উপন্যাস শুরু হয় কেরির স্কুলের লকার রুমের শাওয়ারে। এখানে কেরির জীবনে প্রথমবারের মত ঋতুস্রাব শুরু হয়। কেরি নারী শরীরের এই স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছুই জানত না। তার মা একজন গোঁড়া খ্রিস্টান যিনি কেরিকে এই বিষয়ে কিছুই শেখান নি। তিনি এটিকে পাপ বলে মনে করতেন। সম্পূর্ণ নতুন এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে কেরি প্রচণ্ড ভীত হয়ে পড়ে। লকার রুমে উপস্থিত কেরির সহপাঠীরা তাকে সাহায্য করার বদলে উত্যক্ত করতে শুরু করে। সে ভাবতে থাকে রক্তক্ষরণের ফলে সে মারা যাচ্ছে।

স্টিফেন কিং এর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস কেরি। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসের মাধ্যমে স্টিফেন কিং পাঠকদের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এটি কেরি নামের একটি মেয়ের গল্প। মেয়েটি স্কুলে তার সহপাঠীদের দ্বারা বিভিন্ন ভাবে নিগৃহীত হয়। আবার নিজের মায়ের সাথেও কেরির সম্পর্ক খুব একটা স্বাভাবিক নয়। কেরি একটা সময় আবিষ্কার করে যে তার টেলিকিনেসিস ক্ষমতা রয়েছে। টেলিকিনেসিস একধরনের রহস্যময় ক্ষমতা যার মাধ্যমে স্পর্শ ছাড়াই যে কোনো বস্তু নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

এরকম অবস্থায় স্কুলের জিম টিচার মিস ডেসজারডিন কেরিকে খুঁজে পান। তিনি কেরিকে কী হচ্ছে তা বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করেন। যদিও কেরি শুরুতে এই বিষয়ে তার সাথে কথা বলতে চায় না। তিনি বুঝতে পারেন যে এই বিষয়ে কেরির জ্ঞান একদম শূন্যের কোঠায়।

স্টিফেন কিং, ১৯৭৭

মিস ডেসজারডেন যখন কেরিকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছিলেন তখন অন্যান্য মেয়েরা তাদেরকে ঘিরে ছিল। ঠিক তখনই তাদের মাথার উপরের লাইট বাল্বটি নড়ে ওঠে। উপন্যাসে এটিই হল কেরির টেলিকিনেসিস ক্ষমতার প্রথম প্রকাশ। যদিও তখন কেউ নিশ্চিত হতে পারে না যে কী ঘটছে।

কেরি যখন স্কুল থেকে বাসায় ফিরে আসে তখন তার মা জানতে পারেন কী ঘটেছে। তিনি কেরির এই অভিজ্ঞতাকে কোনো অজানা পাপের ফল হিসেবে ধরে নেন এবং কেরিকে প্রার্থনার ঘরে আটকে রাখেন। তিনি এই অবস্থার জন্য নিজেকেই দায়ী মনে করেন। অন্যদিকে মিস ডেসজারডেন স্কুলের লকার রুমে যারা কেরিকে উত্যক্ত করছিল তাদের সাসপেন্ড করেন। সেইসাথে তাদের প্রম-এ যাওয়ার অনুমতিও বাতিল করেন।

কেরিকে যারা উত্যক্ত করছিল তাদের নেতৃত্বে ছিল ক্রিস নামের একটি মেয়ে। ক্রিসের বাবা, মি. হেনরি গেইলি আবার স্কুলের আইন বিষয়ক কর্মকর্তা। তিনি মিস ডেসজারডেন এর দেয়া শাস্তি বাতিল করেন। তিনি মেয়েদের জন্য এমন শাস্তির ব্যবস্থা করেন যেন তারা প্রম-এ অংশ নেয়ার সুযোগ পায়।

নতুন শাস্তি হিসেবে তিনি মেয়েদেরকে মিস ডেসজারডেন-এর সাথে বুট ক্যাম্পে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তবে, ক্রিস এই শাস্তিও গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। ফলে তাকে সাসপেন্ড করা হয় এবং প্রম-এ নিষিদ্ধ করা হয়। এইবার তার বাবা তাকে কোনো সাহায্য করেন না।

