আমরা দেখেছি যে, গত দুই আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বড় বড় প্রতিদ্বন্দ্বীদের বয়স ৭০-এর কোঠায় ছিল এবং এই বয়সেও তারা বেশ কর্মক্ষম ছিলেন। ফলে শক্তিশালী এই নেতাদের মানসিক সামর্থ্য এবং সামনে এগিয়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে যে, এই বয়সেও তারা কীভাবে তা পারছেন। 

সান দিয়েগো শহরে অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ ও স্নায়ুবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর হেলদি এজিং’-এর পরিচালক দিলীপ জেস্টে বলেন, “মধ্য বয়সের পর থেকে শুরু করে, অর্থাৎ বয়স ৬০ এর কোঠায় পৌঁছানোর পর থেকে মানুষের স্মৃতিশক্তি এবং অন্যান্য ক্ষমতা কমতে থাকে।” কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোন ক্ষমতা কখন কীভাবে এবং কোন গতিতে কমে বা বাড়ে, তা বেশ জটিল একটি বিষয়।


জিম ডেভিস
নটিলাস, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২১


‘নেচার হিউম্যান বিহেভিয়র’ জার্নালে প্রকাশিত এক নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই উন্নত হয়। আর এর মধ্যে কিছু চেতনা সংক্রান্ত বা কগনিটিভ (Cognitive) বিষয়ও রয়েছে, যেই বিষয়গুলি এর আগে বয়সের সাথে সাথে খারাপ হতো বলেই ভাবা হয়েছে এতদিন। 

লিসবন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন ভার্সিমো এবং তার সহকর্মীরা ৫৮ থেকে ৯৮ বছর বয়সী একদল মানুষের ওপর এই গবেষণা চালিয়েছিলেন। বয়সের সাথে মানুষের চেতনার পরিবর্তন নিয়ে আরও স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার জন্যে তারা গবেষণায় অংশ নেয়া লোকদের চেতনা সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের কাজের ফলাফল নিয়ে পরীক্ষা করেন।

গবেষণার সময় এতে অংশ নেয়া মানুষদের লিঙ্গ এবং শিক্ষার বিষয়টা মাথায় রাখা হয়। একইসাথে তাদের সাধারণ চিন্তার গতি, নাড়াচাড়ার গতি এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাদের উপলব্ধির ওপরও পরীক্ষা চালিয়ে বেশ কিছু চমৎকার এবং আশা জাগানোর মতো ফলাফল পাওয়া গেছে।

মনোবিজ্ঞানের প্রচলিত ধারণা অনুসারে, প্রায় ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষের সব ধরনের চেতনা সংক্রান্ত দক্ষতা বাড়তে থাকে। এর পর থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে যুক্ত সাবলীল বিষয়গুলি ধীরে ধীরে কমতে থাকে, যার মধ্যে রয়েছে নতুন জিনিস সম্পর্কে চিন্তা, দ্রুত চিন্তা এবং বিমূর্ত যুক্তির মতো বিষয়। 

অন্যদিকে, “ক্রিস্টালাইজড” বা “তীক্ষ্ণ” বুদ্ধিমত্তা, যা প্রজ্ঞা, জ্ঞান এবং কোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তা বয়স বাড়ার সাথে সাথে আরো উন্নত হতে থাকে। তবে এ ধরনের বুদ্ধিমত্তা থেকে পাওয়া ফলাফলের পরিমাণও বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমে আসতে থাকে। আপনার বয়স ৭০ এর ঘরে গেলেও বুদ্ধিমত্তায় এ ধরনের উন্নতি অব্যাহত থাকবে, কিন্তু এরপর থেকে তা কমতে শুরু করে।

কিন্তু, কগনিটিভ সাইকোলজিস্ট বা চেতনা নিয়ে যেসব মনোবিজ্ঞানী কাজ করেন, তাদের মতে ‘মনোযোগ’ এর মতো সাবলীল বুদ্ধিমত্তার কিছু দিককে কয়েকটি অংশে ভাগ করা যেতে পারে। ‘মনোযোগ’ এর ক্ষেত্রে অংশগুলি হতে পারে সতর্কতা, গুছিয়ে চিন্তা এবং কোনো লক্ষ্য পূরণের জন্যে জটিল মানসিক পদ্ধতি অনুসরণ, যাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এক্সিকিউটিভ কনট্রোল বলা হয়। সতর্কতা হলো সচেতনতা এবং সামনে আসতে থাকা তথ্যের প্রতি সাড়া দেয়ার প্রস্তুতি। গাড়ি চালানোর জন্য এই বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। 

অন্যদিকে গুরুত্বের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন তথ্যের মধ্যে জরুরি তথ্য নির্ধারণ করার ক্ষমতাই হলো গুছিয়ে চিন্তা করা। আর ‘এক্সিকিউটিভ কনট্রোল’ বলতে বোঝায়, গুছিয়ে চিন্তা করার পরে যেসব তথ্য গুরুত্বহীন মনে হয়, সেগুলি নিয়ে চিন্তাভাবনা না করা। রেস্তোরাঁয় যেমন অন্যান্য টেবিলে চলা কথাবার্তাকে আমরা গুরুত্ব দেই না, এটা তেমনই। এই ক্ষমতাগুলি কিছুটা স্বাধীন এবং এমনকি স্নায়ুর বিভিন্ন স্তরের সাথে যুক্ত।

আরো পড়ুন: শতবর্ষী মানুষ কেন বেশিদিন বাঁচে? 

