এর মধ্যে তরুণী ইন্দিরার প্রতি ফিরোজের মুগ্ধতা তৈরি হয় এবং তিনি ইন্দিরাকে প্রেম নিবেদন করেন। যদিও ইন্দিরা তাকে প্রত্যাখান করেন। সে সময় ইন্দিরার বয়স ছিল মাত্র ১৬।

ভারতীয়দের জীবনে নেহরু-গান্ধী পরিবারের প্রভাব, বিশেষ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, প্রকল্প ও স্থানের নামকরণে এই পরিবারের সদস্যদের প্রাধান্য দেয়ার বিষয়টি সমালোচকের দৃষ্টি এড়ায়নি। বিখ্যাত এই পরিবারকে অনেক সময় সংক্ষেপে ‘দ্য ডাইনাস্টি’ নামেও ডাকা হয়।

অবশ্য ভারতের রাজনীতিতে নেহরু-গান্ধী পরিবারের মত দীর্ঘ সময় ধরে প্রভাব বিস্তারকারী পরিবারের সংখ্যা কম না। আর নেহরু-গান্ধীদের মত সেসব পরিবারেরও একই রকম সমালোচনা করা হয়।

ফিরোজ: দ্য ফরগটেন গান্ধী
ফিরোজ: দ্য ফরগটেন গান্ধী, বার্টিল ফক, পাবলিশার: রলি বুকস, প্রকাশ: ১৯/১০/২০১৬, হার্ডব্যাক, পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৩৩৬, দাম: RS. 695.00

তবে নেহরু-গান্ধী পরিবারের সবাই যে মানুষের কাছে সমানভাবে পরিচিত, তা কিন্তু নয়। আরো সঠিকভাবে বলা যায়, এই পরিবারের এমন অনেকে আছে, যাদের ব্যাপারে তেমন কিছু জানা যায় না। এমনকি, এই পরিবারের গান্ধী বংশের ধারা যার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল, তাকে খুব বেশি মানুষ মনে রাখেনি।


ফিরোজ গান্ধী—ইতিহাসের ছায়ায় হারিয়ে যাওয়া একটি নাম

সিদ্ধার্থ ভাটিয়া
ডেকান ক্রনিকল, ৯ এপ্রিল ২০১৭


ফিরোজ গান্ধী হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যার নাম ইতিহাসের ছায়ায় হারিয়ে গেছে। নেহরু-গান্ধী পরিবারের ঐতিহ্যের সুদীর্ঘ গল্পে তার নামটি কেবল ফুটনোট হিসেবে স্থান পায়।

সুইডিশ সাংবাদিক বার্টিল ফক তার ‘ফিরোজ: দ্য ফরগটেন গান্ধী’ বইয়ের মাধ্যমে ফিরোজ গান্ধীকে আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন।

প্রকাশকের মতে, ফক বইটি লিখতে গিয়ে ৪০ বছর গবেষণা করেছেন। এ সময় তিনি অসংখ্য মানুষের সাথে সরাসরি কথা বলেছেন, যারা ফিরোজ গান্ধীকে চিনতেন।

ফক তার বইয়ে কেবল ফিরোজের প্রাপ্তবয়স্ক সময়ের কথা লেখেননি, বরং তার শিশুকাল নিয়েও গভীর অনুসন্ধান চালিয়েছেন। এর মধ্যে ফিরোজের “বিতর্কিত জন্ম” নিয়ে প্রচলিত গুজবের বিষয়টিও উঠে এসেছে।

ফিরোজ গান্ধীর জন্ম সংক্রান্ত এই বিতর্কই বইটি নিয়ে মানুষের আগ্রহ জন্মানোর জন্য যথেষ্ট। (আমি অবশ্য এ বিষয়ে বেশি কথা বলব না। তবে এতটুকু বলে রাখতে পারি ফিরোজের মাতাপিতার পরিচয় নিয়ে আসলেই কিছু রহস্য ছিল। বইটি সেই রহস্য সমাধান করেনি, কিন্তু তাতে খুব বেশি কিছু আসে-যায় না।—রিভিউ লেখক)

