আমাদের প্রিয় মোমবাতিগুলি আমাদের কাছ থেকে কি কিছু লুকাচ্ছে? ঘরের বাতাসের অবস্থা আর মোমবাতির মধ্যে কি কোনো নেতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে?

মোমবাতি ঘরে আরামদায়ক ও আন্তরিক পরিবেশ তৈরি করে। পারিবারিক উৎসব ও ছুটির দিনকে সাজিয়ে তোলে মোমবাতি। মনে করিয়ে দেয় প্রিয়জনের সাথে কাটানো আনন্দের মুহূর্ত । মোমবাতি দিয়ে সাজানো ডাইনিং টেবিল দেখতেও যেমন সুন্দর তেমনি ঘরকেও করে তোলে আলোকিত। অনেকেই ঘর সতেজ রাখতে সুগন্ধি মোমবাতি ব্যবহার করেন।

দুঃখজনকভাবে, সুগন্ধি মোমবাতি হতে পারে স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ। একটা সাধারণ মোমবাতি ঘরের বাতাস দূষিত করে এবং সেই বিষাক্ত বাতাসের কারণে গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকির আশংকা তৈরি হয়। মোমবাতি ঘর সতেজ রাখবে নাকি বাতাস দূষিত করবে সেটা নির্ভর করছে আপনি কী ধরনের মোমবাতি ব্যবহার করবেন তার ওপর।

প্রচলিত মোমবাতির ক্ষতিকর দিক
সাধারণত যেসব মোমবাতি আমরা ব্যবহার করি সেগুলি খালি চোখে দেখা যায় না এমন সব কণার মাধ্যমে ঘরের বাতাস দূষিত করে। এইসব কণা ঘরের চুলা, ভেন্টিলেটর, এয়ারকন্ডিশনিং সিস্টেমে গিয়ে মিশে সেগুলি নোংরা করে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় মোমবাতি পোড়ানোর ফলে তৈরি হওয়া এসকল কণার সাথে ক্যান্সারের যোগসূত্র পাওয়া গেছে।

আমাদের ব্যবহৃত বেশিরভাগ মোমবাতিই কিন্তু প্যারাফিনের তৈরি এবং বিষাক্ত ধাতবের সলতেওয়ালা। প্যারাফিন পেট্রোলিয়াম-জাত পদার্থ। তেল এবং গ্যাস উৎপাদনের পর অবশিষ্ট হিসেবে প্রাপ্ত সব থেকে নিকৃষ্ট উপজাত অংশ প্যারাফিন। উৎপাদন কারখানাগুলি এই অবশিষ্ট উপজাত পদার্থগুলি স্ট্যাবিলাইজিং কেমিক্যাল দিয়ে বিশোধন করে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল প্রস্তুত করে। প্যারাফিন-ভিত্তিক মোমবাতিগুলি জ্বালানোর ফলে উপজাত হিসেবে ধোঁয়া এবং ঝুলকালি তৈরি হয়। এমনকি গন্ধবিহীন, রঙবিহীন মোমবাতিও দূষক পদার্থের মাধ্যমে ঘরের বাতাস দূষিত করে।

মোমবাতি
মোমবাতি নিঃসৃত বিষাক্ত পদার্থের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সাধারণ অ্যালার্জি, অ্যাজমা, বিঘ্নিত বয়ঃসন্ধি, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, দ্রুত রজঃবিরতি, ত্বক, চোখ, ফুসফুসের প্রদাহ এবং জীবনঘাতী ক্যান্সারের ঝুঁকি।

সুগন্ধি মোমবাতি আসলে ততটা “মিষ্টি” নয় যতটা আপনি ভাবেন
সুগন্ধি মোমবাতিও কিন্তু বিষাক্ত রাসায়নিক নিঃসৃত করে এবং ঘরে ঝুলকালি তৈরি করে। ফলে ঘরের ভেন্টিলেটর, এয়ারকন্ডিশনিং সিস্টেম এবং বাতাসে বিষাক্ত কণা মিশে যায়। সুগন্ধি মোমবাতিও তাই বিপজ্জনক।

