১৩ বছরের এমা ডেভিসকে তার মা প্রথমবারের মতো সামার ক্যাম্পিং এর জন্য নর্থইস্টার্ন স্টেটসের ক্যাম্প নাইটিঙ্গেলে পাঠায়। এইখানে সচরাচর ক্যাম্প করতে আসে বড়লোকের মেয়েরা। এমা ক্যাম্পে যাওয়ার প্রথম দিন পর্যন্ত জানত না যে তাকে সেখানে পাঠানো হইতেছে।

জানার পর দেখল সে’ই সবার শেষে গিয়ে ক্যাম্পে পৌঁছাইছে। দেরির কারণে কেবিন বাছাইয়ের সুযোগ সে পায় না। ফলে তাকে অবশিষ্ট কেবিন থেকে ডগউড নামের একটা ছোট্ট কেবিন আরো তিনজন ক্যাম্পারের সঙ্গে শেয়ার করতে হয়। এমার কেবিন-সঙ্গীরা হইল ভিভিয়ান, ন্যাটালি আর অ্যালিসন। ওরা পুরানো ক্যাম্পার, ক্যাম্পার হিসেবে ওদের কিছুটা নামডাকও আছে।

তিনজনই বয়সে এমার থেকে বড়। ওদের মধ্যে ভিভিয়ানের সঙ্গে খুব দ্রুত এমার বন্ধুত্ব হয়। ভিভিয়ান সুন্দরী, মিশুক এবং বুদ্ধিমতী। ওকে দেখে এমার মনে হয়, তার যদি এমন একটা বড় বোন থাকত, তাইলে কত ভাল হইত!

কেবিনের মেয়েরা এমাকে তাদের সঙ্গে খেলায় নেয়।  খেলার নাম, টু ট্রুথস অ্যান্ড এ লাই। মানে, দুইটা সত্য বলতে হবে, তার সঙ্গে একটা মিথ্যা।

এইটা ওদের সবচেয়ে পছন্দের খেলা। এই খেলার ধরন হচ্ছে, মিথ্যাটা এমনভাবে বলতে হবে যেন অন্যে তা মিথ্যা বইলা ধরতে না পারে। তারা খেলায় এই ক্যাম্পের ডার্ক হিস্টোরি নিয়া কথা বলে, এইটার নাকি অনেক খারাপ অতীত আছে, যতটা সরল দেখায় ব্যাপারটা আসলে ততটা না। এমা বুইঝা উঠতে পারে না, ওরা আসলে কখন মিথ্যা বলতেছে।


অর্জয়িতা রিয়া


ক্যাম্প নিয়ে কথাগুলা ওরা এমনভাবে বলতেছে যে বিশ্বাস না করেও উপায় নাই—অদ্ভূত গেম একটা!

একদিন গভীর রাতে ঘুম ভাঙে এমার। সে দেখে ভিভিয়ান, ন্যাটালি আর অ্যালিসন চুপিসারে কেবিন থেকে বের হয়ে যাইতেছে। ভিভিয়ান তাকে দেইখা ফেলে, জাগতে দেখে ইশারায় ঠোঁটে আঙুল দিয়ে শব্দ করতে মানা করে। এরপর কেবিনের দরজা বন্ধ করে বের হয়ে যায়। ওদের তিনজনকে এমা ওই রাতেই শেষ বারের মত দেখে। ওরা আর কখনো ফিরে আসে নাই, একদম গায়েব হয়ে যায় এরপর।

এই ঘটনার ১৫ বছর পর ক্যাম্পের মালিক ফ্রান্সেসকা হ্যারিস হোয়াইট এমাকে ওই ক্যাম্পের রি ওপেনিং-এ আসতে আমন্ত্রণ জানায়। মেয়েদেরকে আর্ট শিখাইতে। এমার বয়স এই সময় ২৮, সে একজন সফল পেইন্টার। গ্যালারি ভর্তি তার ফরেস্ট সিরিজের পেইন্টিং। এই পেন্টিংগুলার প্রত্যেকটাই করা এমার ওই রাতের স্মৃতি নিয়া। সে একের পর এক ছবি আঁকছে তার হারানো সঙ্গিদের মনে করে।

ওদেরকে আর ওই রাতের কথা এমা একদিনের জন্যও ভুলতে পারে নাই, বিশেষত ভিভিয়ানকে। ছবিগুলা দেখে ফ্রান্সেসকা মুগ্ধ হয়। তাই এমাকে সে পুনরায় ক্যাম্পে ডাকে।

