মাত্র কয়েক প্রজন্মের মধ্যেই পুরুষদের বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা এতটাই কমে যাবে যে তারা হয়তো আর সন্তানই জন্ম দিতে পারবেন না! মহামারীবিদ শান্না সোয়ানের নতুন বই কাউন্টডাউন-এ এমনই ভয়াবহ উদ্বেগজনক এক দাবি করা হয়েছে। বইটিতে নানা সাক্ষ্য প্রমাণ জড়ো করে দেখানো হয়েছে যে, পশ্চিমা পুরুষদের বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা মাত্র ৪০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ৫০% কমে গেছে।

তার মানে যে পুরুষরা এই লেখাটি পড়ছেন তাদের বীর্যে তাদের দাদাদের তুলনায় মাত্র অর্ধেক শুক্রাণু রয়েছে। আর এভাবে চলতে থাকলে ২০৬০ সালের মধ্যে পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা তলানিতে এসে ঠেকবে বা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।


অ্যালেক্স ফোর্ড
জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক, পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউকে

গ্যারি হাটচিসন
বিষবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও  প্রায়োগিক বিজ্ঞানের ডিন, 
এডিনবার্গ ন্যাপিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, ইউকে

দ্য কনভারসেশন, ১৫ এপ্রিল ২০২১


এমন দাবি হয়তো খুবই বেদনাদায়ক। কিন্তু এই দাবির পক্ষে নতুন নতুন সাক্ষ্য-প্রমাণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। বিশ্বব্যাপী মানুষ এবং বন্যপ্রাণীদের মধ্যে প্রজননগত অস্বাভাবিকতা এবং উর্বরতা কমে যাওয়ার প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর।

সামনেও এই প্রবণতা অব্যাহত থাকবে কি না তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে এভাবে চলতে থাকলে আমরা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাব। এই সমস্যার মূল কারণগুলির মধ্যে একটি, আমরা দৈনন্দিন জীবন যাপনে যেসব রাসায়নিক ব্যবহার করি সেসব। সুতরাং আমরা যদি আমাদের নিজেদের এবং পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীদের প্রজনন ক্ষমতা রক্ষা চাই তাহলে আজ থেকেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে রাসায়নিক ব্যবহারের লাগাম টেনে ধরতে হবে।

 

 

ড. শান্না সোয়ান

বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যাওয়া

মানুষের বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যাওয়া নিয়ে গবেষণা নতুন নয়। ১৯৯০ সালে প্রথম বিষয়টি বিশ্ববাসীর নজরে আসে। তবে যে পদ্ধতিতে বীর্যে শুক্রাণুর পরিমাণ রেকর্ড করা হতো তাতে খুঁত আছে বলে অভিযোগ ছিল সমালোচকদের।

এরপর ২০১৭ সালে এই বিষয়ে আরো জোরদার গবেষণা চালানো হয়। যে গবেষণায় আগের খুঁতগুলিকে পাশ কাটিয়েই শুক্রাণুর পরিমাণ রেকর্ড করা হয়। নতুন এই গবেষণায় দেখা যায় যে, ১৯৭৩ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে পশ্চিমা পুরুষদের বীর্যে শুক্রাণুর পরিমাণ ৫০%-৬০% কমে এসেছে। শান্না সোয়ান এই “কাউন্টডাউনের” কথাই বলেছেন।

পুরুষের বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা যতই কমে আসবে ততই যৌন মিলনের মাধ্যমে তার সন্তান জন্মদানের সক্ষমতাও কমে যেতে থাকবে। ২০১৭ সালের গবেষণার পর হুঁশিয়ারি দেয়া হয় যে, বর্তমান তরুণ প্রজন্মের নাতিদের বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা এতটাই কমে যাবে যে তারা আর যৌন মিলনের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিতে পারবে না। যার ফলে ২০৪৫ সালের মধ্যেই হয়তো বেশিরভাগ যুগলকে কৃত্রিমভাবে গর্ভধারণ করতে হবে।

