আপনি কি কখনো দৈনন্দিন জীবন নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে যান যে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যগুলির কথা ভাবার সময়ই পান না? দৈনন্দিন জীবনের নানারকম ব্যস্ততার মাঝে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যগুলির কোনো তাৎক্ষণিক কিংবা দ্রুত ফলাফল দেখতে না পেলে এর ওপর মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে যায়। এর পেছনে একটি কারণ হচ্ছে, আমাদের সমাজ সবকিছুর তাৎক্ষণিক ফলাফল দেখতে চায়।

আমরা সবকিছুই কম সময়ে পেয়ে অভ্যস্ত। মাইক্রোওয়েভ করা খাবার, ফাস্টফুড, এমনকি সিনেমার ক্ষেত্রেও দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রথমে ছোট কিছু ক্লিপ দেখানো হয়। কারণ দীর্ঘসময় মনোযোগ ধরে রাখা বেশ কঠিন হয়ে গেছে। ব্লগ পোস্ট ও ইন্টারনেট আর্টিকেল ‘বিশেষজ্ঞরা’ লেখা সহজ রাখার পরামর্শ দেন, যাতে সহজেই চোখ বুলিয়ে নেয়া যায়। কারণ আমরা কোনো কিছুতেই বেশি সময় দিতে চাই না। আমাদের কোনো তথ্যের প্রয়োজন হলে তা সাথে সাথেই খুঁজে পাই। আমরা যা যখন জানতে চাই তারই তাৎক্ষণিক অ্যাক্সেস আছে, যেহেতু আমাদের হাতে সবসময়ই স্মার্টফোন থাকে।

তাই, দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যের দিকে মনোযোগ দেয়াটা বেশ কঠিন হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নিজেদের মনোযোগ কীভাবে আমরা ধরে রাখবো, কীভাবে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে “আমার এটা এখনই লাগবে” এমন মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসবো?

এই সমস্যার সমাধানে এই ৭টি টিপস কাজে লাগাতে পারেন।

১. দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যগুলিকে ছোট পরিমাপযোগ্য লক্ষ্যে ভাগ করে নিন
যখনই বড় কোনো লক্ষ্য নিয়ে কাজ করবেন, আপনার প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে সেই কাজকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে নেয়া। যাতে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে কাজ করতে পারেন।

যেমন ধরুন, আপনার লক্ষ্য হচ্ছে ঘরে বসেই একটি সফল বিজনেস পরিচালনা করা, যাতে যথেষ্ট টাকা উপার্জন করতে পারেন। এই লক্ষ্যে সফল হওয়ার জন্য একে ছোট ছোট, সহজে করা যাবে, এমন কাজে ভাগ করে নিন।

এই বিষয়ে একটি প্রচলিত কৌতুক আছে: একটি হাতি কীভাবে খাবেন? উত্তর হচ্ছে: ছোট ছোট টুকরা করে। বড় বড় লক্ষ্যগুলি অর্জনেও এই দর্শনকে কাজে লাগাতে হবে।

আপনার দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য যদি হয় বাসায় থেকেই বিজনেস করা, তাহলে সেটিকে ছোট ছোট কয়েকটি লক্ষ্যে ভাগ করে নিন।

প্রথমেই কী ধরনের বিজনেস করতে চান তা ঠিক করুন। তারপরের ধাপ হচ্ছে সেই বিজনেস নিয়ে রিসার্চ করা। রিসার্চ করার পর, ধরুন, আপনি নিজের লাভজনক ব্লগ খুলতে চান। তারপর আপনার লক্ষ্য হবে একটি ব্লগ হোস্টিং কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করা। অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন, মূল লক্ষ্যটিকে ছোট ছোট ভাগ করে নিয়ে, প্রতিদিনই কিছু না কিছু কাজ করা।

বড় লক্ষ্যকে ছোট ছোট ভাগ করে নিলে আপনি সেই ছোট লক্ষ্যগুলি অর্জন করে কাজের অগ্রগতি দেখতে পারবেন। ফলে কাজে লেগে থাকার অনুপ্রেরণা পাবেন।

২. ফলাফল না, কাজের প্রক্রিয়ার দিকে মনোযোগ দিন
ফলাফলের পরিবর্তে কাজটি কীভাবে করা হচ্ছে তাতে মনোযোগ দিলে আমরা তাৎক্ষণিক পরিবর্তন দেখতে পাবো।

