ইলন মাস্ক-এর টুইটার কেনার প্রস্তাব, অনেক দিন ধরেই যেটা নিয়ে কথা হচ্ছিল, অবশেষে গৃহীত হয়েছে।

বিলিওনিয়ার ইলন মাস্ক টুইটার কেনার জন্য ৪৪ বিলিয়ন ডলার দেবেন। পুরো হস্তান্তর এ বছরের শেষের মধ্যে সম্পন্ন হবে, গত সোমবার টুইটার-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়।

মাস্ক টুইটার কেনার জন্য এতই উঠেপড়ে লেগেছিলেন যে, তিনি এজন্য তার ‘বেস্ট এবং ফাইনাল অফার’ করেন।  তিনি আরো ঘোষণা দেন, তার পরিকল্পনা যদি কাজে না লাগে তবে তার কাছে ‘প্ল্যান বি’ আছে। আর সেটা হচ্ছে টুইটারের বড় বড় শেয়ারহোল্ডারের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ করে তাদেরকে এই ডিলের জন্য রাজি করানো।


র‍্যাচেল লার্মান
ওয়াশিংটন পোস্ট, ২৫ এপ্রিল ২০২২


মাস্ক টুইটারের প্রতি শেয়ারের জন্য ৫৪.২০ ডলার অফার করেন এবং সর্বমোট ৪৬.৫ বিলিয়ন ডলারে এই ডিল ফাইনাল করার প্ল্যান দেন। টুইটারের শেয়ারের দাম সোমবার সকালে হঠাৎ বেড়ে যায়, যখন শোনা যায় মাস্কের ডিল ফাইনাল হতে পারে।

তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মানুষ যার এর মধ্যে ইলেকট্রিক গাড়ি কোম্পানি টেসলা এবং এরোস্পেস কোম্পানি স্পেসএক্স আছে তিনি কেন সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানি কিনতে চাচ্ছেন?

 

কেন ইলন মাস্ক টুইটার কিনতে চেয়েছেন?
ইলন মাস্ক বলেন, তিনি টুইটার সার্ভিসে মুক্ত এবং খোলামেলা কথা বলার সুযোগ দিতে চান। তিনি মনে করেন, মত প্রকাশের জন্য এটা অপরিহার্য একটা  জায়গা।

টুইটার কেনার প্রস্তাব দেওয়ার কিছুদিন পর একটা টেড ইন্টারভিউতে তার প্ল্যানের কিছু বিষয় তিনি খুলে বলেন।

“আমি মনে করি সবাই স্বাধীনভাবে কথা বলবে এমন একটা জায়গা থাকা খুবই জরুরি”, মাস্ক বলেন। “টুইটার যেন একটা ডি ফ্যাক্টো টাউন স্কয়ার, তাই এটা খুবই জরুরি যে মানুষের একটা ধারণা যেন থাকে এবং সত্যিকারে এমন একটা জায়গা যেন থাকে যেখানে তারা আইনের মধ্যে থেকে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারে।”

মাস্ক অবশ্য বলেননি তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্থায়ী নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নিবেন কিনা। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে গত জানুয়ারির ৬ তারিখে টুইটার থেকে বের করে দেয়, ওয়াইট হাউজে তার সমর্থকদের হামলার ঠিক আগে।

আরো পড়ুন: ইউভাল নোয়াহ হারারি: প্রযুক্তি কেন স্বৈরাচারের পক্ষে

ট্রাম্পের সমালোচকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, মাস্ক হয়তো সাইটে কট্টরপন্থী কনটেন্ট অনুমোদন দেবেন। যেগুলিকে নির্মূল করতে টুইটার ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া সাইটগুলিকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মাস্ক নিজেও ইন্টারভিউতে স্বীকার করেন যে কন্টেন্ট মডারেশন কোনো সোজাসাপ্টা বিষয় না।

তিনি ভাবতেন স্থায়ীভাবে নিষেধ করার বিষয়ে টুইটারের আরো সাবধান হওয়া প্রয়োজন। টাইম আউট (কিছু সময়ের জন্য নিষেধ) করা তার কাছে বেশি ভালো পদ্ধতি মনে হয়।

“আমার মনে হয় যদি সন্দেহও থাকে, তারপরও আমাদের কথা বলতে দেয়া উচিত, জিনিষগুলি (টুইটারে) থাকা উচিত। কিন্ত যদি এটা ঘোলাটে কিছু হয়, আমি বলব তবুও টুইটগুলি থাকা উচিত। তবে যে সব বিষয়ে অনেক বিতর্ক আছে, আমার মনে হয় সেই টুইটগুলি প্রমোট করা উচিত হবে না। আমি বলছি না আমি আসলে সব কিছু জানি।”