আমরা ফিরোজ গান্ধীকে নিয়ে আসলে কী জানি? খুব বেশি কিছু না। আমরা জানি যে ফিরোজ ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর স্বামী এবং তাদের রাজীব এবং সঞ্জয় নামে দুই পুত্র ছিল।

আমরা আরো জানি, জীবনের কোনো একটা পর্যায়ে এসে ফিরোজ ও ইন্দিরা দম্পতির মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। আর যারা রাজনীতি নিয়ে খোঁজখবর রাখেন, তারা হয়ত বলবেন ফিরোজ কংগ্রেস সদস্য হয়েও সরকারের গলায় একটা কাঁটার মত বিঁধে ছিলেন।

প্রতিনিয়তই তিনি পার্লামেন্টে বিব্রতকর প্রশ্ন তুলতেন, ফাঁস করে দিতেন বিভিন্ন কেলেঙ্কারির খবর। লেখক ফক তাই ফিরোজের নাম দেন “ভিআইপি”, যার পূর্ণরূপ “ভেরি ইনভেস্টিগেটিভ পার্লামেন্টারিয়ান”। বাংলায় এর অর্থ দাঁড়ায় “অতি কৌতূহলী সংসদ সদস্য”।

এছাড়াও ফিরোজের জীবনের অন্যান্য বিষয় নিয়েও আলোচনা করেন ফক। একজন রিপোর্টার হওয়ার সুবাদে তিনি ফিরোজের অতীত ইতিহাস খুঁজে বের করেন, যখন ফিরোজ এলাহাবাদ ও ব্রিটেনে ছিলেন। বইটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ সম্ভবত এটিই ছিল। এখান থেকে আমরা জানতে পারি ফিরোজ ছিলেন প্রথম দিককার একজন জাতীয়তাবাদী। তিনি কেবল মিছিলে অংশ নিতেন না, বরং অনেক স্থানে নেতৃত্ব দিতেন। সে সময় নেহরুর পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলেন ফিরোজ, বিশেষ করে ইন্দিরার মা কমলার সাথে।

এলাহাবাদ তখন ছিল “অসহযোগ আন্দোলনের কেন্দ্র”। ফিরোজ সেখানে, অন্যান্য অনেকের মতই যথেষ্ট উৎসাহের সাথে এই আন্দোলনে যোগ দেন এবং কারাবরণ করেন। একই সময়ে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মত আরো অনেকে জেল খাটেন।

এর মধ্যে তরুণী ইন্দিরার প্রতি ফিরোজের মুগ্ধতা তৈরি হয় এবং তিনি ইন্দিরাকে প্রেম নিবেদন করেন। যদিও ইন্দিরা তাকে প্রত্যাখান করেন। সে সময় ইন্দিরার বয়স ছিল মাত্র ১৬। ফিরোজের প্রেমের বিষয়টি ইন্দিরার পরিবারও বেশি গুরুত্ব দেয়নি।

ঘটনাক্রমে সেই সময় ইন্দিরাকে আরো একজন গুণমুগ্ধ প্রেম নিবেদন করেন। ফলে এভাবে যুগপৎ প্রেমের প্রস্তাব পাওয়ার বিষয়টি বেশ কিছুদিন ইন্দিরার পরিবারে একটা কৌতুকের বিষয় হয়ে ছিল। প্রেমের প্রস্তাব দেয়া অন্য আরেকজনের তুলনায় ফিরোজকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি ইন্দিরার পরিবার। কমলা নেহরু একে ছেলেমানুষী প্রেম হিসেবেই দেখতেন।

ফিরোজ: দ্য ফরগটেন গান্ধী
১৯৪২ সালে এলাহাবাদে ইন্দিরা এবং ফিরোজের অনাড়ম্বর বিবাহ অনুষ্ঠান। এই বিয়ে নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর কাছে চিঠি লিখেও অনেকে আপত্তি জানিয়েছিলেন।