এমার কাছে তার ওই প্রথম ক্যাম্পিং-এর ম্মৃতি এখনও স্পষ্ট আর কষ্টদায়ক। সেই রাতে ওদের ওইভাবে কেবিন থেকে বের হয়ে যাওয়া আর ভিভিয়ানের ইশারায় শব্দ করতে নিষেধ করার দুঃস্বপ্ন এমার পিছু ছাড়ে না। একই স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি হইতে থাকে। একই ঘটনা যেন স্বপ্নের কারণে প্রতিরাতে নতুন নতুন করে ঘটে এমার জীবনে। সে ফ্রান্সেসকার প্রস্তাবে রাজি হয়। এই আশায় যে, ওখানে ফিরা গিয়া ওই তিনজনের হঠাৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কারণ যদি সে খুঁজে বের করতে পারে।

এমা ক্যাম্প নাইটিঙ্গেলে ফিরা আসে। তবে অদ্ভূতভাবে, ১৫ বছর আগের যেই কেবিন থেকে বের হয়ে তার তিন সঙ্গী আর ফিরে আসে নাই, সেই ডগউড কেবিনেই তার থাকার জায়গা হয়।

এমা লক্ষ করে, একটা সিকিউরিটি ক্যামেরা ঠিক তার কেবিনের দিকে লাগানো। অর্থাৎ, তাকে নজরদারিতে রাখা হইতেছে। কিন্তু কেন? এটা অবশ্যই ফ্রান্সেসকার নির্দেশে হইছে। কিন্তু, ফ্রান্সেসকার কী প্রয়োজন সারাক্ষণ সে কী করতেছে না করতেছে জানার? নিশ্চই কোনো উদ্দেশ্য অাছে।

বিষয়টা ঘাবড়ানোর মত, কিন্তু এমা তাতে দমে যায় না। সে তার সঙ্গীদের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া জারি রাখবে বলে সিদ্বান্ত নেয়।

সবচেয়ে অদ্ভূত ব্যাপার হইল, ভিভিয়ান যাওয়ার আগে এমন কিছু ক্লু রেখে গেছে যা থেইকা এই ক্যাম্প তৈরির উৎস ঘটনাগুলি সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ করা যায়, এই ক্যাম্প তৈরির গোপন ইতিহাস সংক্রান্ত রহস্যময়তার সমাধান করা যায়।

এইটুকু গল্পের সত্য অংশটুকু বা বলা যায়, খেলার মত—এই পর্যন্ত যা ঘটছে তা আসলে ঘটতে দেখে সত্য বলে মনে হইছে। এর একটা মিথ্যা অংশও আছে। তা হইল, হয়ত এমা কিছু বিষয় সবসময় গোপন রেখে গেছে, কোনোদিন কাউকে সেই ব্যাপারে কিচ্ছু বলে নাই. জানতেও দেয় নাই। হয়ত, যা কিছু সেই রাতে ঘটছে সেইসব দৃশ্য থেকেও এমা আরো বেশি কিছু জানে। সে যদিও সত্য বলেই জীবনটা কাটাইতে চায়, তবু মনে হয় ওই গ্রীষ্মের মিথ্যাগুলি থেকে পালানোর ক্ষমতা তার নিজেরও নাই। হয়ত, সে যা কিছু বলে নাই, গোপন রাখছে তা আরো কেউ জানে, এমাকে এ জন্য মূল্য দিতে হইতে পারে, সে এমার সামনে একসময় আসবে। বা হয়ত দৃশ্যের মধ্যেই আরো মিথ্যার সংযোজন ঘটবে।

গল্পটা রাইলি সেজার এর নতুন বই ‘দ্য লাস্ট টাইম আই লাইড’ বইয়ের। বইটা এই জুলাইয়ের ৩ তারিখে আমেরিকায় রিলিজ হইছে। রাইলির এইটা দ্বিতীয় বই। তার প্রথম থ্রিলার ‘ফাইনাল গার্লস’ ন্যাশনাল এবং ইন্টারন্যাশনাল বেস্ট সেলার ছিল এবং অনূদিত কপিগুলি বিক্রি হইছিল প্রায় ২৪টার মত দেশে।

তার এইবারের বইটাও পাঠকরা খুব পছন্দ করতেছেন, একের পর রিভিউ পাবলিশ করতেছেন তারা বই এবং লেখকের চিন্তার প্রশংসা করে।