তিনি বার বার বলেন, টুইটার তিনি টাকা কামানোর জন্য কেনেননি।

“আমার দৃঢ় অনুমান, ভবিষ্যৎ সভ্যতার জন্য এমন একটা পাবলিক প্ল্যাটফর্ম থাকা খুব প্রয়োজন যেখানে সবাই কথা বলতে পারে এবং যেটাকে সবাই বিশ্বাস করে।” তিনি বলেন, “আমি অর্থনীতি নিয়ে পাত্তাও দেই না।”

 

মাস্ক টুইটারে কত জলদি পরিবর্তন নিয়ে আসবেন
সম্ভবত খুব জলদি না। এখনো কোম্পানি হস্তান্তর শেষ হয়নি, এটি শেষ হতে কয়েক সপ্তাহ এমনকি কয়েক মাসও লেগে যেতে পারে।

ফেডারাল আইন অনুযায়ী, মাস্ককে ফেডারাল ট্রেড কমিশনের রেগুলেটরদের ও জাস্টিস ডিপার্টমেন্টকে টুইটার কেনার পরিকল্পনার বিষয়ে নোটিফাই করতে হবে। যদি রেগুলেটর এই ডিলের বিষয়ে রিভিউ শুরু করেন, তবে আরো সময় লাগতে পারে।

এরপর, মাস্ক কথা দিয়েছেন টুইটারকে তিনি প্রাইভেট করবেন। তিনি বিড করার সময় সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে একটা ফাইলিংয়ে বলেন, “এখানে বিনিয়োগ করার পর আমি বুঝতে পেরেছি বর্তমান অবস্থায় টুইটারের পক্ষে না বড় হওয়া সম্ভব, না, এর পক্ষে সমাজকে কিছু দেওয়া সম্ভব। টুইটারকে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে পরিবর্তিত হতে হবে।”

আরো পড়ুন: নেটফ্লিক্সের ফেসবুক ও গুগল বিরুদ্ধতার ‘মার্কেট’

মাস্ক বলেন টুইটারকে প্রাইভেট করার সময় তিনি আইনের মধ্যে থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক শেয়ারহোল্ডার রাখতে চান। তিনি এখনো ঘোষণা দেননি নেতৃত্বে কাদের রাখবেন অথবা এর বোর্ড অফ ডিরেক্টর কেমন হবে। অর্থাৎ টুইটারে মাস্ক কতখানি কর্তৃত্ব খাটাতে চান সে বিষয়ে এখনও অনেক খোলামেলা প্রশ্ন আছে।

 

টুইটারে এডিট বাটন নিয়ে আসার বিষয়ে মাস্ক কী বলেন
টুইটারের কাছে এর ইউজারদের সবচেয়ে বেশি অনুরোধ আসে এখানে এডিট-এর অপশন দেয়ার জন্য। একবার ভাবুন, আপনি ২৮০ ক্যারেক্টারের চমৎকার একটা টুইট লিখে পোস্ট করলেন, আর পোস্ট করার পরই আপনার চোখে একটা ভুল বানান ধরা পড়লো।

টুইট পুরোপুরি ডিলিট না করে এখানে এডিট করার সুযোগ নেই। একবার মাস্ক তার ফলোয়ারদের জিজ্ঞেস করেন তারা টুইটারে এডিট বাটন চায় নাকি। মোট ৪ মিলিয়ন ভোটারের মধ্যে ৭৩.৬ শতাংশ বলেছে তারা এডিট বাটন চায়।

এর পরের দিন টুইটারের কমিউনিকেশন টিম একটা টুইটের মাধ্যমে নিশ্চিত করে, তাদের কোম্পানি এরই মধ্যে এডিট করার ফিচার নিয়ে কাজ করছে।

“না, আমরা এর আইডিয়া কোন পোলের (ভোটের) মাধ্যমে পাইনি”, একটা চোখ টেপার ইমোজিসহ পোস্ট করা হয় টুইটটি।

—সবাই যেহেতু জিজ্ঞেস করছে…

—হ্যাঁ, আমরা এডিট ফিচার নিয়ে গত বছর থেকে কাজ করছি

—আর না, আমরা এই আইডিয়া কোন পোল (ভোট) থেকে পাইনি 🙂

আমরা সামনের মাসগুলিতে টুইটার ব্লু ল্যাবে টেস্ট করা শুরু করবো কোনটা কাজ করে, কোনটা করে না আর কী করা সম্ভব।

