সায়েন্স অ্যাডভান্স  জার্নাল এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে কীভাবে সিজারিয়ান পদ্ধতিতে জন্ম নেয়া সন্তানের ভবিষ্যতে স্থূল হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।  

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, সিজারিয়ান পদ্ধতিতে জন্ম নেয়া শিশুদের মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ জীবিত অবস্থায় জন্ম নেয়।

সিজারিয়ান পদ্ধতিতে বেশির ভাগ সময়েই হয় মা নয়ত সন্তানকে বাঁচানো সম্ভব হয়। তাই প্রসবের ক্ষেত্রে অন্যান্য পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে এবং মায়েরা অন্য কোনো সার্জারি পদ্ধতি বেছে নিতে পারেন।

গত কয়েক বছরে বিশ্বে সিজারিয়ান সার্জারির হার ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে আনুমানিক তিন ভাগের একভাগ (বা ৩২.৫ শতাংশ) জীবিত শিশুর জন্ম হয়েছে সিজারিয়ান পদ্ধতিতে।

সিজারিয়ান ডেলিভারি
ড. মারিয়া দমিনগুয়েজ-বেল্লো

ড. মারিয়া দমিনগুয়েজ-বেল্লো’র নেতৃত্বে, নিউ ইয়োর্ক ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিন এর গবেষকেরা নবজাতকের ওজন এবং সিজারিয়ান ডেলিভারি পদ্ধতির মধ্যে সংযোগ বের করার জন্যে গবেষণাটি পরিচালনা করেন।

গবেষণাটি করা হয় আগের কয়েকটি গবেষণার উপর ভিত্তি করে। এসব গবেষণায় দেখা যায় সিজারিয়ান পদ্ধতিতে জন্ম নেয়া শিশুদের মধ্যে অতিরিক্ত স্থূল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই সম্ভাবনার সঙ্গে সিজারিয়ান পদ্ধতির একটি সংযোগ রয়েছে।

এরকমই একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, সিজারিয়ান পদ্ধতিতে জন্ম নেয়া শিশুদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনা অন্যদের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। এক্ষেত্রে মায়ের ওজন কোনো ভূমিকা রাখে না।    

কিন্তু কীভাবে এই ব্যাপারটিকে ব্যাখ্যা করা যায়?

একটা  ব্যাখ্যা হতে পারে যে মাতৃগর্ভে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া সমূহকে ভ্রূণের কাছে পৌঁছে দেয়ার পথে সিজারিয়ান ডেলিভারি বাধা সৃষ্টি করে।

ব্যাকটেরিয়ার সাথে এই সংযোগ শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও বিপাকীয় পদ্ধতিতে ভূমিকা রাখে। সেইসাথে এটি শিশুকে সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে।

বেশিরভাগ গবেষণাই বিষয়টিকে পর্যবেক্ষণ করেছে ওজন বৃদ্ধির সাথে প্রসব পদ্ধতির একটি সংযোগ হিসেবে। এই গবেষণাটিতে একটি কার্যকর প্রক্রিয়া দেখানো হয়েছে যা এই সংযোগটিকে ব্যাখ্যা করতে পারে।

গবেষণাটি করা হয়েছে ইঁদুরের উপরে। ড. দমিনগুয়েজ জানিয়েছেন, এটি হলো “প্রথম গবেষণা যা স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে সিজারিয়ান ডেলিভারি ও ওজন বৃদ্ধির মধ্যে সাধারণ সংযোগকে ব্যাখ্যা করে।”

ড. দমিনগুয়েজ ও তার দল সিজারিয়ান পদ্ধতিতে জন্ম নেয়া ৩৪ টি ইঁদুর ও ৩৫ সাধারণভাবে জন্ম নেয়া ইঁদুরের মধ্যে তুলনা করেন।

ইঁদুরের শরীরে উপস্থিত অণুজীবসমূহের উপর  প্রসবের পদ্ধতির প্রভাব পরীক্ষা করতে গিয়ে গবেষকেরা নবজাতকের দেহে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া বিশ্লেষণ করেন।

