কখনো কি বড় কোনো প্রকল্প বা কাজকে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী ছোট ছোট ভাগে ভাগ করার কথা ভেবেছেন?

পেশাজীবনে অনেক সময়ই বড় প্রজেক্ট বা প্রকল্পে কাজ করতে হয় আমাদের। এ ধরনের প্রকল্পে কাজ করতে গেলে দেখা যায় সেখানে বড় বড় অনেক কাজই নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে হয়। আর বিপুল পরিমাণ কাজের চাপে আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ি।

এ ধরনের অনুভূতি কাজের অগ্রগতিতে বাধা দেয়। এতে মনোবল ভেঙে যেতে পারে এবং কাজটা শেষ করাও অনেক সময় অসম্ভব হয়ে ওঠে। যখন মনে হয় একটা কাজ শেষ করা অসম্ভব, তখনই মূলত কাজটা নিয়ে গড়িমসি শুরু হয় আমাদের মধ্যে।

কিন্তু কাজকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে নিয়ে করলে প্রক্রিয়াটা সহজ হয়ে যায়। এরপর এক এক করে শুধু এগিয়ে যাওয়া। এটা অনেকটা, সামনে প্রচুর খাবার থাকলেও সেখান থেকে অল্প অল্প করে খাওয়ার মত। একইভাবে একটা কাজ যত কঠিন বা বড়ই হোক না কেন, সেটাকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে নিলে কাজ অবশ্যই শেষ করা যাবে।

একবার ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে ফেললে পুরো কাজটা শেষ করা অনেক সহজ হয়ে আসবে। তাই সম্পূর্ণ কাজ একবারে করার চেয়ে, এ মুহূর্তে আপনি যতটুকু করতে পারেন ততটুকুই করুন। একটা বড় কাজকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করার কৌশল জানা থাকলে কাজ আরো দ্রুত হবে এবং কাজের পরিমাণও বেড়ে যাবে।

 

বড় কাজকে যেভাবে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করতে হয়

কোনো বড় কাজকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করার আগে মোটের ওপর কাজ বলতে কী বোঝায়, সেটা জানতে হবে। কথাটা ভাবতে অনেক সহজ মনে হলেও কাজ বলতে কী বোঝায় তা জানা না থাকলে আপনি ভালোভাবে পরিকল্পনা করতে পারবেন না।

কাজ
সম্পূর্ণ কাজ একবারে করার চেয়ে, এ মুহূর্তে আপনি যতটুকু করতে পারেন ততটুকুই করুন

যেহেতু কাজের একটা খসড়া তৈরি করা প্রয়োজন, এখানে কাজটাকে ছোট ছোট ভাগ করাই হচ্ছে কঠিন ব্যাপার। এছাড়া একটা বড় কাজকে আপনি কীভাবে ছোট ছোট অংশে ভাগ করবেন, তা দিয়েই নির্ধারিত হয় আপনি কতক্ষণ সময় নিয়ে সেগুলি করতে চান।

আরো পড়ুন: এটা কি আসলে “সকালের কাজ”?

যেমন ধরা যাক ই-মেইল লেখা একটা কাজ। এবার কাজটাকে কয়েক ধাপে ছোট করে নিতে পারেন। যেমন ই-মেইল লিখতে হবে আমান সাহেবের কাছে, আর ই-মেইলে থাকবে প্রকল্পের সময়সীমা নিয়ে আলোচনা। এবার আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন কীভাবে কাজটা শেষ করতে হবে।

তবে ই-মেইল লেখাটা কাজ হিসেবে যথেষ্ট বড় না। অন্যদিকে প্রেজেন্টেশন তৈরি করার মত বড় কাজকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করলে সুবিধা হয়। তা করার জন্য ‘রিওয়াইন্ড অ্যান্ড রিডিউস’ নামের একটি কৌশলের ব্যাপারে জেনে নেয়া যাক।

 

‘রিওয়াইন্ড অ্যান্ড রিডিউস’ কৌশল

আপনি যদি আগে প্রডাক্টিভিটি ও কাজে দক্ষতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে কাজকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে থাকেন, তাহলে হয়ত খেয়াল করেছেন, তা করার অনেক রকম পদ্ধতি আছে। এই পদ্ধতিগুলি আপনাকে ছোট ছোট ভাগে কাজ ভাগ করা শিখতে সাহায্য করবে।