তবে শেষ পর্যন্ত ১৯৪২ সালে ইন্দিরা এবং ফিরোজ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই বিয়ের ব্যাপারে শুরুতে জওহরলাল নেহরুর সায় ছিল না। তবে শেষ পর্যন্ত এলাহাবাদে বসবাসকারী গোঁড়া হিন্দু এবং অল্প সংখ্যক পারসিদের আপত্তি সত্ত্বেও তিনি রাজী হন।

অনেকে বিষয়টি নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর কাছে চিঠি লিখেও অভিযোগ জানান। গান্ধী তখন ‘হরিজন পত্রিকা’ চালাতেন। তবে ফক এর মতে, যারা আপত্তি তুলেছিলেন, তাদের সমস্যা ছিল ফিরোজের ধর্ম নিয়ে। ব্যক্তি ফিরোজকে নিয়ে তাদের কোনো অভিযোগ ছিল না।

ফিরোজ এরপর সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি প্রথমে ছিলেন ন্যাশনাল হেরাল্ড পত্রিকায়। এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিল কংগ্রেস। এরপর ফিরোজ কাজ শুরু করেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায়। এই সময় ফিরোজ লম্পট হিসেবে কিছুটা দুর্নাম কামান।

ফিরোজের সাথে অন্য নারীদের, এমনকি বিবাহিত নারীদের সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে ফক তার বইয়ে আলোচনা করেন। স্বাভাবিকভাবে ফিরোজের এই প্রবণতা তার দাম্পত্য জীবনে ফাটল ধরিয়েছিল।

অন্য আরেক কারণেও ফিরোজ বেশ আলোচনার জন্ম দেন। অনেক বছর পার্লামেন্টে নীরব থাকার পর অবশেষে ফিরোজ সরব হয়ে ওঠেন। তিনি লোকসভায় তার প্রথম ভাষণে টানা প্রায় দুই ঘণ্টা কথা বলেন। সেই বক্তৃতায় ‘ভারত ইনস্যুরেন্স কোম্পানি’র জালিয়াতির কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দেন।

এই কোম্পানির মালিকানা ছিল ডালমিয়া-জৈন গ্রুপের হাতে। এর ফলে ইনস্যুরেন্স কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ ডালমিয়ার জেল হয়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে পরিবর্তন আসে, সেটা হচ্ছে ভারত সরকার ইনস্যুরেন্স ব্যবসা জাতীয়করণ করে ফেলে। একজন সমাজতন্ত্রবাদী হিসেবে ফিরোজ অনেক দিকে ধরে এর পক্ষে কথা বলে আসছিলেন।

ফক নিজে যে নেহরুদের খুব একটা পছন্দ করতেন, তা বলা যায় না। এই ধারণা বিভিন্নভাবে তার বইয়ে উঠে এসেছে। যেমন, ফক মনে করতেন নেহরুরা সফল হয়েছিলেন কারণ তারা ধনী ছিল এবং তারা একে অপরের উন্নতিতে সাহায্য করেছিল।

তবে তিনি ফিরোজকে সেই একই কাতারে ফেলতে চাননি। তার মতে, “ইন্দিরা গান্ধীকে বিয়ে করা ছিল ফিরোজ গান্ধীর জীবনে একই সাথে একটা সুবিধা এবং একটা বাধা।”

ফিরোজ: দ্য ফরগটেন গান্ধী
জওহরলাল নেহরুর সাথে নাস্তার টেবিলে ফিরোজ ও ইন্দিরা গান্ধী। এই টেবিলেই ফিরোজ একবার তার স্ত্রীকে ফ্যাসিবাদী বলে অভিযুক্ত করেছিলেন।

ফক এর মতে, ফিরোজ যদি ক্ষমতাবান নেহরু পরিবারে বিয়ে নাও করতেন, তাহলেও তিনি অনেকদূর যেতে পারতেন। বইটি পড়তে গিয়ে পাঠক আবিষ্কার করবেন যে, লেখকের কাছে ফিরোজ একজন নায়ক ছিলেন। হয়ত এমন নায়ক, যার অনেক ত্রুটি ছিল। কিন্তু এই নায়কের ভাগ্যে মহান অর্জন লেখা ছিল।