গবেষকেরা বয়স বাড়ার সাথে সাথে ব্যাকটেরিয়ার পরিবর্তনও পর্যবেক্ষণ করেন।  

তারা আবিষ্কার করেন, সিজারিয়ান পদ্ধতিতে জন্ম নেয়া ইঁদুরের দেহের অণুজীবসমূহ প্রাকৃতিক উপায়ে জন্ম নেয়া ইঁদুরের চাইতে অনেকটাই ভিন্ন। প্রাকৃতিক উপায়ে জন্ম নেয়া ইঁদুরদের মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি দেখা যায়। যেমন, ব্যাকটোরোয়েডস, ক্লোসট্রিডিয়ালেস, এবং রুমিনোকোকাকেই।

এছাড়াও, বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রাকৃতিক উপায়ে জন্ম নেয়া ইঁদুরের ব্যাকটেরিয়াল কম্পোজিশন বিকশিত হয় স্বাভাবিক ভাবে। কিন্তু সিজারিয়ান পদ্ধতিতে জন্ম নেয়া ইঁদুরদের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে না।

গবেষকেরা জানিয়েছেন, সিজারিয়ান পদ্ধতিতে জন্ম নেয়া ইঁদুরদের অণুজীবসমূহের গঠন প্রথমে খুব দ্রুত বিকশিত হয়। কিন্তু পরে এই বিকাশ থেমে যায়। প্রসবের পদ্ধতির ফলে সৃষ্ট এমন পার্থক্য মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে বেশি কাজ করে।

গবেষণাটিতে দেখা যায়, প্রসবের পদ্ধতির কারণে শরীরের ওজনের তারতম্য ঘটে। গবেষকেরা বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেন, “ইঁদুরগুলি যদি সিজারিয়ান পদ্ধতিতে জন্ম নেয় তাহলে ১৫ সপ্তাহ বয়সে ৩৩ শতাংশ বেশি ওজন ধারণ করে। আর যদি সেগুলি মেয়ে ইঁদুর হয় তাহলে এই হার ৭০ শতাংশ।”  

দমিনগুয়েজ-বেল্লো বলেন, “নির্দিষ্ট কিছু ব্যাকটেরিয়াল গ্রুপ মোটা হয়ে যাওয়া আটকাতে পারে কিনা তা বোঝার জন্যে আরো গবেষণার প্রয়োজন। আমাদের গবেষণা এই অনুমানটিকে সমর্থন করে যে মাতৃগর্ভে উপস্থিত অণুজীবসমূহকে গ্রহণ করাটা স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও খাদ্য পরিপাক প্রক্রিয়াকে সচল রাখার জন্যে প্রয়োজন।”

ড. দমিনগুয়েজ-বেল্লো’র মতে, শিশু জন্মগ্রহণের সময় যে অণুজীব গ্রহণ করে তা ভবিষ্যতে শারীরিক ভাবে স্থূল হয়ে পড়ার সাথে জড়িত কিনা তা জানাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে সিজারিয়ান পদ্ধতি বিশ্বের অনেক প্রান্তেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

গবেষকেরা ধারণা করছেন, যদি মানুষের ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই হয়ে থাকে তাহলে প্রসবের সময় মায়ের শরীর থেকে যে তরল নিঃসৃত হয় তা নবজাতকের দেহে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে পারলে হয়ত ব্যাকটেরিয়ার ঘাটতি কিছুটা পূরণ করা যাবে।

গবেষণার ফলাফল নিয়ে মেডিকেল নিউজ টুডে-এর সাথে কথা বলতে গিয়ে ড. দমিনগুয়েজ-বেল্লো বলেন, “এই গবেষণার ফলাফল সেইসব মাইক্রোবায়োটা সমূহের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা এনে দিয়েছে যা এই ধরনের অসুখের সাথে সম্পর্কিত।”

তিনি বলেন, “আমাদের আরো জানতে হবে মানুষের শরীরের কোন ধরণের অণুজীব স্থূল হয়ে যাওয়াকে প্রতিরোধ করে। সেইসাথে জানতে হবে কোনগুলি এই আশঙ্কাকে বাড়িয়ে তোলে এবং কেন বাড়ায়।”

ড. দমিনগুয়েজ মনে করেন, সন্তান প্রসবের পদ্ধতিগুলি অতিরিক্ত রকমের কৃত্রিম হয়ে উঠেছে। একে আবার স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক উপায়ে ফিরিয়ে নেয়া উচিৎ। মানুষের উচিৎ জীবতত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রযুক্তি ব্যবহার করা।

সূত্র. মেডিক্যাল নিউজ টুডে