শুক্রাণু কমে যাওয়ার ফলে গর্ভপাত এবং দেহের বিকাশজনিত অস্বাভাবিকতাও বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। পুরুষাঙ্গ ছোট হয়ে যাওয়া, উভলিঙ্গ প্রবণতা (একই ব্যক্তির মধ্যে নারী এবং পুরুষালী স্বভাব এবং বৈশিষ্ট্য দেখা দেয়া) এবং অস্বাভাবিক শুক্রাশয় বা অণ্ডকোষ প্রভৃতি সমস্যাও শুক্রাণু কমে যাওয়ারই কুফল।

 

পুরুষদের উর্বরতা কমছে যে কারণে

এর পেছনে নানা বিষয় দায়ী। মোটের ওপর ১৯৭৩ সালের পর থেকে জীবন যাত্রার ধরন নাটকীয় ভাবে বদলে গেছে। খাদ্যাভ্যাস, শরীরচর্চা, স্থূলতার হার এবং মদপানের অভ্যাস সব কিছুতেই বদল এসেছে। আর এই পরিবর্তনই বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যাওয়ারও কারণ।

তবে সম্প্রতি গবেষকরা আবিষ্কার করেন যে, মায়ের গর্ভে ভ্রুণ অবস্থায় থাকার সময়েই পুরুষদের প্রজনন স্বাস্থ্যের সমস্যা শুরু হচ্ছে। ভ্রূণ থেকে যখন পুরুষ লিঙ্গ বিকশিত হচ্ছে তখনই হরমোনের সংকেতে বাধা তৈরি হচ্ছে। যার ফলে পরে যৌবনে গিয়ে প্রজননেও সমস্যা তৈরি হচ্ছে। প্রথমে বিষয়টি অন্য প্রাণীদের ওপর গবেষণায় প্রমাণিত হয়। তবে এখন মানুষের ওপর গবেষণায়ও এর প্রমাণ পাওয়া গেছে।

হরমোনের এই সমস্যা তৈরি হচ্ছে মূলত আমাদের নিত্য ব্যবহার্য্য জিনিসে থাকা রাসায়নিকগুলি থেকে। এই রাসায়নিকগুলি আমাদের দেহে প্রবেশ করে ক্ষতিকর হরমোন হিসেবে কাজ করে। অথবা আমাদের দৈহিক বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলিতে হরমোনের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করে। এই রাসায়নিকগুলিকে বলা হয় “এন্ডোক্রাইন-ডিজরাপ্টিং কেমিকেলস” (ইডিসি’জ), যারা হরমোনের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করে। আর এসব রাসায়নিক আমাদের শরীরে প্রবেশ করে আমরা প্রতিদিন যে খাদ্য, পানীয়, নিঃশ্বাস গ্রহণ করি এবং যেসব জিনিস আমাদের ত্বকের সংস্পর্শে আসে সেসবের মাধ্যমে। আধুনিক জীবন যাত্রায় এসব রাসায়নিক থেকে মুক্ত থাকা প্রায় অসম্ভব। যে কারণে এদেরকে অনেক সময় “এভরিহয়ার কেমিকেলস” তথা সর্বব্যাপী রাসায়নিক বলা হয়।

 

যেভাবে এসব রাসায়নিক আমাদের দেহে প্রবেশ করছে

এই রাসায়নিকগুলি মায়ের শরীরের মাধ্যমে তার গর্ভের ভ্রুণে প্রবেশ করে। গর্ভধারণের সময় মায়ের দেহে এসব রাসায়নিক কী হারে প্রবেশ করেছে তার উপর ভিত্তি করেই ভ্রুণের বিকাশের সময় হরমোনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। অর্থাৎ বর্তমানে যেসব পুরুষের বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা কম তারা তাদের মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় পরিবেশের যে অবস্থা ছিল তার ফলেই তাদের এই অবস্থা হয়েছে। সেই পরিবেশ আজকে আরো অনেক বেশি দূষিত হয়ে পড়েছে। তার মানে এখন যে শিশুরা জন্ম নিচ্ছে তাদের অবস্থা আরো খারাপ হবে।

