এই মুহূর্তে ঠিক কোন জিনিসটা আপনার মনোযোগ দাবি করছে? কোন কাজটা করবেন বলে বাছাই করেছেন?

কল্পনা করুন, আপনার বস আপনাকে পরের বোর্ড মিটিং এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রেজেন্টেশন রেডি করতে বলেছেন।

জিনিসটা তৈরি করতে আপনার  আছে মাত্র কয়েকটা দিন। কাজের চাপ আপনার এমনিতেই বেশি। তার ওপর টু-ডু লিস্টে জমে আছে জরুরি অনেক কাজ। তাই আপনি উদ্বিগ্ন, মনোযোগ দিতে পারছেন না এবং সবকিছুই আপনাকে বিভ্রান্ত করছে বলে মনে হচ্ছে।

হাতে যখন অনেক কাজ থাকে কিন্তু তা শেষ করার সময় থাকে অল্প, তখন আমাদের মধ্যে মানসিক চাপ দেখা দেয়। কাজের জায়গায় যা কিছু আমাদেরকে বাড়তি চাপের মধ্যে রাখে, সময় নিয়ে দুশ্চিন্তা তার একটা।

সেক্ষেত্রে, মানসিক চাপের এই কারণকে আপনি কীভাবে পরাজিত করতে পারেন? এবং একই সঙ্গে কোনো কাজ ভালভাবে শেষ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আপনি কীভাবে নেবেন?

আইজেনহাওয়ার এর জরুরি / গুরুত্বপূর্ণ নীতি আপনাকে আপনার প্রায়োরিটি বা অগ্রাধিকার সম্পর্কে চিন্তা করতে সাহায্য করবে। আপনার জন্য কোন কাজগুলি গুরুত্বপূর্ণ এবং কোনগুলি আপনাকে বিভ্রান্ত করে, তা নির্ধারণেও সহায়তা করবে এই নীতি৷

‘জরুরী’ ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ কী?
১৯৫৪ সালের ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অফ চার্চেসের দ্বিতীয় অ্যাসেম্বলিতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার একটা বক্তৃতা দেন। সেখানে তিনি নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট ড. জে. রস্কো মিলারকে উদ্ধৃত করে বলেন: “আমার দুই ধরনের সমস্যা আছে: জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ। জরুরী কাজগুলি গুরুত্বপূর্ণ নয়, আর গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি কখনোই জরুরী নয়।”

বলা হয়ে থাকে, তিনি কীভাবে ব্যক্তিগত কাজের প্রেশার ও অগ্রাধিকারগুলি সাজাতেন তা তার এই ‘আইজেনহাওয়ার নীতি’ থেকে বোঝা যায়।

তিনি স্বীকার করেন যে, টাইম ম্যানেজমেন্টের কোনো কৌশল তখনই অসাধারণ হয়ে ওঠে যখন তা কার্যকর হওয়ার পাশাপাশি দক্ষ হয়। অন্য কথায়, আমাদের কেবল জরুরী কাজে সময় ব্যয় করলে হবে না, গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলিতেও সময় দিতে হবে।

তা করতে জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে।

আরো পড়ুন: ঘুম: ভোরের পাখি নাকি রাতের পেঁচা, কে বেশি সুখী? 

গুরুত্বপূর্ণ কাজের বৈশিষ্ট্য হল, এর একটি আউটকাম থাকে যা আমাদেরকে লক্ষ্য অর্জনের দিকে নিয়ে যায়, কর্মক্ষেত্রে বা ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে যেই কাজই হোক না কেন।

জরুরী কাজ তখন তখনই আমাদের মনোযোগ দাবি করে এবং সাধারণত অন্য কারো লক্ষ্য অর্জনের সাথে যুক্ত থাকে। এসব কাজে দেরি না করেই মন দেই আমরা। তা না করলে কিছু তাৎক্ষণিক পরিণতির মুখোমুখি হতে হয়।

যখন আমরা বাছাই করতে পারি, কোন কাজগুলি গুরুত্বপূর্ণ এবং কোনগুলি জরুরী, তখন গুরুত্বহীন জরুরী কাজগুলিতে মনোযোগ দেয়ার স্বাভাবিক প্রবণতাকে কাটিয়ে উঠতে পারি। এতে করে আমরা আমাদের সফলতার জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করার জন্য যথেষ্ট সময় বের করতে পারি।

আইজেনহাওয়ারের নীতি কীভাবে ব্যবহার করবেন?
এই নীতি কাজে লাগানোর জন্য যেসব কাজ ও প্রজেক্ট আপনার মনে হয় সম্পূর্ণ করা দরকার, তার তালিকা করুন। কাজের জায়গায় আপনার সব সময় কেড়ে নেয় কিন্তু কাজ হিসেবে অত গুরুত্বপূর্ণ না এমন কাজগুলির নাম লিখুন।

এরপরে, প্রতিটা কাজ সম্পর্কে চিন্তা করুন এবং নিচের ৪টি বিভাগের একটাতে রাখুন, যেমনটা নিচের ছবিতে  দেখানো হয়েছে:

আইজেনহাওয়ার এর 'জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ' নির্ধারণ করার নীতিঅগ্রাধিকার সমূহ:

  • গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরী
  • গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু জরুরী নয়
  • গুরুত্বপূর্ণ নয় কিন্তু জরুরি
  • গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং জরুরী নয়

তারপর কাজ নির্ধারণ করতে নিচের কৌশলগুলি ব্যবহার করুন।

১. গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী
জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজের দুটি স্বতন্ত্র ধরন আছে। এক প্রকার কাজ হল, যেগুলির কথা আপনি আগে ভাবার সুযোগ পাননি। আর আরেক প্রকার হল যেগুলি আপনি শেষ মুহূর্তে করার জন্য ফেলে রেখেছেন৷

