‘ডিমরফোস’ নামের একটি গ্রহাণুর সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটাবে মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা; এর মাধ্যমে পৃথিবীর সাথে গ্রহাণু বা ধূমকেতুর সংঘর্ষের আশঙ্কা এড়ানোর সম্ভাবনা যাচাই করা হবে

আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নাসা’র কর্মকর্তারা জেনেশুনেই একটি গ্রহাণুর সাথে তাদের ৩৩০ মিলিয়ন ডলারের একটি রোবট মহাকাশযানের সংঘর্ষ ঘটাবে। ‘ডিমরফোস’ নামের গ্রহাণুর সাথে সংঘর্ষ হওয়ার পরে ‘ডার্ট’ নামের এই মহাকাশযানটি ধ্বংস হয়ে যাবে। এবং সংঘর্ষের সময় প্রায় অর্ধেক টন ওজনের এই মহাকাশযানের গতি থাকবে সেকেন্ডে চার মাইলেরও বেশি।


রবিন ম্যাকি
দি গার্ডিয়ান, সেপ্টেম্বর ৩, ২০২২


মহাকাশযানটির নামের মতো নাসার এই মিশনের নামও ‘ডার্ট’ (Dart), যার পূর্ণরূপ হলো ‘ডাবল অ্যাস্টেরয়েড রিডাইরেকশন টেস্ট’।

শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও আত্মঘাতী এই মিশনের লক্ষ্য খুবই সাধারণ। পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষ হতে পারে, এমন কোনো গ্রহাণু বা ধূমকেতু পাওয়া গেলে সেগুলির গতিপথ কীভাবে পাল্টে ফেলা যাবে, তা বোঝার চেষ্টা করবেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। এজন্য ‘ডার্ট’ মহাকাশযানের সংঘর্ষের ফলে ‘ডিমরফোস’ গ্রহাণুর কক্ষপথে কী পরিবর্তন আসে, তা পর্যবেক্ষণ করবেন গবেষকরা। তাদের মতে, পর্যবেক্ষণের এই তথ্য কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর সঙ্গে ধূমকেতুর বড় ধরনের কোনো সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিলে কীভাবে মহাকাশযান আমাদেরকে রক্ষা করতে পারবে, সে ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে।

মহাকাশযানের ধাক্কায় গ্রহাণুর কক্ষপথ বদল—নতুন পরীক্ষায় নাসা
ডিমরফস (Dimorphos) এবং ডিডিমোস (Didymos) ধূমকেতুর দিকে ছুটতে থাকা ‘ডার্ট’ নামের নাসার মহাকাশযানটির কল্পিত একটি চিত্র। ছবি: নাসা/জনস হপকিন্স এপিএল (অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স ল্যাবরেটরি) 

উত্তর আয়ারল্যান্ডে অবস্থিত ‘কুইন্স ইউনিভার্সিটি বেলফাস্ট’ এর জ্যোতির্বিজ্ঞানী অধ্যাপক অ্যালান ফিটজসিমন্স বলেন, “আমরা জানি, অতীতে ধূমকেতু আমাদের আঘাত করেছে। এ ধরনের সংঘর্ষ একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া এবং ভবিষ্যতেও এমন ঘটবে। আমরা শুধু এ ধরনের সবচেয়ে খারাপ ঘটনার আশঙ্কা এড়াতে চাই। সমস্যা হলো, এ ধরনের কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি নিয়ে আমরা এর আগে কখনো পরীক্ষা করিনি। আর এটাই ‘ডার্ট’ এর উদ্দেশ্য।”

‘ডার্ট’ মিশনের সাথে যুক্ত বিজ্ঞানী দলের অন্যতম একজন সদস্য ফিটজসিমন্স।

গত নভেম্বরে উৎক্ষেপিত ডার্ট মহাকাশযানটি ‘ব্রিটিশ সামার টাইম (BST)’ টাইমজোন অনুসারে ২৭ সেপ্টেম্বরের শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গ্রহাণুটিতে আঘাত করবে। সংঘর্ষের পরে ধূমকেতুর কক্ষপথ সতর্কভাবে গবেষণা করবেন বিজ্ঞানীরা। তাদের বিশ্বাস, পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা গ্রহাণু বা ধূমকেতুর কক্ষপথ বিচ্যুত করতে এ ধরনের সংঘর্ষ কীভাবে কাজে লাগানো যাবে, তা আরো ভালভাবে বোঝা যাবে এ মিশনের মাধ্যমে।

আরো পড়ুন: বিজ্ঞান বিষয়ে যে ১০টি ভুল ধারণা বেশ জনপ্রিয়

যুক্তরাজ্যের ‘পোউইস’ কাউন্টির ‘নাইটন’ শহরে অবস্থিত ‘ন্যাশনাল নিয়ার আর্থ অবজেক্টস ইনফরমেশন সেন্টার’। এই সেন্টারের পরিচালক জে টেট বলেন, “ডার্ট এর টার্গেট খুব সাবধানে বেছে নেয়া হয়েছে। ‘ডিমরফোস’ আসলে ‘ডিডিমোস’ নামের আরেকটি বড় গ্রহাণুকে প্রদক্ষিণ করে। আর এই সংঘর্ষের ফলে যেই বিচ্যুতির সৃষ্টি হবে, তার মাত্রা শনাক্ত করাও সহজ হবে। কারণ জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বড় গ্রহাণুটির চারপাশে এর [‘ডিমরফোস’ এর] কক্ষপথটি খুব সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।”

