ভারতীয় নার্স নিমিশা প্রিয়া ইয়েমেনের কারাগারে মৃত্যুদণ্ডের প্রহর গুনতেছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ২০১৭ সালে ইয়েমেনি নাগরিক তালাল আবদু মাহদিকে হত্যা করছেন।

ঘটনাপ্রবাহে মনে হয়, নিমিশার মৃত্যুদণ্ড হয়ত ঠেকানো যাবে না। তবে নিমিশা প্রিয়ার পরিবার ও “সেভ নিমিশা প্রিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশন কাউন্সিল” এবং ভারত সরকার জোর চেষ্টা চালাইতেছে।

ঘটনার সূত্রপাত ও নিমিশার দাবি
নিমিশার বাড়ি ইন্ডিয়ার কেরালা রাজ্যের পালক্কাড় জেলার কোলেঙ্গোড-এ। তিনি ২০০৮ সালে নার্সের চাকরি লইয়া ইয়েমেনের রাজধানী সানার একটা সরকারি হাসপাতালে কাজ শুরু করেন। দীর্ঘদিন সেখানে চাকরি করেন তিনি।

২০১৪ সালে হুথি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানা দখল কইরা নিলে ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং দেশে চরম মানবিক সংকট দেখা দেয়। হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়ে এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংকট চরমে ওঠে।


ব্রাত্য রাইসু


গৃহযুদ্ধের মধ্যে সংসারের খরচ চালানো কঠিন হইয়া পড়ে। নিমিশা স্বামী টমি থমাস আর কন্যা মিশেলরে ইন্ডিয়ায় ফিরত পাঠান। নিজে থাইকা যান সানায়, নিজের একটা ক্লিনিক খুলবেন, এই আশায়।

ইয়েমেনি আইনের ধারায় বিদেশী কোনো নাগরিক যদি সেইখানে ব্যবসা করতে চায়, তাইলে তার একজন ইয়েমেনি অংশীদার লাগবে। এই সূত্রেই যোগাযোগ ঘটে তালাল আবদু মাহদির সঙ্গে।

তালাল নিমিশারে ক্লিনিক খুলতে সাহায্য করবেন, কথা দেন। ২০১৫ সালে তারা দুইজন একটা ক্লিনিক খোলেন। নাম আল আমান মেডিকেল ক্লিনিক। ইয়েমেনেও এই ধরনের ছোট ক্লিনিকগুলিতে সাধারণ অসুস্থতার চিকিৎসা, ড্রেসিং, ইনজেকশন, ছোটখাটো পরীক্ষা-নিরীক্ষা এইসব করা হয়।

নিমিশা প্রিয়ার দ্বারা নিহত ইয়েমেনের নাগরিক তালাল আবদু মাহদি

যুদ্ধাবস্থার কারণে ক্লিনিক ভালই চলতেছিল। এই সময় নিমিশা তার ব্যবসায়িক পার্টনার তালাল আবদু মাহদিরে নিজের দেশ দেখাইতে একসঙ্গে কেরালায় যান। উদ্দেশ্য ছিল মেয়ের ব্যাপটিজম অনুষ্ঠান। নিমিশার স্বামী টমি থমাস বিবিসিরে জানাইছেন, তালাল যখন তাদের বাড়িতে আসছিলেন, তখন তারে খুবই সজ্জন ব্যক্তি মনে হইছিল।

হয়রানি ও হত্যাকাণ্ড
নিমিশা ও তালাল ইয়েমেনে ফিরা আসেন। নিমিশার কথা অনুসারে এরপরই তালালের আসল রূপ তার সামনে প্রকাশিত হইতে থাকে।

নিমিশা প্রিয়ার অভিযোগ অনুযায়ী, তালাল আবদু মাহদি তারে বিভিন্ন ধরনের হয়রানি করতেন। নিমিশা দাবি করছেন যে তালাল তার পাসপোর্ট জব্দ কইরা রাখছিলেন, যে কারণে উনি দেশেও ফিরতে পারতেছিলেন না। নিমিশা এক প্রকার তালালের হাতে বন্দি হইয়া পড়েন।

এছাড়াও, তালাল যৌথ ক্লিনিকের টাকাপয়সা মাইরা দিতেছিলেন এবং নিমিশার পাওনা অংশের টাকাও দিতে চাইতেন না। এ সময় তিনি নিমিশারে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতে আরম্ভ করেন। এমনকি তারে মাদক সেবনেও বাধ্য করতেন বইলা অভিযোগ আছে। তালাল তার বন্ধুবান্ধব নিয়া মদের আড্ডা বসাইতেন নিমিশার বাসায়। নিমিশা মাঝে মাঝেই তখন নিজ বাসা ছাইড়া রাস্তায় পালাইতেন। উল্লেখ্য, ইয়েমেনে নারীদের জন্যে রাতে রাস্তায় বাইর হওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক। তবে এই পলায়নও সব সময় সম্ভব হইত না।

সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগগুলির একটা হইল, তালাল আইনি কাগজপত্রে নিমিশা প্রিয়ারে নিজের স্ত্রী হিসাবে মিথ্যা পরিচয় দিতেন। যে কারণে পুলিশের সাহায্যও নিমিশা পান নাই। কিছু রিপোর্টে বলা হইছে যে, তালাল নিমিশার জীবননাশের হুমকিও দিতেন।

