অনেক বিতর্ক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে সংঘটিত হয়েছিল প্রথম বিশ্বকাপ

এই সবকিছুর শুরুটা হয় যখন আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (IOC) ঘোষণা করে, ১৯৩২ সালের অলিম্পিক গেমসে রাখা হবে না ফুটবলকে, কারণ  অলিম্পিকের আয়োজক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবল তেমন জনপ্রিয় না!


মার্সিও কস্তা


ফিফা এই বর্জনের সাথে একমত হয়নি, তারা ফুটবলকে পেশাদার খেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল।

জুলে রিমে (১৮৭৩-১৯৫৬)

১৯২৮ সালে ফিফার সে সময়কার প্রেসিডেন্ট স্বপ্নদ্রষ্টা জুলে রিমে ঘোষণা দেন, অলিম্পিক এর মতই প্রতি ৪ বছর পর পর তারা অন্য একটি টুর্নামেন্টের আয়োজন করবেন, বিশেষ করে ফুটবলের জন্যেই থাকবে সেই আয়োজন। এই আয়োজনই পরে বিশ্বকাপ ফুটবলে রূপ নেয়।

৫টি প্রার্থী দেশের মধ্যে ফিফা প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য উরুগুয়ের রাজধানী শহর মোন্তেভিদেও’কে বেছে নেয়।

এই পছন্দটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা ছিল না। ১৯২৮ সালে জুলে রিমে যখন টুর্নামেন্টের ঘোষণা দেন সেটি ছিল উরুগুয়ের স্বাধীনতার শতবর্ষ। উরুগুয়ে (স্পেনীয় ভাষায়উরুগুয়াই) দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের দেশ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মধ্যকার একটি দেশ। ১৯ শতকের শুরু পর্যন্ত উরুগুয়ে ছিল স্পেনীয় সাম্রাজ্যের অংশ। পরে কিছুদিন পর্তুগিজদের অধীনেও ছিল দেশটি। সর্বশেষ ১৮২৮ সালে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে।

শতবর্ষের বিবেচনাটি ছাড়াও উরুগুয়ের জাতীয় দল শেষ দুটি অলিম্পিকে ফুটবল শিরোপাও জিতেছিল।

তবে সব রকমের আনুষ্ঠানিকতা সত্ত্বেও, এই সিদ্ধান্ত ইভেন্টের সংগঠনে কিছু সমস্যা তৈরি করেছিল।

দক্ষিণ আমেরিকার দেশ উরুগুয়েকে বেছে নেয়ায় যাতায়াত খরচ ও দূরত্বের কারণে বেশ কয়েকটি দেশ প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়ে।

এটা মনে রাখা দরকার যে, ফুটবল তখনও অপেশাদার একটা খেলা ছিল, সেসময় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ পায়নি ফুটবল।

এভাবেই, নকআউট ম্যাচ ছাড়াই ইভেন্টে মোট ১৩টি দল অংশগ্রহণ করে। ইউরোপ থেকে ৪টি দেশ (ফ্রান্স, বেলজিয়াম, রোমানিয়া ও যুগোস্লাভিয়া), ৭টি দক্ষিণ আমেরিকা থেকে (ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে, চিলি এবং পেরু) এবং ২টি দেশ উত্তর আমেরিকা থেকে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো)।

১৯৩০ সালের ভয়ানক শীতে, ১৩ থেকে ৩০ জুলাই, প্রথম বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়। দলগুলি ৪টি গ্রুপে বিভক্ত ছিল। যার মধ্যে আর্জেন্টিনা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, উরুগুয়ে ও যুগোস্লাভিয়া সেমিফাইনালে খেলার জন্য উত্তীর্ণ হয়।

পোসিটোস স্টেডিয়ামে মেক্সিকোর বিপক্ষে ১৯ মিনিটে বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম গোলটি করেন ফ্রান্সের লুসিয়ে লঁরো।

প্রথম বিশ্বকাপের শেষটা হয়েছিল ৩০ জুলাই, মোন্তেভিদেওর কিংবদন্তী সেন্তেনারিয়ো স্টেডিয়ামে।

ফাইনালে আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে তাদের ১৯২৮ এর গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের ফুটবল সংঘর্ষের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছিল এখানে। এই ম্যাচে উরুগুয়ে ন্যাশনাল ফুটবল টিম ২-১ গোলে জয়লাভ করে।