ধরুন, আপনার লক্ষ্য ওজন কমিয়ে ফিট থাকা। আপনি দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন জিমে গেলেন। শুরুতে আপনি ঠিকভাবে পুল আপ করতে পারতেন না, হাত ব্যাথা করতো। তবে, দুই সপ্তাহ শেষে আপনি কিন্তু সহজেই কোনোরকম ব্যাথা ছাড়াই পুল আপ করতে পারবেন।

ফলে নিজের লক্ষ্যে অটুট থাকার প্রেরণা পাবেন, কারণ এই প্রক্রিয়া যে কাজ করছে তা আপনি নিজ চোখেই দেখছেন।

সপ্তাহে ৩ দিন নিয়ম করে জিমে যাওয়ার দিকে মনোযোগ দিলে, প্রতিবার আগের চেয়ে কিছুটা শক্তিশালী হওয়ার দিকে মনোযোগ দিলে, আপনি নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে কাজ করে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাবেন।

এই বিষয়টি যেকোনো লক্ষ্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

সাজানো গোছানো পরিপাটি বাসা চাইলে, সপ্তাহের শেষে যদি আলমারিটি গোছানো হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু আপনি নিজের লক্ষ্যের দিকে এক ধাপ এগিয়ে গেলেন।

নিজের ব্লগ শুরু করুন, প্রথম মাসে ১০০০০ পেজ ভিউ না পেলে হতাশ না হয়ে ভাল মানের লেখালেখি করার দিকে মনোযোগ দিন। কীভাবে কাজ করা হচ্ছে সে প্রক্রিয়ার দিকে মনোযোগ দিলে এর অগ্রগতি দেখা যায় ও আমরা লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কাজ করতে অনুপ্রেরণা পাই।

৩. ছোট ছোট অর্জনের দিকে মনোযোগ দিন
আগেই বলেছি, নিজের লক্ষ্যকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে নিলে আপনি ছোট ছোট অনেক লক্ষ্য অর্জন করতে পারবেন। বড় লক্ষ্যের বদলে সেই ছোট ছোট লক্ষ্যগুলির দিকে মনোযোগ দিন। এই ছোট ছোট অর্জনগুলি আপনাকে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যে সাফল্য এনে দিবে।

ধরুন, আপনার মূল লক্ষ্য শরীরকে ফিট করা। আপনি জিমে গেলেন ও পুল আপ বারে ঝুলে থাকলেন। এটি একটি অর্জন। সপ্তাহ শেষে আপনি পুল আপ বারে নিজেকে অর্ধেক টেনে তুলতে পারেন, হাতে আর ব্যথা হয় না। এটি আরেকটি অর্জন।

এভাবেই ছোট ছোট অর্জনের হাত ধরে আপনি নিজের মূল লক্ষ্যে পৌঁছাবেন।

৪. ছোট ছোট লক্ষ্যকে ভিত্তি করে কাজ করুন
সপ্তাহের শুরুতে নতুন লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করুন। তাহলে সপ্তাহ শেষে আপনি পেছনের দিকে তাকিয়ে কেমন কাজ করেছেন তা দেখতে পাবেন। আর সেই অনুযায়ী ওইভাবেই কাজ চালিয়ে যাবেন নাকি ছোটখাটো পরিবর্তন আনতে হবে তা বুঝতে পারবেন।

আরো পড়ুন: নিজের দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজে পাওয়া

আবার জিমের উদাহরণটিই দেই। এই শুক্রবারে আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে এ সপ্তাহে ৩ বার জিমে যাবেন। সপ্তাহ শেষে দেখুন ৩ বার জিমে গিয়েছেন কিনা। যদি গিয়ে থাকেন, তাহলে এবার পরবর্তী ধাপের দিকে মনোযোগ দিন। আপনার নতুন লক্ষ্য হচ্ছে কারো সাহায্য ছাড়াই একটি পুল আপ করা। অন্যদিকে, যদি সপ্তাহে ৩ বার জিমে যাওয়ার সময় করতে না পারেন, তাহলে সপ্তাহে ২ বার জিমে যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করুন।

নিজের লক্ষ্যকে পুনঃমূল্যায়ন করার মাধ্যমে আপনি লক্ষ্যে পৌঁছনোর সেরা উপায়টি খুঁজে পাবেন।

ছোট লক্ষ্যগুলিকে ভিত্তি হিসেবে ধরে কাজ করুন, তাহলে বড় লক্ষ্যগুলিতে পৌঁছানো সহজ হবে, কাজের উৎসাহ ও গতিবেগ ধরে রাখতে পারবেন।

৫. আপনার প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত কিনা তা নিশ্চিত করুন
ছোট লক্ষ্যগুলিকে ভিত্তি করে কাজ করা ও সপ্তাহ শেষে তা মূল্যায়ন করার আরেকটি সুবিধা আছে। নিয়মিত নিজের লক্ষ্য মূল্যায়ন করলে আপনার লক্ষ্যগুলি বাস্তবসম্মত কিনা তা বুঝতে পারবেন।