আপনি কি জানেন, আমাদের ব্যবহৃত প্রায় ৯০ ভাগ সুগন্ধিই মূলত কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি? এইসব সুগন্ধি তৈরিতে ব্যবহৃত হয় টলুইন, বেনজাইল অ্যাসিটেট, লিমোনিন অ্যাসিটোন এবং ফেনলের মত ক্ষতিকর রাসায়নিক দূষক। কৃত্রিম সুগন্ধির স্বাস্থ্যঝুঁকি তাই ভয়াবহ। সুগন্ধি মোমবাতি নিঃসৃত টলুইন, বেনজিন হল অতি সক্রিয় জৈব যৌগ, যেগুলি ক্যান্সারের সাথে সম্পর্কিত। আরো যে সমস্ত রাসায়নিক মোমবাতি থেকে নিঃসৃত হয় যেমন ফরমালডিহাইড, সীসা, টিন, দস্তা, বেনজোপাইরিন, ন্যাপথালিন, অ্যাসিটালডিহাইড, অ্যাক্রোলিন, পলিক্লোরোডাইবেনজো-পি-ডায়োক্সিনস, পলিক্লোরোডাইবেনজোফিউরানস (পিসিডিডি এবং পিসিডিএফ), পলিক্রোমাটিক হাইড্রোকার্বনস (পিএএইচএস), অ্যালকিন, ওয়াক্স এস্টার অ্যালকানিক এবং অ্যালকিনোয়িক এসিড, অ্যালকিন ইত্যাদি সমস্তই বিষাক্ত।

মোমবাতি এবং ঘরের ভেতরের বাতাসের অবস্থা
ঝুলকালি ফুসফুসের ভেতরের নিম্ন শ্বাসনালী এবং অ্যালভিওলিকে আক্রান্ত করে। নিঃশ্বাসের সাথে মোমবাতির দূষক কণা এবং ক্যান্সারসৃষ্টিকারী পদার্থ গ্রহণের স্বাস্থ্যঝুঁকি ভয়াবহ। মোমবাতি নিঃসৃত বিষাক্ত পদার্থের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সাধারণ অ্যালার্জি, অ্যাজমা, বিঘ্নিত বয়ঃসন্ধি, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, দ্রুত রজঃবিরতি, ত্বক, চোখ, ফুসফুসের প্রদাহ এবং জীবনঘাতী ক্যান্সারের ঝুঁকি।

এনভায়রনমেন্ট প্রোটেকশন এজেন্সি (ইপিএ) কর্তৃক প্রকাশিত ২০০১ এর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বদ্ধ জায়গায় মোমবাতি পোড়ানোর ফলে ঘরে সীসার ঘনত্ব ইপিএ নির্ধারিত সীসার নিরাপদ সর্বোচ্চ মাত্রা অতিক্রম করে। মোমবাতির ধাতব সলতের ঝুলকালিতে বিষাক্ত সীসা উপস্থিত থাকে (সূত্র: United States EPA-600/R-01-001, Environmental Protection Agency, January 2001)

মোমবাতি বাছাই এবং স্বাস্থ্য বিবেচনা
আশার কথা, পেট্রোলিয়ামজাত প্যারাফিন-ভিত্তিক দূষক পদার্থ নির্গমনকারী মোমবাতি ব্যবহারের বিকল্প সমাধান রয়েছে। স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিবেচনায় সবথেকে ভালো মোমবাতির বৈশিষ্ট্য হল:

● মৌমাছি থেকে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক মোমের মোমবাতি এবং সয়ার মোমবাতি
● এতে তুলা বা কাগজের তৈরি সলতে ব্যবহৃত হয়, সেলুলোজের আবরণের মধ্যে থাকায় সলতের পড়ে যাওয়া প্রতিরোধ হয়
● মোমবাতিতে উদ্ভিদ এবং প্রাকৃতিক তেল থেকে পাওয়া সুগন্ধ ব্যবহৃত হয়, যা অ্যাজমা ঘটায় না বরং শরীরের উপকার করে

মৌমাছির মোমের মোমবাতি
মৌমাছি থেকে পাওয়া মোম, মোমবাতি তৈরির একটি প্রাকৃতিক এবং স্বাস্থ্যকর বিকল্প উপাদান। মৌমাছির মোমের মোমবাতির উত্তপ্ত শিখা মোমবাতি এবং সলতেকে সম্পূর্ণভাবে পোড়ায়। পাশাপাশি, ধীরে ধীরে, সমান ও অপচয়বিহীন ভাবে, পরিষ্কার, ধোঁয়াহীন, ঝুলকালিমুক্ত, জৈব উপজাতবিহীন উপায়ে জ্বলে। এছাড়াও, মৌমাছির মোমের মোমবাতি ঈষৎ মধু’র সৌরভ এবং উজ্জ্বল সোনালি আলো দেয়। এটি ঘরের বাতাস পরিষ্কার করে। অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী পদার্থ ও দুর্গন্ধ দূরে রাখে।