এদিকে কেরি ধীরে ধীরে নিজের ক্ষমতার কথা জানতে পারে। সে বুঝতে পারে যে সে এই ক্ষমতাটি নিয়েই জন্মেছে। এতদিন এটি প্রকাশিত হয়নি। মাসিক শুরু হওয়ার ফলে সে যে যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে তার ফলে ক্ষমতাটি প্রকাশিত হতে শুরু করেছে।

স্কুলে কেরিকে উত্যক্তকারী মেয়েদের মধ্যে স্যু স্নেল নামের আরেকটি মেয়ে ছিল যে নিজের আচরণের জন্য অনুতপ্ত হয়। সে সিদ্ধান্ত নেয় কেরির সাথে মিটমাট করে নেয়ার। স্যু তার বয়ফ্রেন্ড টমিকে বলে সে যেন কেরিকে প্রম-এ আসতে অনুরোধ করে। টমের অনুরোধে কেরি প্রথমে সংশয়বোধ করলেও পরে সে অনুষ্ঠানে আসতে রাজি হয়। অনুষ্ঠানে পরে যাওয়ার জন্য সে একটি লাল রঙের জামা বাছাই করে।

এক্ষেত্রে কেরির লাল জামাটিকে একটি সিম্বল বা প্রতীক হিসেবে ধরা যেতে পারে। লাল রঙকে প্রায়শই ভালোবাসা বা কামনার রঙ হিসেবে ধরে নেয়া হয়। তাই স্টিফেন কিং যখন তার উপন্যাসে এই রঙের কথা উল্লেখ করেন তখন পাঠকের কাছে তা প্রতীক হিসেবে ধরা পড়তেই পারে।

আবার, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে কেরির মা একজন গোঁড়া খ্রিস্টান। তিনি নারী-পুরুষের মধ্যকার সম্পর্ককে পাপ মনে করেন। তাই কেরি যখন নাচের আসরে যাওয়ার জন্য লাল জামা বেছে নেয় তখন তিনি ভীত হয়ে পড়েন এই ভেবে যে কেরি হয়ত কোনো পাপ কাজের সাথে জড়িয়ে পড়তে পারে। তিনি এতই গোঁড়া ধার্মিক যে এমনকি বিয়ে পরবর্তী যৌনতাকেও পাপ বলে মনে করেন। এছাড়াও উপন্যাসের এই পর্যায়ে আমরা জানতে পারি যে কেরির রহস্যময় ক্ষমতা বিষয়ে তিনি শুরু থেকেই সব জানতেন।

এদিকে ক্রিস এবং তার বয়ফ্রেন্ড বিলি প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান নেয়। প্রমের শুরুটা কেরির জন্য ভালোই ছিল। কিন্তু ক্রিস আর বিলি এমন কৌশল খাটায় যে প্রম ইলেকশনে কেরি আর টমিকে কিং এবং কুইন নির্বাচন করা হয়। তারা যখন নিজেদের মুকুট নেয়ার জন্য এগিয়ে আসে তখন তাদের মাথার দুই বালতি শূকরের রক্ত ঢেলে দেয়া হয়। এর মধ্যে একটি বালতি সোজা এসে টমির মাথায় আঘাত করে যার ফলে সে মারা যায়।

কেরি ছুটে বিল্ডিং থেকে বের হয়ে আসে যখন সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে শুরু করে। বের হয়ে আসার পর তার মনে পড়ে নিজের ক্ষমতার কথা। প্রথমে সে চেষ্টা করে দরজা লক করার এবং অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র চালু করার। কিন্তু এসব করতে গিয়ে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি হয় এবং বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দুইজন মারা যায়। পরে পুরো বিল্ডিংটিতেই আগুন ধরে যায়। যার ফলে বিল্ডিং-এর ভিতরে থাকা প্রায় সবাই মারা যায়।