তবে ফাইনালের আগে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটে।

ফাইনালিস্ট দল দুটি একমত হতে পারেনি যে শেষ ম্যাচ ঠিক কে শুরু করবে, আর তাতে কোন বল ব্যবহার করা হবে। এই দ্বন্দ্ব ম্যাচে ফেডারেশনকে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য করেছিল। ফেডারেশন সিদ্ধান্ত দেয়, আর্জেন্টিনা শুরু করবে ম্যাচ এবং প্রথমার্ধে তারা বল সরবরাহ করবে। দ্বিতীয়ার্ধে উরুগুইয়ানরা বল সরবরাহ করবে এবং ম্যাচ শুরু করবে।

উরুগুয়ে ও আর্জেন্টিনার মধ্যকার বিশ্বকাপের প্রথম ফাইনাল শুরুর কিছুক্ষণ আগে

ম্যাচের সময় মৃত্যুর হুমকি পাওয়া সত্ত্বেও আর্জেন্টিনার হয়ে ফাইনালে খেলেছিলেন লুইস মন্টি (১৯০১-১৯৮৩)।

রেফারি ছিলেন বেলজিয়ামের জন ল্যাঞ্জেনাস। ম্যাচের কয়েক ঘণ্টা আগে তার জীবনের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার শর্তে রেফারি হতে রাজি হন তিনি।

তার অনুরোধের মধ্যে একটা ছিল, শেষ বাঁশি বাজার এক ঘণ্টার মধ্যে বন্দরে একটি নৌকা প্রস্তুত রাখতে হবে, যদি কোনো কারণে তার দ্রুত সেখান থেকে সরে পড়ার প্রয়োজন দেখা দেয়।

পাবলো দোরাদোর লো শটের মাধ্যমে প্রথম গোলটি করে উরুগুয়ে।

৮ মিনিট পর ফেরেইরার কাছ থেকে পাস পেয়ে কার্লো পিউসেল গোল করে ম্যাচ টাই করেন।

হাফ টাইমের ঠিক আগে, টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা গিজেরমো স্তাবিলে আর্জেন্টিনার হয়ে গোল করে ম্যাচের স্কোর (২-১) ঘুরিয়ে দেন।

উরুগুয়ের ক্যাপ্টেন হোজে নাসাজি দাবি করেন, স্তাবিলে অফসাইড ছিল। রেফারি তবুও গোলটি বহাল রাখেন।

দ্বিতীয়ার্ধে খেলায় মেতে ওঠে উরুগুয়ে। আর্জেন্টিনা লিড নেওয়ার প্রায় কিছুক্ষণ পরেই উরুগুয়ে পাল্টা আক্রমণ করে। হোসে পেদ্রো সিয়ে ম্যাচকে আবার ২-২ এ সমতায় আনেন।

১০ মিনিট পর সান্তো ইরিয়ার্তে গোল করে খেলাকে উরুগুয়ের পক্ষে ফিরিয়ে আনেন।

মোন্তেভিদেও’র সেন্তেনারিয়ো স্টেডিয়ামের দৃশ্য, যেখানে ১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপ ফাইনাল সংঘটিত হয়েছিল।

ম্যাচ শেষ হওয়ার ঠিক আগে, হেক্টর কাস্ত্রো উরুগুয়ের হয়ে শেষ গোলটি করে ৪-২ স্কোর দিয়ে ম্যাচ শেষ করেন।

৯৩ হাজার মানুষের ভিড় ও ৪-২ স্কোরের সাথে, প্রথম বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ান হয় উরুগুয়ে এবং অর্জন করে নেয় বিখ্যাত জুলে রিমে কাপ।

পরের দিন উরুগুয়েতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। অন্যদিকে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেসে জনতা উরুগুয়ের দূতাবাসে পাথর ছুঁড়ে মারে।

ফ্রান্সিসকো ভারালো, যিনি আর্জেন্টিনার হয়ে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলেছিলেন, প্রথম বিশ্বকাপের বেঁচে থাকা শেষ খেলোয়াড়, ২০১০ এর ৩০ আগস্ট ১০০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

৮ গোল করে, গিজেরমো স্তাবিলে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন।

উরুগুয়ে হয়েছিল গ্র্যান্ড চ্যাম্পিয়ন, আর্জেন্টিনা ছিল দ্বিতীয় স্থানে, যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয়, যুগোস্লাভিয়া চতুর্থ, চিলি পঞ্চম এবং ব্রাজিল ছিল ষষ্ঠ অবস্থানে।