ডালমিয়া ভাষণের পর ফিরোজ গান্ধী একজন সক্রিয় সংসদ সদস্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তিনি “জায়ান্ট কিলার” নামে পরিচিত হন। এরপর তিনি “মুন্দ্রা কেলেঙ্কারি” ফাঁস করেন। এতে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী টি.টি. কৃষ্ণমাচারী কঠোর নিন্দার মুখে পড়েন এবং এক সময় দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান।

ফিরোজ প্রমাণ করে দেখান কীভাবে টেলকো (বর্তমানে টাটা মটরস নামে পরিচিত) ভারতীয় রেলওয়ের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে নিচ্ছে। তবে প্রত্যাশিতভাবেই এসব কাজ ফিরোজকে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর প্রিয়পাত্র করে তোলেনি।

জীবনের পড়ন্ত সময়ে, দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে ফিরোজের মোহভঙ্গ ঘটে। এদিকে অতিরিক্ত ধূমপান ও মদ্যপানের কারণে তার শরীরও ভেঙে পড়তে থাকে। একসময় তার শরীর হাল ছেড়ে দেয় এবং তিনি বেশ কয়েকবার হার্ট অ্যাটাকের শিকার হন।

ফিরোজ: দ্য ফরগটেন গান্ধী
অবসরপ্রাপ্ত সুইডিশ সাংবাদিক বার্টিল ফক ১০ বছরেরও বেশি সময় ইন্ডিয়া, ইংল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস ও ভ্রমণ করেছেন। তার লেখালেখির শুরু ১২ বছর বয়সে, ছোট একটি বিজ্ঞান কল্পগ্রন্থ প্রকাশ দিয়ে। ফিরোজ গান্ধীর এই জীবনী ‘ফিরোজ: দ্য ফরগটেন গান্ধী’ মূলত লেখকের চার দশকের ভ্রমণ, গবেষণা ও সাক্ষাৎকার থেকে উঠে আসা ব্যক্তিগত বর্ণনা। তার বিখ্যাত একটি বই ‘Crime, the Swedish Way: An Anthology of 10 Crime Stories’।

যদিও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব ছিল, তবে ইন্দিরা গান্ধী পরবর্তীতে স্বীকার করেন যে ফিরোজের মৃত্যু তাকে বড় ধাক্কা দিয়েছিল। ফক অবশ্য “দ্যা লিগ্যাসি অফ ফিরোজ ভাই” অধ্যায়ে ইন্দিরার সমালোচনা করেন। ফক বলেন, জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধী এবং তার পুত্র সঞ্জয় গান্ধী মিলে, ফিরোজ গান্ধী যে আদর্শকে ধারণ করেছিলেন, তা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছিল।

স্বাধীনতার আগের ভারত এবং পঞ্চাশের দশকে ভারতের রাজনীতি নিয়ে যারা আগ্রহী, তাদের বইটি পছন্দ হতে পারে। তবে বইয়ের সকল গল্প আবর্তিত হয়েছে ফিরোজকে ঘিরে।

বইয়ে ফক বেশ কয়েকজন মানুষের সাথে কথা বলেন। এর মাধ্যমে ফিরোজ ও তার সময়ের মোটামুটি সকল বিষয়ই বইয়ে নিয়ে আসেন। তবে পড়তে গিয়ে কখনো কখনো মনে হতে পারে বইয়ে বর্ণিত তথ্য ও অভিজ্ঞানের মাধ্যমে লেখক যেন নিজের মতামতই পাঠককে বলছেন।

লেখকের কাছে এই বইয়ের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ ছিল ফিরোজ নামের এই সংসদ সদস্যের সঙ্গে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেয়া। অন্তত বর্তমান সময়ের জনপ্রতিনিধিরা যখন নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে গুরুত্ব দিতে চান না, তখন ফিরোজের মত রাজনীতিবিদের কথা পাঠকদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন লেখক।

অনুবাদ: আমিন আল রাজী