ঘরে ফিরে আসার পথে কেরি শহরের পাওয়ার লাইনগুলিকে ভেঙে ফেলে। এরফলে অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হয় এবং গ্যাস স্টেশনে বিস্ফোরণ ঘটে। ঘরে ফিরে আসলে কেরির মা তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেন। তার মায়ের ধারণা কেরি যা করছে তা আসলে শয়তানের কাজ। এই সময়ে তিনি কেরিকে জানান যে কেরির জন্ম হয়েছে মেরিটাল রেইপ-এর ফলে। তিনি কেরিকে কিচেন নাইফ দিয়ে আঘাত করেন। কেরি নিজেকে বাঁচানোর জন্যে তার মাকে হত্যা করে।

এরপরে কেরি সেই বাড়িটি ধ্বংস করতে যায় যেখানে সে জন্ম নিয়েছিল। পরে সে ক্রিস এবং বিলিকে দেখতে পায়। তারা কেরিকে দেখে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু সে তাদের গাড়িটিকে ধ্বংস করে এবং তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ক্রিস এবং বিলি আগুনে পুড়ে মারা যায়।

ধ্বংসযজ্ঞের এই পুরো সময়টুকু জুড়েই কেরি ব্রডকাস্ট টেলিপ্যাথির মাধ্যমে শহরের সব মানুষকে জানিয়ে দেয় কেন এসব ঘটছে। স্যু কেরির বার্তাগুলি অনুসরণ করছিল। সে কেরিকে একটি পার্কিং লটে মূমুর্ষু অবস্থায় খুঁজে পায়। কেরি টেলিপ্যাথির মাধ্যমে বুঝতে পারে যে স্যু এবং টমি প্রাংক বিষয়ে কিছুই জানত না। মারা যাওয়ার সময় কেরি তার মাকে ডাকতে থাকে।

মিস ডেসজারডেন বেঁচে যান এবং অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। হেনরি গেইলিও অনুতপ্ত হন এবং কাজ থেকে অব্যাহতি নেন। বেঁচে থাকা শিক্ষার্থীরা একটি শোকসভায় অংশ নেয়। শহরটি ভূতের শহর হিসেবে পরিচিতি পায় এবং টুরিস্টদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যারা কেরির ক্ষমতা নিয়ে উৎসাহী।

অনেকের কাছেই কেরি হয়ে ওঠে রূপকথার গল্পের কোনো সাহসী চরিত্রের মত। আবার অনেকের কাছেই সে দানবী। বিপর্যয়ের পরে স্কুলে বিভিন্ন সংস্কার আনা হয়। কোনো শিক্ষার্থী যেন উৎপীড়নের শিকার না হয় সে বিষয়ে আরো সতর্কতা নেয়া হয়। এদিকে সরকার টেলিকিনেসিস বিষয়ে আরো আগ্রহী হয়ে ওঠে।

উপন্যাসের একদম শেষে দেখা যায় একজন নারী জর্জিয়া থেকে চিঠি লিখে তার সন্তানের টেলিকিনেসিস ক্ষমতার কথা জানান। নিজের সন্তানের এই রহস্যময় ক্ষমতা নিয়ে তিনি নিজের মুগ্ধতা এবং ভালোবাসার কথাও জানান। পাঠক বুঝতে পারে, কেরি হয়ত অবশেষে এমন একটি পরিবারে জন্ম নিয়েছে যে ধরনের পরিবার তার প্রাপ্য।

স্টিফেন কিং ‘কেরি’ উপন্যাসটিকে নারীবাদী উপন্যাস হিসেবে দাবি করেন। কেরি এক্ষেত্রে একটি প্রতীক। কেরির চরিত্রের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা কী ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়, কীভাবে তাদেরকে আমোদের বস্তু হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

কেরি একটি সাধারণ মেয়ে যে বাস করে চ্যাম্বারলেইনে। আবার সে একজন নারী যে প্রথম বারের মত নিজের ক্ষমতাকে অনুভব করছে। নিজের সমাজকে সে মনে করে ধ্বংসাত্মক ও ক্ষতিকর। সে নিজের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে সমাজকে পরিবর্তন করার জন্য। কাজটি করতে গিয়ে সে শেষ পর্যন্ত বীর এবং দানবী দুটিই হয়ে ওঠে। তবে, তাকে বীর নাকি দানব হিসেবে ধরে নেয়া হবে তা একান্তই নির্ভর করে পাঠকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির উপর।