এলন মাস্কটুইটারের অ্যালগরিদম আরো উন্মুক্ত করার বিষয়ে মাস্ক কী বলেন
মাস্ক বলেন তিনি টুইটারের অ্যালগরিদমে আরো স্বচ্ছতা আনতে চান। যেমন তিনি মানুষকে জানাতে চান তাদের টুইট কি ডিমোটেড (কম প্রচার করা) অথবা প্রমোটেড (বেশি প্রচার করা) হচ্ছে কিনা। তিনি বলেন, তিনি চান এমন এলগরিদম তৈরি করতে যেটা ‘ওপেন সোর্স’ উপায়েই রেকমেন্ড করবে একটা টুইট প্রমোটেড অথবা ডিমোটেড হয়েছে কিনা। মানুষ নিজেই দেখতে পাবে কীভাবে তার টুইটকে আরো ভালো করতে পারে। মাস্কের বিশ্বাস এভাবে ‘পর্দার আড়ালে কারসাজি’ কমে যাবে।

আরো পড়ুন: বিশ্বের প্রথম থ্রি-ডি প্রিন্টেড আবাসিক এলাকা হচ্ছে মেক্সিকোতে

গবেষকদের মতে মাস্কের এই প্ল্যান আসলে অনেক বেশি জটিল। অবশ্য টুইটার বিষয়টি এরই মধ্যে গুরুত্ব দিচ্ছে।

ইলন মাস্ক টুইটারের অ্যালগরিদম পাবলিক করতে চান। বিষয়টা এত সহজ না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে টুইটারের এক সাবেক কর্মী এই বিষয়ে বলেন, টুইটার একটা অ্যালগরিদম মার্কেটপ্লেস চিন্তা করছে যেখানে ইউজাররা তাদের ফিডের বিভিন্ন রকম ভিউ পছন্দ করতে পারবে। কিন্ত এতে আরো স্বচ্ছতা আনা বেশ চ্যালেঞ্জিং। তার কারণ হচ্ছে টুইটারের অন্যান্য বিষয়ের সাথে এর অ্যালগরিদম জড়িত। তাই উন্মুক্ত করে দিলে ব্যবসার অনেক সিক্রেট ফাঁস হয়ে যাবে এবং অনেক সমালোচনা তৈরি হবে।

টুইটারে আপনার ব্যক্তিগত মেসেজ এবং ডেটার কী হতে পারে
এটা এখনো পরিষ্কার না, মাস্ক কোম্পানির প্রাইভেসি পলিসিতে কোনো পরিবর্তন আনবেন কিনা। তিনি এখনো কোনো পরিবর্তন আনার ঘোষনা দেননি। তিনি যদি ইউজার ডেটার সুরক্ষায় ছাড় দেন, তাকে অনেক বাধার মুখে পড়তে হবে। তার অন্য দুটি কোম্পানি টেসলা আর স্পেসএক্স-এর চেয়ে টুইটার থেকে তিনি আরো বেশি সংবেদনশীল ইউজার ডেটা পাবেন।

টুইটারে ডিরেক্ট মেসেজ এনক্রিপ্ট করা থাকে না, তার মানে এগুলির সুরক্ষা কম এবং কোম্পানির ভেতরের মানুষের জন্য তা দেখা কঠিন কিছু না। যদিও টুইটারে অপশন রাখা আছে মেসেজ মুছে ফেলার, তবে সেটা কেবল ইউজারের নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে মুছে ফেলার। মেসেজ যাকে পাঠানো হয়েছে তার কাছে ঠিকই রয়ে যায়। এর অর্থ টুইটারের সার্ভার থেকে মেসেজ চলে যায় না।

মাস্কের নিজের ডিরেক্ট মেসেজও অনেক সময় পাবলিক হয়ে গেছে। গত বছর এক টিনএজারের অ্যাকাউন্ট থেকে মাস্কের প্রাইভেট জেট প্লেন ট্র্যাক করা হলে মাস্ক তাকে ৫০০০ ডলার বিনিময়ে সেই অ্যাকাউন্ট নামিয়ে দিতে বলে। যদিও টিনএজারটি রাজি হয়নি। আর এই সব কিছু ফাঁস হয়ে গিয়েছিল।

অনুবাদ: আমিন আল রাজী