ভার্সিমো এবং তার সহকর্মীরা লিখেছেন, “এই মনোযোগ বা এক্সিকিউটিভ কার্যক্রম নিউরোকগনিটিভ স্নায়বিক চৈতন্যের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন রকম হতে পারে। যা থেকে আমরা ধারণা করছি, এগুলি বয়স বাড়ার ক্ষেত্রেও বিভিন্নভাবে সংবেদনশীল হতে পারে।”

তাহলে প্রচলিত মনোবিজ্ঞানে যেমনটা ধারণা করা হয়, তেমনভাবে বয়স কি সাবলীল বুদ্ধিমত্তাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে? নাকি এই উপাদানগুলি যেহেতু শারীরিকভাবে ভিন্ন ভিন্ন, সেহেতু বার্ধক্যের ফলে প্রতিটা বিষয়ে আলাদাভাবে প্রভাব পড়ে?

বিষয়টি বোঝার জন্য, ভার্সিমো এবং তার সহকর্মীরা ‘অ্যাটেনশন নেটওয়ার্ক টেস্ট’ নামের পরীক্ষার একটি সাধারণ পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন, যাতে সতর্কতা, গুছিয়ে চিন্তা এবং এক্সিকিউটিভ কনট্রোলের জন্যে অংশগ্রহণকারীদের আলাদা আলাদা স্কোর দেয়া হয়। 

যেমনটা আশা করা গিয়েছিল, তেমনভাবেই দেখা গেছে যে, বয়স্করা সাধারণত কোনো কিছুর প্রতি ধীরে প্রতিক্রিয়া জানান। বয়স্কদের প্রতিক্রিয়ার সময় পরিমাপ করে দেখা গেছে, তাদের প্রতিক্রিয়ার গতি (যেমন, স্ক্রিনে দেখা কোনো কিছুর প্রতিক্রিয়ায় একটি বোতাম তারা কত দ্রুত চাপতে পারেন) প্রতি বছর গড়ে ৬.৩ মিলিসেকেন্ড এর মতো কমে আসতে থাকে। 

তবে বিভিন্ন বিষয়ের স্কোরের মধ্যে পার্থক্য দেখা গেছে। যেমন, বয়স বাড়ার সাথে সাথে সতর্কতার বিষয়টা আরো খারাপ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু গুছিয়ে চিন্তা এবং অপ্রাসঙ্গিক তথ্য বাধা দেয়ার ক্ষমতা আরো ভালো হয়েছে। অর্থাৎ, অন্যান্য অনেক কিছুর মতো সাবলীল বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রেও আমরা বয়সের সাথে সাথে আরো স্মার্ট হতে পারি।

গবেষকরা লিখেছেন, “এভাবে দেখা যাচ্ছে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে মনোযোগ এবং এক্সিকিউটিভ কার্যক্রমের হার কমে যাওয়া সংক্রান্ত নানান তত্ত্বের সাথে আমাদের গবেষণায় পাওয়া ফলাফল এবং অন্যান্য তথ্য সাংঘর্ষিক। এমনকি সাধারণত বয়স বাড়ার সাথে সাথে চেতনার দিক দিয়ে মানুষের অবনতি হয় মনে করা হলেও বার্ধক্যের বহুমুখী ফলাফল আছে, যার মধ্যে অনেক সুবিধাও রয়েছে।“

একজন প্রেসিডেন্টকে অনেক সিদ্ধান্ত সতর্কতার সাথে চিন্তা করেই নিতে হয়। এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলি কখনোই এত দ্রুত নেয়ার প্রয়োজন হয় না যে, তাতে মিলিসেকেন্ডের ব্যবধান কোনো পার্থক্য তৈরি করবে। আজকাল রাষ্ট্রপতিরা নিজেদের গাড়িও চালান না। আর বয়সের সাথে সাথে যেহেতু ভোকাবুলারি বা শব্দভাণ্ডার, ভাষা বোঝার ক্ষমতা, অন্যের আবেগ বুঝতে পারা এবং সর্বোপরি মানুষের জ্ঞান বাড়ে, সেহেতু সম্ভবত আমেরিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের বয়স ৭০-এর ঘরে থাকায় আমাদের খুব বেশি চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। অন্তত মস্তিষ্কের শক্তি নিয়ে যদি আলোচনা করা হয়।

লেখক পরিচিতি: জিম ডেভিস কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ের কগনিটিভ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক। তিনি অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত পডকাস্ট ‘মাইন্ডিং দ্যা ব্রেইন’-এর কো-হোস্ট। তার নতুন বইয়ের নাম ‘বিয়িং দ্যা পারসন ইওর ডগ থিংকস ইউ আর: দ্য সায়েন্স অফ এ বেটার ইউ’ (Being the Person Your Dog Thinks You Are: The Science of a Better You)।

অনুবাদ: মাহবুবুল আলম তারেক