শুধু বিশেষ কোনো একটি রাসায়নিক নয় বরং আমরা প্রতিদিন যেসব রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসছি তার সবকটিই এর জন্য দায়ী। হাত ধোয়ার লিকুইড থেকে শুরু করে চাষাবাদে ব্যবহৃত কীটনাশক, প্রিজারভেটিভ এবং প্লাস্টিক সহ সবকিছুতে থাকা রাসায়নিকই আমাদের হরমোনগুলির স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি বা খামারে গবাদি পশু মোটাতাজাকরণে যেসব রাসায়নিক ব্যবহৃত হয় সেগুলি হরমোনকে প্রভাবিত করার জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়ে থাকে। কিন্তু এখন পরিবেশে যেসব রাসায়নিক ঢুকে গেছে সেগুলিও আমাদের হরমোনের ক্ষতি করছে।

 

প্রাণীরাও কি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?

যে পরিবেশ থেকে আসা রাসায়নিক মানুষের প্রজনন ক্ষমতা ধ্বংস করছে সেই একই রাসায়নিক পরিবেশে বসবাসকারী অন্য প্রাণীদেরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। হচ্ছেও তাই। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, একই কারণে পোষা কুকুরদের বীর্যেও শুক্রাণুর হার কমে গেছে। কানাডা ও সুইডেনে খামারে জন্মানো মিঙ্কদের (বেঁজির মতো দেখতে প্রাণী) ওপর চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে কৃষি ও শিল্পে ব্যবহৃত রাসায়নিকের প্রভাবে তাদের বীর্যেও শুক্রাণুর পরিমাণ কমে গেছে। এছাড়া তাদের অণ্ডকোষ এবং পুরুষাঙ্গেও অস্বাভাবিকতা দেখা দিয়েছে।

আরো বিস্তৃত পরিবেশে গবেষণায় ফ্লোরিডায় অ্যালিগেটর, যুক্তরাজ্যে চিংড়িজাতীয় ক্রাস্টাসিন এবং বিশ্বজুড়ে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের বর্জ্য পানি ফেলা হয় যেসব নদী বা জলাশয়ে সেসবে বসবাসকারী মাছেদের মধ্যেও একই রকম সমস্যা দেখে গেছে।

এমনকি এসব দূষণের উৎস থেকে অনেক দূরে বিচরণ করা প্রাণীদের মধ্যেও রাসায়নিক বিষাক্ততা দেখা গেছে। ২০১৭ সালে স্কটল্যান্ডের সমুদ্র উপকূলে ভেসে আসা একটি নারী তিমির শরীরে যে পরিমাণ রাসায়নিক বিষাক্ততা পাওয়া যায় তা এর আগে আর কোনো প্রাণীর মধ্যেই দেখা যায়নি। বিজ্ঞানীরা বলেন, সেই তিমিটি কখনোই সন্তান জন্ম দিতে পারেনি।

 

রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ

অনেক সময় বণ্য প্রাণীদের মধ্যে যেসব অস্বাভাবিকতা দেখা যায় তার পেছনে দায়ী রাসায়নিক উপাদানগুলি মানুষের দেহে পাওয়া যাওয়া রাসায়নিকের চেয়ে ভিন্ন ধরনের। তবে সেগুলিও প্রজননের সঙ্গে জড়িত হরমোনের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করতে সক্ষম।

যুক্তরাজ্যের পরিবেশ, খাদ্য এবং গ্রাম বিষয়ক দপ্তর বর্তমানে এই সমস্যার সমাধানে একটি নতুন রাসায়নিক নীতিমালা তৈরি করছে। ওদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নও তাদের রাসায়নিক নীতিমালায় পরিবর্তন আনছে যাতে নিষিদ্ধ ঘোষিত রাসায়নিকগুলির জায়গায় আবার নতুন করে কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার না করা হয়।

তবে একমাত্র জনগণ চাপ সৃষ্টি করলেই ক্ষতিকর রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণে আরো কঠোর নীতিমালা তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু পরিবেশে মিশে যাওয়া রাসায়নিক যেহেতু দেখা যায় না এবং তাদের ক্ষতিগুলি প্লাস্টিক ও ধোয়া ওঠা চিমনির মতো দৃশ্যমান নয় তাই হয়তো রাসায়নিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন হবে।

অনুবাদ. মাহবুবুল আলম তারেক