অতীতে গ্রহাণু এবং ধূমকেতুর আঘাতের ফলে পৃথিবীর জীবজগতে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছিল। সবচেয়ে বিখ্যাত সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটেছিল ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে। সে সময় ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বিশাল এক গ্রহাণু বর্তমান মেক্সিকোর ‘ইউকাতান’ উপদ্বীপের ‘চিক্সুলুব’ অঞ্চলে আঘাত হেনেছিল। সংঘর্ষের ফলে এমন এক বিস্ফোরণ হয়েছিল, যার শক্তি ছিল কয়েক বিলিয়ন পারমাণবিক বোমার সমান। এর ফলে সে সময় পৃথিবীতে থাকা উদ্ভিদ ও প্রাণীর সকল প্রজাতির মধ্যে ৭৫ শতাংশই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সেই ঘটনায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল ভূমিতে বাস করা সকল প্রজাতির ডাইনোসর।

আধুনিক সময়ে গ্রহাণু বা ধূমকেতুর আঘাতের ফলে যেভাবে বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ ঘটতে পারে, তার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ‘ডোন্ট লুক আপ’ (২০২১), ‘আর্মাগেডন’ (১৯৯৮) এবং ‘ডিপ ইমপ্যাক্ট’ (১৯৯৮) এর মতো চলচ্চিত্রগুলিতে। তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, অদূর ভবিষ্যতে এ ধরনের বিপর্যয়ের ঘটনা বাস্তবে ঘটার আশঙ্কা খুবই কম।

মহাকাশযানের ধাক্কায় গ্রহাণুর কক্ষপথ বদল—নতুন পরীক্ষায় নাসা
‘ডোন্ট লুক আপ’ (২০২১) ছবিতে লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও ও জেনিফার লরেন্স, দুই জ্যোতির্বিজ্ঞানীর চরিত্রে। তারা পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা একটি ধূমকেতু সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করার চেষ্টা করে।

অ্যালান ফিটজসিমন্স এর মতে, “আমরা জানি কোথায় বড় আকারের ধূমকেতুগুলি রয়েছে, কারণ আমাদের বর্তমান প্রজন্মের টেলিস্কোপ দিয়েই আমরা সেগুলি দেখতে পারছি। আর আমরা এও জানি যে, শনাক্ত করা এসব ধূমকেতুর কোনোটাই অন্তত আগামী প্রায় কয়েকশো বছরের মধ্যে আমাদের গ্রহের কাছাকাছি কোথাও আসছে না। তাই সেগুলির [শনাক্ত করা ধূমকেতু] ব্যাপারে আমরা সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকতে পারি।

“তবে ছোট ছোট অনেকগুলি [ধূমকেতু] এখনো শনাক্ত করা যায়নি। এগুলি একটা গোটা শহর ধ্বংস করতে এবং বিশাল এলাকা বিধ্বস্ত করে ফেলার মতো যথেষ্ট বড়। সময়ের সাথে সাথে আরো নির্ভুলভাবে অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের এসব বস্তুগুলি [ধূমকেতু] আমরা মানচিত্রের মধ্যে আনছি। তবে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে এমন কোনো কিছু যদি আমরা খুঁজে পাই, তাহলে সেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এ ধরনের হুমকি মোকাবেলার জন্য যে আমাদের কাছে সঠিক প্রযুক্তি আছে, তা নিশ্চিত করার প্রথম ধাপ হলো ডার্ট।”

মহাকাশযানের ধাক্কায় গ্রহাণুর কক্ষপথ বদল—নতুন পরীক্ষায় নাসা
নাসার ‘ডাবল অ্যাস্টরয়েড রিডাইরেকশন টেস্ট’, বা ডার্ট মিশন মহাকাশযানের সাথে একটি গ্রহাণুর সংঘর্ষ ঘটাবে এবং এর কক্ষপথের বিচ্যুতি পরিমাপ করবে।

এই বিষয়টার সাথে নাসার ‘গ্রহ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা’ বা ‘প্ল্যানেটারি ডিফেন্স অফিসার’ লিন্ডলে জনসনও একমত। তার মতে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ ধরনের গ্রহাণুর পথবিচ্যুতি করার প্রযুক্তি উন্নত করে তোলা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, “আমরা এমন পরিস্থিতিতে পড়তে চাই না, যখন একটি গ্রহাণু পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে আর তখনই আমাদের এ ধরনের [কক্ষপথের বিচ্যুতি করার] সামর্থ্য আছে কিনা, তা পরীক্ষা করতে হচ্ছে।”