হতে পারে এ ধরনের সব পদ্ধতিই খুব কাজের। কিন্তু প্রতিটা পদ্ধতিই ঠিকঠাক আপনার কাজে নাও লাগতে পারে।

যারা নিজেদের প্রডাক্টিভিটি বাড়াতে ও লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়, তাদের ক্ষেত্রে ‘রিওয়াইন্ড অ্যান্ড রিডিউস’ পদ্ধতি কাজ করতে পারে।

উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা পরিষ্কার করা যাক। ধরা যাক ‘রিওয়াইন্ড অ্যান্ড রিডিউস’ পদ্ধতির সাহায্য নেয়ার আগে একটা প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে  কারো ৮ ঘণ্টা সময় লাগত, তাহলে এ পদ্ধতিতে দুই ঘণ্টার মধ্যে সে প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে পারবে। পাশাপাশি তার মানসিক চাপও কমে আসবে। আবার খুব বেশি পরিশ্রম না করেই সে কাজগুলি শেষ করতে পারবে।

‘রিওয়াইন্ড অ্যান্ড রিডিউস’ পদ্ধতি বোঝার জন্য আমাদেরকে নিচের ধাপগুলি নিয়ে আলোচনা করতে হবে।

 

প্রথম ধাপ: রিওয়াইন্ড

প্রথম ধাপে আমাদের কৌশলটি হচ্ছে ‘রিওয়াইন্ড’। সহজ কথায়, শেষের দিক থেকে কাজ শুরু করা। কাজের শেষে গিয়ে আপনি যে লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান, সেখান থেকে কাজ শুরু করাই হচ্ছে এই ধাপের লক্ষ্য। এভাবে সহজেই কাজের মূল লক্ষ্য খুঁজে পাবেন। একই সঙ্গে সঠিক সময়েও শেষ করতে পারবেন।

বিক্রি বাড়ানো, ব্যবসায়িক কার্যক্রম উন্নত করা, খরচ কমানো বা গ্রাহকদের সন্তুষ্টি বাড়ানোর মত প্রত্যেক প্রকল্পেরই কোনো না কোনো লক্ষ্য থাকে।

কাজের লক্ষ্য স্পষ্ট বুঝতে পারলে আপনার ও আপনার টিমের সবাই আরো সহজে একত্রে কাজ করতে পারবে আর প্রডাক্টিভিটিও বাড়বে। এক গবেষণায় ১৬২ জন মানুষ ‘হ্যান্ড-আই কোঅর্ডিনেশন টেস্ট’ নামে একটা পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। ‘হ্যান্ড-আই কোঅর্ডিনেশন টেস্ট’ হল মূলত সহজ একটি পরীক্ষা। এতে অংশ নেয়া ব্যক্তিকে প্রথমে দেয়ালের দিকে ডান হাত দিয়ে একটা টেনিস বল ছুঁড়ে মেরে সেটা বাম হাত দিয়ে ধরতে বলা হয়। এরপর বাম হাত ছুঁড়ে মেরে ডান হাত দিয়ে ধরতে বলা হয়। এভাবে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলতে থাকে।

কাজ
কাজের লক্ষ্য স্পষ্ট বুঝতে পারলে আপনার ও আপনার টিমের সবাই আরো সহজে একত্রে কাজ করতে পারবে আর প্রডাক্টিভিটিও বাড়বে

গবেষকরা সেই পরীক্ষায় দেখতে পান, অংশ নেয়া মানুষদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং কর্মক্ষমতা বা পারফর্মেন্সের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে। গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, যাদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে, তারা বেশি প্রডাক্টিভ হয়।

অর্থাৎ, বড় কোনো প্রজেক্টের লক্ষ্য যেন এমন হয়, তা থেকে আপনি কাজের সঠিক পন্থা খুঁজে নিতে পারেন। একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করার পরে শেষ থেকে কাজ শুরু করলে আপনার সময় ও শক্তি বেঁচে যাবে।

আরো পড়ুন: সাকসেসফুল ডেলিগেশন: অন্যদের দিয়ে কাজ করাবেন কীভাবে?