নিমিশার কথা অনুসারে, তিনি তালালরে ঘুমের ইনজেকশন দিয়া অজ্ঞান করছিলেন পাসপোর্ট উদ্ধার করতে পারবেন এই আশায়। কিন্তু দুর্ঘটনাক্রমে তাতে তালালের মৃত্যু হয়।

মুফতি মুসলিয়ার এর শেষ চেষ্টা
২০২০ সালে সানা’র একটা ট্রায়াল কোর্ট নিমিশা প্রিয়ারে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ২০২৩ সালে তার আপিল খারিজ হওয়ার পর, হুথি-নিযুক্ত প্রেসিডেন্ট মাহদি আল-মাশাত তার মৃত্যুদণ্ডে অনুমোদন দেন। এরপর ভারত সরকার ইরানি কূটনীতিকদের সাহায্য লইয়া দণ্ড মওকুফের চেষ্টা কইরা আসতেছিল।

শেষমেশ নিমিশার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার কথা আছিল ১৬ জুলাই ২০২৫, মানে আজকে। নতুন ভাবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এবং ধর্মীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে এইটা স্থগিত করা গেছে। তবে আশঙ্কা কাটে নাই।

মুফতি মুসলিয়ার: ভারতের দশম এবং বর্তমান গ্র্যান্ড মুফতি

শেখ আবু বকর আহমদ, যিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কান্থাপুরম এ. পি. আবু বকর মুসলিয়ার নামে পরিচিত, বর্তমানে ভারতের দশম এবং বর্তমান গ্র্যান্ড মুফতি। তিনি অল ইন্ডিয়া সুন্নি জমিয়াতুল উলামা (ভারতীয় মুসলিম স্কলারস অ্যাসোসিয়েশন)-এর সাধারণ সম্পাদক এবং সামাষ্ঠা কেরালা জম-ইয়াতুল উলামা (এপি সুন্নীস)-এর সাধারণ সম্পাদক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করতেছেন।

মুফতি মুসলিয়ার নিমিশা প্রিয়ার মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেছেন। তিনি ইয়েমেনের ধর্মীয় নেতা এবং নিহত তালালের পরিবারের সঙ্গে “ব্লাড মানি” নিয়া আলোচনায় মধ্যস্থতা করছেন। তার প্রচেষ্টার ফলেই প্রাথমিকভাবে ১৬ জুলাই, ২০২৫-এ নির্ধারিত মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করা সম্ভব হইছে।

নিমিশা প্রিয়ার পরিবার এবং “সেভ নিমিশা প্রিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশন কাউন্সিল” তালালের পরিবারের কাছে ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার “ব্লাড মানি” প্রস্তাব করছে।

তবে, তালালের পরিবার এখনও এই প্রস্তাব গ্রহণ করে নাই। কিছু সূত্র বলতেছে, তালালের পরিবার এই অর্থ গ্রহণ করতে রাজিই না, তারা চায় নিহত তালালের সম্মান এবং নিমিশা প্রিয়ার মৃত্যুদণ্ড।

ইয়েমেনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পদ্ধতি
ইয়েমেনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার একমাত্র পরিচিত পদ্ধতি হইল গুলি কইরা মারা। যদিও দেশটার আইন অনুযায়ী পাথর ছুঁইড়া, ফাঁসিতে ঝুলাইয়া এবং শিরশ্ছেদ কইরাও মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের করার বিধান রইছে, তবে এখন আর এগুলি ব্যবহার করা হয় না।

মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সময়, সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীরে একটা কার্পেট বা কম্বলের উপরে উপুড় কইরা শোয়ানো হয়। এরপর একজন ডাক্তার আসেন। তিনি সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির হৃদপিণ্ডের সোজাসুজি পিঠের জায়গায় একটা চিহ্ন আঁইকা দেন। পরে, একজন জল্লাদ স্বয়ংক্রিয় রাইফেল দিয়া সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির পিঠের চিহ্নিত স্থানে বেশ কয়েকটা গুলি করেন। লক্ষ্য থাকে হৃদপিণ্ডে আঘাত করা। কিছু ক্ষেত্রে, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বেত্রাঘাতও করা হয়। ইয়েমেনে অপ্রকাশ্য ও প্রকাশ্যে উভয় প্রকার মৃত্যুদণ্ডই অনুমোদিত।

বিয়ের ছবির অ্যালবাম হাতে নিমিশার স্বামী টমি থমাস

তাইলে এখন কী হবে?
ইরানরে দিয়া যে ইরানের ভ্রাতৃপ্রতিম ইয়েমিনি হুথিদেরকে চাপ দিবে ভারত, সেই অবস্থাও নাই। ইসরাইল-ইরান সংঘাতের সময় ইরানের ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) ইসরাইলের হইয়া গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ১৩ জন ভারতীয় নাগরিকসহ মোট ৭৩ জনরে গ্রেপ্তার করছিল। এই ঘটনার পরে ভারতের অনুরোধ ইরান কী কারণে রাখবে সেইটা একটা জরুরী প্রশ্ন।

ইসরাইল যদি ইরান আক্রমণ না করত, তাইলে হয়ত নিমিশা প্রিয়ার শাস্তি অন্য রকম হইতে পারত, বা তিনি মুক্তিও পাইতে পারতেন।

আমাদের প্রত্যেকের জীবন যে অনেকখানিই আন্তর্জাতিক রাজনীতি দিয়া নিয়ন্ত্রিত হয়, তা আরেকবার বোঝা গেল নিমিশা প্রিয়ার জীবনের করুণ প্রায় সমাপ্তির এই ঘটনায়।

১৬/৭/২০২৫, ঢাকা