পিটার ফেদিচেভ, যিনি একজন প্রশিক্ষিত পদার্থবিজ্ঞানী এবং গেরোর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, তিনি বলেন যে, “যদিও বেশিরভাগ জীববিজ্ঞানী রক্তকোষের সংখ্যা এবং পদক্ষেপের সংখ্যাকে ‘বেশ আলাদা’ হিসাবেই দেখেন, তথাপি উভয়ই ‘একই চিত্র উপস্থাপন করে’ যা থেকে বোঝা যায়, বুড়িয়ে যাওয়ার এই গতি একটি বাস্তব ঘটনা।“

গবেষকরা তাদের আবিষ্কারের সমর্থনে কিছু সামাজিক ঘটনার উদাহরণও দেন। পিরকভ বলেন, “আমরা ৩৫ থেকে ৪০ বছর বয়সে লোকের মধ্যে একটা খাড়া বাঁক দেখতে পাই, যেটি বেশ অবাক করা।“ উদাহরণস্বরূপ, তিনি উল্লেখ করেন, এই বয়সটা প্রায়ই এমন সময় যখন একজন অ্যাথলেটের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়, একটা লক্ষণ যে এই বয়সে শারীরিক কিছু একটা আসলেই বদলাচ্ছে যা থেকে বোঝা যায় যে, “এই বয়সে পৌঁছার পর মানব দেহে হয়তো সত্যিই বড় কোনো পরিবর্তন ঘটে যায়।”

মানুষের অমরত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষা বহু পুরোনো। মৃত্যু সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পর থেকেই হয়তো মানুষ অমরত্ব লাভের উপায় সন্ধান শুরু করে। শিকাগোর ইলিনয় ইউনিভার্সিটির এপিডেমিওলজি এবং বায়োস্ট্যাটিসটিক্স বিভাগের অধ্যাপক এস. জ্যায় ওলশানস্কি বলেন, তবে দীর্ঘায়ু জীবন আর দীর্ঘকালীন সুস্বাস্থ্য এক জিনিস নয়। তিনি বলেন, “আমাদেরকে বেশি দিন বাঁচার দিকে নয় বরং আরও বেশি স্বাস্থ্যবান জীবনযাপনের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।“

হুইটসন বলেন, “মৃত্যুই কেবল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। জীবনযাত্রার মানের মতো বিষয়গুলিও ক্রমাগত আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কারণ এসবের জন্যে লোকে ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে।“ তিনি বলেন, এই গবেষণায় যে দীর্ঘায়ু জীবনের কথা বলা হয়েছে তাতে মৃত্যুটা হবে এক “চূড়ান্ত দীর্ঘায়িত মৃত্যু। কিন্তু প্রশ্ন হল, লোকে মৃত্যুর আগে যে ভঙ্গুর অবস্থার মধ্য দিয়ে যায় সেই সময়টা না বাড়িয়েই কি আমরা আয়ু বাড়াতে পারব?” অর্থাৎ একটা সুস্থ-স্বাভাবিক দীর্ঘায়ু কি সম্ভব?

ওলশানস্কি বলেন, গবেষকদের “চূড়ান্ত উপসংহারটি বেশ আকর্ষণীয়।“ তিনি জিনিসটাকে চিহ্নিত করেন এভাবে, “বলুন তো কী? দীর্ঘমেয়াদে করা চিকিৎসা এমন প্রভাব তৈরি করবে না যেটা হয়ত আপনি চান করুক। বয়স হওয়ার এই মৌলিক জৈবিক প্রক্রিয়াগুলি চলতে থাকবে।“ অর্থাৎ একে থামানোর কোনো উপায় নেই।

বুড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটিকে ধীর করার ধারণাটি কেবল সিলিকন ভ্যালির যারা তাদের স্মৃতি কম্পিউটারে আপলোড করার স্বপ্ন দেখেন তাদেরই নয়, বরং এমন গবেষকদেরও মনোযোগ কেড়েছে, যারা এই ধরনের হস্তক্ষেপকে “রোগকে সংক্ষিপ্ত” করার উপায় হিসাবে দেখেন। যাতে জীবনের শেষ সময়টাতে অসুস্থতা এবং দুর্বলতা কমানো যায় এবং সুস্বাস্থ্যের ব্যাপ্তি বাড়ানো যায়।

ন্যাচার কমিউনিকেশনে প্রকাশিত গবেষণায় মানুষের বয়সের যে সর্বোচ্চ সীমার কথা বলা হয়েছে, তার ওপর এটি কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা তা এখনো অনুমানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে কিছু গবেষণা চালানো হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ডায়াবেটিসের ওষুধ মেটফরমিন নিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে, ওষুধটিকে বুড়িয়ে যাওয়ার নির্দেশক সূচকগুলি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ব্যবহার করা যায় কিনা।

এরই ধারাবাহিকতায় ফেদিচেভ এবং তার দলও মানব জীবনের সর্বাধিক আয়ু সম্পর্কে তাদের অনুমানের বিষয়ে উৎসাহ বোধ করেন। তার দৃষ্টিভঙ্গি হল তাদের গবেষণাটি দীর্ঘ এক যাত্রার সূচনা করেছে মাত্র। ফেদিচেভ বলেন, “কোনো কিছুর পরিমাপ করা হল সেই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার প্রথম পদক্ষেপ।” এখন পরবর্তী পদক্ষেপটি হবে “স্থিতিস্থাপকতার ক্ষয়কে বাধা দেওয়ার” তথা বুড়িয়ে যাওয়ার গতিকে ধীর করার উপায় খুঁজে বের করা।

অনুবাদ: মাহবুবুল আলম তারেক