আরো পড়ুন: বায়ুদূষণে হ্রাস পায় বুদ্ধিমত্তা

সয়ার মোমবাতি খুঁজে দেখুন
প্রচলিত মোমবাতির আরেকটা বিকল্প সয়ার মোমবাতি। সয়ার মোমবাতিও পরিচ্ছন্ন ভাবে পোড়ে এবং এটি প্যারাফিন-ভিত্তিক মোমবাতির দারুণ বিকল্প। কীটনাশক-মুক্ত, নন-গ্রোথ-মোডিফাইড-অরগ্যানিজমস (নন-জিএমওস) পদ্ধতির সয়া গাছ থেকে প্রাপ্ত এই মোমবাতি পরিচ্ছন্ন এবং সহজে নবায়নযোগ্য। জেনেটিকালি মডিফায়েড জিএমও সয়া কীটনাশকপ্রবণ, উচ্চমাত্রায় পানি ব্যবহারকারী উদ্ভিদ। ফলে আরো বেশি খরা, শৈত্য এবং ছত্রাকসহিষ্ণু করার জন্য এতে বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু, এই কৃত্রিম রাসায়নিকের ব্যবহার উদ্ভিদটির প্রাকৃতিক রাসায়নিক ধর্মকে বদলে দিয়েছে।

মোমবাতি
মোমবাতির শিখা থেকে যেকোনো সময় অপ্রত্যাশিত অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে।

ফলে ক্রেতাদের কাছে কিন্তু এই রাসায়নিক ভাবে পরিবর্তিত সয়ার মোমবাতিই আসছে। অনুমান করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত সয়ার ৯১%ই কৃত্রিম। যতক্ষণ পর্যন্ত না সয়া মোমবাতিতে ইউএসডিএ কর্তৃক স্বীকৃত প্রাকৃতিক-মোমবাতির লেবেল আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ঐ মোমবাতি সম্পূর্ণ জৈব উপায়ে তৈরি প্রাকৃতিক মোমবাতি কিনা তা একদম নিশ্চিত হয়ে বলা সম্ভব না (উদাহরণ হিসেবে, এমনও হতে পারে মোমবাতিতে ১০% সয়াও নেই, অথচ ৯০% প্যারাফিন রয়েছে)।

পাম অয়েলের মোমবাতি
যদিও পাম অয়েলের মোমবাতি পরিচ্ছন্ন ভাবে পোড়ে, কিন্তু রেইনফরেস্ট ধ্বংসের জন্য পাম গাছ দায়ী হবার কারণে এটির ব্যবহার বিতর্কিত।

কার্যত, মৌমাছির মোম বা সয়া, যেকোনো পরিবেশবান্ধব মোমবাতিই উপভোগ্য পরিবেশ দেওয়ার সাথে সাথে ঘরের ভেতরে সতেজ সুন্দর হাওয়া নিশ্চিত করে।

আরো পড়ুন: নিত্য ব্যবহার্য্য রাসায়নিক পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা ধ্বংস করছে

ঘরে বা কাজের জায়গায় মোমবাতি জ্বালানোর জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ
সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর মোমবাতিও ভুলভাবে ব্যবহারে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। মোমবাতির শিখা থেকে যেকোনো সময় অপ্রত্যাশিত অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। মোমবাতি জ্বালানোর আগে তাই পূর্ব-সতর্কতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

দুর্ঘটনা এড়াতে মোমবাতি জ্বালানোর ক্ষেত্রে যে পরামর্শগুলি মানা প্রয়োজন

● ধোঁয়া এবং ঝুলকালি কমিয়ে আনতে মোমবাতির সলতে পৌনে ইঞ্চিমত কাটতে হবে।
● কেবলমাত্র তুলা বা কাগজের সলতেওয়ালা মৌমাছির মোমের মোমবাতি বা সয়ার মোমবাতি ব্যবহার করা উচিৎ।
● দরকার সুগন্ধিহীন মোম ব্যবহার, যদি সুগন্ধি ব্যবহার করতে‌ই হয় তবে মৃদু এসেনশিয়াল অয়েল ব্যবহার করা উচিৎ।
● বায়ু চলাচলের সুব্যবস্থা আছে কেবল এমন পরিবেশেই মোমবাতি জ্বালানো যেতে পারে।
● ক্যান্ডেল ওয়ার্মারস বা ডিফিউজারের মত বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ দরকার।
● কখনোই কোনো পরিস্থিতিতে জ্বলন্ত মোমবাতিকে নজরের বাইরে অসতর্কতায় ফেলে রাখা যাবে না।
● শিশু ও পোষা প্রাণীদের মোমবাতি থেকে দূরে রাখতে হবে। মোমবাতিও তাদের নাগালের বাইরে রাখা দরকার।
● মজবুত মোমবাতিদানি ব্যবহার করতে হবে।
● মোমবাতিকে দাহ্য এবং বিস্ফোরণযোগ্য পদার্থ থেকে দূরে রাখা উচিৎ।

কন্ডিশনড এয়ার সলিউশন অবলম্বনে সাব্বির পারভেজ সোহান