অল্প সময়ের মধ্যেই লক্ষ্য অর্জনের আগ্রহ হারিয়ে ফেলার একটি কারণ হচ্ছে অবাস্তব ও সহজে অর্জন করা যাবে না এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করা।

আপনি এক মাসে ২৫ কেজি ওজন কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দুই সপ্তাহ পর দেখলেন আপনার ওজন মাত্র ৫ কেজি কমেছে। এই পর্যায়ে এসে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা স্বাভাবিক। একমাসে ২৫ কেজি ওজন কমানো অনেকের জন্যই রীতিমতো অসম্ভব। তাই এরকম অবাস্তব লক্ষ্য নির্ধারণ করা থেকে বিরত থাকুন।

উৎসাহ হারানো ও ব্যর্থতার অনুভূতি এড়ানোর জন্য আপনাকে লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

৬. ধারাবাহিকতা বজায় রাখুন
যেকোনো লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা অনেক জরুরি। যদি নিয়মিত নিজের লক্ষ্য অর্জনে কাজ না করেন, তাহলে আপনি ব্যর্থ হবেন।

নিজের লক্ষ্য অর্জনের সাথে সম্পর্কিত অন্তত একটি কাজ প্রতিদিন করার চেষ্টা করুন। এমনভাবে নিজের শিডিউল তৈরি করুন যাতে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করার সময় ও সুযোগ পান। প্রতিদিন কিংবা সপ্তাহে তিন দিন অথবা সপ্তাহে কমপক্ষে একবার নিজের লক্ষ্যের সাথে সম্পর্কিত কাজ করুন। লক্ষ্যে পৌঁছানোর আসল উপায় হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে ও নিয়মিত কাজ করা।

আরো পড়ুন: লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে নিজেই যেভাবে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন

আবারও ওজন কমানোর উদাহরণেই ফিরে যাই। আপনি দুপুরে সালাদ ও রাতে বড় এক বাটি আইসক্রিম খেয়ে ওজন কমানোর আশা করতে পারেন না।

রাতে আইসক্রিম খাচ্ছেন মানে আপনি নিজের লক্ষ্য অর্জনে ধারাবাহিকতা বজায় রাখছেন না। ভালো ফলাফল পাওয়ার জন্য নিয়মিত ও ধারাবাহিকভাবে লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে যেতে হবে।

ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য প্ল্যানার ব্যবহার করতে পারেন। প্রতি মাসে বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে মাসিক প্ল্যান তৈরি করুন, তাহলে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য অর্জনের দিকে মনোযোগ দিতে পারবেন।

৭. জবাবদিহি করুন
আমরা অনেকেই হার মানতে একদমই পছন্দ করি না। তাই অন্যদের নিজের লক্ষ্য সম্পর্কে জানান, আপনি কী করছেন তা বলুন ও তাদের কাছে নিয়মিত জবাবদিহিতা করুন।

কেউ যখন নিয়মিত আপনার কাজের অগ্রগতির কথা জানতে চাইবে, তখন আপনার সেই কাজ নিয়মিত করার সম্ভাবনাও বাড়বে। অন্যকে নিজের লক্ষ্য সম্পর্কে বলা ও তাদের কাছে জবাবদিহি করা আসলে কাজে উৎসাহ পাওয়ার দারুণ একটি উপায়।

তাছাড়া নিজের কাজের দায়ভার নিয়ে ও অন্যের কাছে এ বিষয়ে জবাবদিহিতা করলে নিজের লক্ষ্যের প্রতি মনোযোগ ধরে রাখা সহজ হয়। অন্যেরা যখন আপনার কাজের খোঁজখবর নেবে, তখন আপনি নিজের ফোকাস ধরে রাখবেন। কাজ না করার বিভিন্ন অজুহাতকেও একপাশে সরিয়ে রাখতে পারবেন।

নিজের লক্ষ্যকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে, কাজের প্রক্রিয়ার ওপর গুরুত্ব দেবেন, ছোট ছোট অর্জনগুলির ওপর মনোযোগ দেবেন, আপনি নিজের ফোকাস ধরে রাখতে পারবেন।

এক এক করে লক্ষ্য পূরণ করে, নিজের লক্ষ্যকে মূল্যায়ন করে, ধারাবাহিকভাবে কাজ করে, জবাবদিহিতা করে আপনি নিজের মূল লক্ষ্যটি অর্জন করতে পারবেন।