যেমন ধরা যাক একজন ম্যানেজার পুরো প্রতিষ্ঠানের কাজের পদ্ধতি ঠিক করার জন্যে প্রেজেন্টেশন তৈরি করার কথা ভাবছে। এখন শেষ থেকে কাজ শুরু করার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলি প্রাধান্য দিতে হবে: অডিয়েন্স কারা সেটা ঠিক করতে হবে, ব্রেনস্টর্মিং করতে হবে এবং একটা ভাল বিষয় নির্বাচন করতে হবে। এছাড়াও প্রেজেন্টেশন নিয়ে পরিকল্পনা, গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের উৎস খুঁজে বের করার জন্য গবেষণা এবং সবশেষে প্রেজেন্টেশন দেয়ার আগে ভাল ভাবে চর্চা করে নিতে হবে।

দ্বিতীয় ধাপ: রিডিউস

প্রথম ধাপ আপনাকে সাহায্য করবে কাজটা সফলভাবে শেষ করার জন্য প্রয়োজনীয় লক্ষ্য খুঁজে বের করতে। এরপরের ধাপ, অর্থাৎ দ্বিতীয় ধাপটি ‘রিডিউস’। এই ধাপে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নিতে হবে। ছোট অংশে ভাগ করা মানে হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিশেষভাবে আলোকপাত করা। ছোট ছোট অংশে ভাগ করা কাজগুলি যেন অন্তত এক ঘণ্টার মধ্যে শেষ করা যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

তারপর ঠিক করতে হবে প্রতি কাজের জন্যে আপনি ঠিক কতটা সময় ব্যয় করবেন। কাজ যত ছোট হবে, সেটা তত সহজ ও নির্ভুল ভাবে শেষ করা যাবে।

 

তৃতীয় ধাপ: সারসংক্ষেপ

তৃতীয় ধাপে গিয়ে সমস্ত পরিকল্পনা একত্রিত করে দেখতে হবে যেন নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে পারেন। ধরা যাক আপনাকে একটা প্রেজেন্টেশন পরবর্তী শুক্রবারের মধ্যে শেষ করতে হবে। তৃতীয় ধাপে এসে বিশ্লেষণ করে দেখলেন প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে কাজ করলে প্রেজেন্টেশন ভালভাবে শেষ করতে পারবেন। পুরো বিষয়টা এভাবে ভাবতে পারেন:

১. প্রেজেন্টেশন নিয়ে পরিকল্পনা এবং সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে আগানো: ১ ঘণ্টা

২. গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের উৎস খুঁজে বের করার জন্য গবেষণা: ১ ঘণ্টা

৩. পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট ভাবে প্রেজেন্টেশনের জন্য স্লাইড তৈরি: ১ ঘণ্টা

৪. প্রেজেন্টেশন সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার জন্য চর্চা: ৩০ মিনিট

৫. সব মিলিয়ে সময় লাগবে সাড়ে ৩ ঘণ্টা।

এভাবে পরিকল্পনা করলে কোনো ধরনের মানসিক চাপ ছাড়া কাজটা সময়মত শেষ করা যাবে। খুব সহজ, তাই না?

 

উপসংহার

বড় কোনো প্রকল্প শেষ হতে কয়েক সপ্তাহ, মাস, এমনকি বছরও লেগে যেতে পারে। আর কোনো প্রকল্পে খুব বেশি সময় ও শক্তি ব্যয় হলে হতাশা কাজ করতে পারে। এবং প্রকল্প শেষ করার পরও মনে হতে পার, অহেতুক শক্তি ও সময় ব্যয় করতে গিয়ে ব্যাপারটা হতাশায় পরিণত হল। আর ঠিক এ কারণেই বড় প্রকল্পকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নেয়ার জন্য ‘রিওয়াইন্ড অ্যান্ড রিডিউস’ পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন।

বড় প্রকল্প শেষ করতে গিয়ে সবার মাথায়ই দুশ্চিন্তা চেপে বসে। তাই বড় কোনো কাজকে এভাবে ছোট অংশে ভাগ করে করাটা সুবিধার। বিশেষ করে আপনার যদি কাজ নিয়ে গড়িমসি করার অভ্যাস থাকে, তাহলে বড় কাজকে ছোট ভাগে ভাগ করে নেয়াটা কাজে দেবে।

সূত্র. লাইফহ্যাক
অনুবাদ. মাহতাবুল আলম