আগে থেকে পরিকল্পনা করার মাধ্যমে এবং দীর্ঘসূত্রিতা এড়িয়ে শেষ মুহূর্তের কাজগুলি বাদ দিতে পারেন।

আরেকটা ব্যাপার হল, আপনি সবসময় সমস্যা ও সংকট অনুমান করতে পারবেন না এবং তা এড়াতেও পারবেন না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি হলো, সময়সূচীতে অপ্রত্যাশিত সমস্যা ও অপরিকল্পিত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার জন্য কিছু সময় রাখা। (হঠাৎ যদি কোনো সংকট দেখা দেয়, আপনাকে অন্যান্য কাজগুলি রিশিডিউল করতে হবে।)

হাতে যদি অনেক জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকে, তবে এর মধ্যে কোনটির কথা আপনি বরাদ্দ রাখতে পারেন সে সম্পর্কে চিন্তা করুন, যাতে সেগুলি জরুরি না হয়ে ওঠে।

২. গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু জরুরী নয়
এই কাজগুলি আপনাকে আপনার ব্যক্তিগত ও প্রফেশনাল লক্ষ্য অর্জন করতে ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ করতে সহায়তা করবে।

নিশ্চিত করুন যে আপনার হাতে এই কাজগুলি সঠিকভাবে করার জন্যে যথেষ্ট সময় আছে। সময় মত না করার কারণে এ কাজগুলি যেন পরে জরুরি না হয়ে ওঠে সেদিকে খেয়াল রাখুন। এছাড়া অপ্রত্যাশিত সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য সময়সূচীতে পর্যাপ্ত সময় রাখতে ভুলবেন না।

এটি লক্ষ্য ঠিক রেখে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়াবে এবং আপনাকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি জরুরী হয়ে ওঠা কাজের চাপ এড়াতে সহায়তা করবে।

৩. গুরুত্বপূর্ণ নয় কিন্তু জরুরী
জরুরী কিন্তু অগুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি আপনাকে আপনার লক্ষ্য অর্জনে বাধা দেয়। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন আপনি এসব কাজের সময় পেছাতে বা নতুন করে সময় নির্ধারণ করতে পারেন কিনা।

এ ধরনের কাজের একটি সাধারণ উৎস হল অন্যেরা। মাঝে মাঝে অন্যদের “না” বলতে পারা দরকার বা সমস্যাটি তাদের নিজেদেরকেই সমাধান করতে উৎসাহিত করা দরকার।

আরো পড়ুন: টাইম ব্লকিং কাজ করছে না—এই ৮টি কৌশল ব্যবহার করুন 

বিকল্প ভাবে, আপনি যখন অ্যাভেইলেবল থাকবেন তখনই অন্যদের সাথে আলাপ করার জন্য টাইম স্লট রাখার চেষ্টা করুন। এতে মানুষ বুঝবে শুধু সেই সময়টিতেই তারা আপনার সাথে কথা বলতে পারবে। এছাড়াও আরো একটি ভাল উপায়ে এটি করা যায়, তা হল যারা প্রায়ই আপনার কাজে বাধা হয়ে ওঠে তাদের সাথে নিয়মিত মিটিংয়ের ব্যবস্থা করা। যাতে আপনি তাদের সব ইস্যু একবারেই শুনতে পারেন। তখনই আপনি গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলিতে দীর্ঘ সময়ের জন্য মনোনিবেশ করতে সক্ষম হবেন।

৪. গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং জরুরী নয়
এই কাজগুলি কেবল বিভ্রান্তি তৈরি করে, সম্ভব হলে এড়িয়ে চলুন।

এমন অনেক কাজই আপনি বাতিল করতে পারবেন। আবার কিছু কাজ এমন হতে পারে যা অন্যেরা আপনাকে দিয়ে করাতে চায়। তারা নিজেরা যদিও আপনার নিজের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণে কোনো অবদান রাখে না। এইক্ষেত্রেও চেষ্টা করুন বিনয়ের সাথে “না” বলতে, সঙ্গে কেন আপনি কাজটা করতে পারবেন না তা ব্যাখ্যা করুন।

মানুষ যদি দেখে আপনি ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য ও ব্যক্তিগত বাউন্ডারি সম্পর্কে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন, তাহলে ভবিষ্যতে তারা আপনাকে আর “গুরুত্বপূর্ণ নয়” এমন কাজ করার অনুরোধ করবে না।

মূল পয়েন্ট
আইজেনহাওয়ারের জরুরী / গুরুত্বপূর্ণ নীতি আপনার কোন কাজগুলিতে ফোকাস করা উচিৎ, সেইসাথে কোনগুলি উপেক্ষা করা উচিৎ তা দ্রুত শনাক্ত করতে সাহায্য করে।

আপনি যখন সময়কে অগ্রাধিকার দেয়ার জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন, আপনি গুরুত্বপূর্ণ ও দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য পূরণে কাজ করার সাথে সাথে সত্যিকারের জরুরী সমস্যাগুলিও মোকাবেলা করার সুযোগ পান।

এই নীতির সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য আপনার সমস্ত কাজের একটি তালিকা করুন এবং প্রতিটা কাজকে নিচের ৪টি বিভাগের একটিতে রাখুন:

গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরী
গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু জরুরী নয়
গুরুত্বপূর্ণ নয় কিন্তু জরুরী
গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং জরুরী নয়

তারপর কাজগুলি গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার ওপর ভিত্তি করে সাজান এবং কোনটা কখন করবেন তা নির্ধারণ করুন।

সূত্র: মাইন্ডটুলস, অনুবাদ: জুবায়েদ দ্বীপ