তারা বলতেছেন, সাহিত্যে আরো একজন আসাধারণ থ্রিলার লেখক পাওয়া গেল রাইলি সেজারের মাধ্যমে। তাদের ধারণা রাইলির লেখার ধরন এবং দক্ষতা—যারা থ্রিলার পছন্দ করেন না বরং থ্রিলারকে শুধুমাত্র একই রকমের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বইলা মনে করেন তাদেরকেও থ্রিলারের প্রতি আগ্রহী কইরা তুলবে।

রাইলি সেজার লেখকের ছদ্মনাম, তার প্রকৃত নাম টড রিটার। তিনি অন্যান্য নামেও তার আরো অন্যান্য সাহিত্যকর্ম প্রকাশ করছেন। তবে তার প্রকৃত পরিচয় তিনি এখনো পর্যন্ত আড়ালে রাখছেন। ওনার পেশা জীবন সম্পর্কে জানা যায়, লেখালেখির পাশাপাশি উনি একজন এডিটর এবং গ্রাফিক ডিজাইনার। জন্মেছেন আমেরিকার পেনসিলভেনিয়ায়, এখন থাকেন নিউ জার্সির প্রিন্সটনে।

রাইলি মূলত থ্রিলার, সাসপেন্স এবং মিস্ট্রি ধরনের বই লেখেন। এইধরনের বই তিনি পড়তেও পছন্দ করেন।

‘দ্য লাস্ট টাইম আই লাইড’ লেখার পিছনের গল্প হইল, ক্লাসিক উপন্যাস ‘পিকনিক অ্যাট হ্যাঙ্গিং রক (১৯৬৭)’ পড়ে তার অনেক ভাল লাগছিল। তিনি ওই বই দ্বারা অনুপ্রাণিত হন, সেখান থেকেই তার দ্বিতীয় উপন্যাসটা লেখেন। তাছাড়া, দশ বছর বয়সে তিনি একটা সামার ক্যাম্পে গেছিলেন। সেখানে ছিলেন প্রায় এক সপ্তাহ। সেই অভিজ্ঞতাও তাকে এই উপন্যাসের ছোটখাটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে স্পষ্টভাবে দেখাইতে অনেক সাহায্য করছে। যদিও তিনি বলেন, ওই সামার ক্যাম্পের এক সপ্তাহ তার মোটেও ভাল যায় নাই, খুব বাজে অভিজ্ঞতা হইছে সেখানে।

এখনো পর্যন্ত তিনি যা লিখছেন তাতে বলা যায়, তিনি একজন সফল ডার্ক সাইকোলজিকাল থ্রিলার লেখক। পরবর্তীতে তিনি এই জনরার বাইরেও কিছু লিখবেন কিনা সে সম্পর্কে এখনো কিছু বলেন নাই। তবে একজন ক্ষমতাধর লেখক অনেক কিছুই পারেন।

রাইলি তার গল্পে কৌশল এবং সংযোগ ধইরা রাখতে জানেন, ফলে তার লেখা পড়ার মাঝখানে ছাড়ার উপায় নাই। রাইলির সূক্ষ্ম চিন্তায় কখন কী হইতে পারে তা আন্দাজ করা কঠিন। প্রতি মুহূর্তে কিছু একটা হওয়ার সুপ্ত ইঙ্গিত তিনি দেন, এই ‘কিছু একটা’কে পাইতে আপনি হয়ত পাতার পর পাতা একই অনুসন্ধিৎসা নিয়ে পড়ে যাবেন, একসময় সেই ‘কিছু একটা’ ঘটবে, ততক্ষণে পুরা বইটা আপনার পড়া শেষ হয়ে যাবে, সেটা আপনি পড়তে পড়তে জানবেনও না।

এই উপন্যাসে অনেকগুলি চরিত্র এবং ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে যাওয়ার মুহূর্ত আছে। প্রতিবারের ফ্ল্যাশব্যাক বর্তমানের একেকটা মিস্ট্রির সমাধানের একেকটা ক্লু দেয়। আবার নতুন মিস্ট্রির দিকে যায়। এর সঙ্গেই গল্পের চরিত্ররা তাদের মত চলতে থাকে আর আরো গল্প তৈরি করে। পাঠকদের মতে, সব মিলায়া রাইলি সেজারের ‘দ্য লাস্ট টাইম আই লাইড’ এই বছর প্রকাশিত বেস্ট থ্রিলারগুলার একটা।