ছোট গ্রহাণু বা ধূমকেতু থেকে আসা সম্ভাব্য বিপদের একটি উদাহরণ নিকট অতীতেই পাওয়া যাবে। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার ‘চেলিয়াবিনস্ক’ শহরের কাছেই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে একটা পাথুরে বস্তু প্রবেশ করে। ধারণা করা হয় এর ব্যাস ছিল ২০ মিটার। বস্তুটি বায়ুমণ্ডলেই বিস্ফোরিত হয়। ফলে প্রায় ৪০০ কিলোটনের এক বিস্ফোরণ ঘটে। এই ঘটনায় ১,৫০০ জনেরও বেশি লোক আহত হয়।

টেট বলেন, “বস্তুটা যদি আর মাত্র ২০ কিলোমিটার উত্তর দিক দিয়ে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করত, তাহলে সেটা শহরের অনেক বেশি ক্ষতি করত। আমরা খুব ভাগ্যবান যে, সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে এই ধরনের ঘটনার ফলে যথেষ্ট হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। তবে আমাদের সচেতন হতে হবে যে, এ ধরনের ঘটনা একদিন ঘটবে, এবং সেই পরিস্থিতিতে কিছু করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।”

মহাকাশযানের ধাক্কায় গ্রহাণুর কক্ষপথ বদল—নতুন পরীক্ষায় নাসা
১৯৯৮ সালে মুক্তি পাওয়া পরিচালক ‘মিমি লিডার’ এর সিনেমা ‘ডিপ ইমপ্যাক্ট’ এর একটি দৃশ্য, যেখানে দেখা যাচ্ছে ঢেউয়ের এক জোয়ার নিউ ইয়র্কে আঘাত করছে। সিনেমাটির কাহিনীতে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা সাঙ্ঘাতিক এক ধূমকেতুর গল্প বলা হয়েছে।

‘ডার্ট’ এর লক্ষ্য যেই ‘ডিমরফোস’ ধূমকেতু, সেটার ব্যাস ১৬০ মিটার। এই ধূমকেতু প্রতি ১২ ঘণ্টায় এর মূল গ্রহাণু ‘ডিডিমোস’কে একবার প্রদক্ষিণ করে। সংঘর্ষের ১০ দিন আগে মহাকাশযান থেকে পার্স ব্যাগ আকারের একটি প্রোব বের হবে। ইতালিতে নির্মিত এই প্রোবের নাম লিশাকিউব (LiciaCube)। এতে দুটি ক্যামেরা সংযুক্ত রয়েছে। ‘স্টার ওয়ার্স’ এর জুটি ল্যুক এবং লেয়া’র (Luke; Leia) নামেই এই ক্যামেরা দুটির নাম দেয়া হয়েছে। ‘ডার্ট’ এর সঙ্গে গ্রহাণুর সংঘর্ষের চিত্র রেকর্ড করবে ল্যুক এবং লেয়া, এবং সেসব চিত্র পৃথিবীতে অবস্থিত গ্রাউন্ড কন্ট্রোলারে পাঠাবে।

এরপর পৃথিবীর ভূমিতে থাকা একাধিক টেলিস্কোপের মাধ্যমে ধূমকেতুটির দিকে নজর রাখা হবে। এবং কীভাবে এর কক্ষপথ পরিবর্তন হয়েছে, সেটা সূক্ষ্মভাবে চিহ্নিত করা হবে। টেট বলেন, “এভাবেই [পৃথিবীর দিকে] আসতে থাকা গ্রহাণু বা ধূমকেতুগুলি বিচ্যুত করা কতটা সহজ হবে, সে বিষয়ে ধারণা পাব আমরা।”

এছাড়াও ২০২৪ সালে উৎক্ষেপণ করা হবে হেরা (Hera) নামের একটি রোবট মহাকাশযান। ‘ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি’র এই মহাকাশযান ‘ডিমরফোস’ এর বুকে ‘ডার্ট’ এর সাথে সংঘর্ষের ফলে তৈরি হওয়া গর্তটি নিয়ে গবেষণা করবে। সেই মিশনে এই সংঘর্ষের ব্যাপারে নতুনভাবে বিশ্লেষণ করা হবে।

আরো পড়ুন: ৭,২০০ মাইল দূর থেকে পৃথিবীকে ঘিরে আছে অদৃশ্য শক্তিবলয়

ফিটজসিমন্স এর মতে, “ডিমরফোসকে আঘাত করা সহজ হবে না। এর ব্যাস মাত্র ১৬০ মিটার এবং মহাকাশযানটি সেকেন্ডে চার মাইল বেগে ছুটতে থাকবে। ধূমকেতুর যেখানে আঘাত করলে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে, সেটা হলো এর কেন্দ্র। আর ঠিক সেখানে আঘাত করতে হলে ডার্ট এর সাথে যুক্ত স্বয়ংক্রিয় নেভিগেশন ডিভাইসগুলির চরম পরীক্ষা দিতে হবে।

“নাসা’র প্রকৌশলী এবং বিজ্ঞানীরা অসাধারণ একটা কাজ করেছেন। এবং তারা নিশ্চিত যে, ডার্ট মিশন অবশ্যই কাজ করবে। কিন্তু কোনো কাজ শেষ না করা পর্যন্ত আপনি সত্যিই সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারবেন না।”

অনুবাদ: ফারহান মাসউদ