চীনা বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি প্রথমবারের মতো কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) থেকে কৃত্রিমভাবে শ্বেতসার সংগ্রহের একটি নিরাপদ ও অভিনব উপায় উদ্ভাবন করেছেন। গত ২৪ সেপ্টেম্বর ‘সায়েন্স’ জার্নালে তাদের গবেষণার প্রাসঙ্গিক ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে।

এই উদ্ভাবনের ফলে কৃষি পদ্ধতির বদলে শ্বেতসার এখন ব্যাপকহারে শিল্প কারখানায় উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এবং এর ফলে কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে থেকে জটিল অণু সংশ্লেষণের একটি নতুন প্রযুক্তিগত পথও খুলে গেল।

স্টার্চ বা শ্বেতসার শস্যের প্রধান উপাদান এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প কাঁচামাল। বর্তমানে, এটি প্রধানত ভুট্টার মতো ফসলের মাধ্যমে উৎপাদিত হয়, যেখানে প্রাকৃতিক সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে কার্বন ডাই অক্সাইড জমা হয়। প্রাকৃতিক এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ৬০ ধরনের জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া এবং জটিল শারীরবৃত্তীয় নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া জড়িত। তাত্ত্বিক ভাবে এই প্রক্রিয়ার শক্তির রূপান্তর দক্ষতা মাত্র ২%।

অন্যদিকে, খাদ্য সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো মানবজাতির প্রধান সমস্যাগুলি কাটিয়ে ওঠার জন্য অবিলম্বে শ্বেতসারের স্থিতিশীল/টেকসই সরবরাহ এবং কার্বন ডাই অক্সাইড ব্যবহারের সহজ কৌশল উদ্ভাবন জরুরি হয়ে পড়েছে। কার্বন ডাই অক্সাইডকে শ্বেতসারে রূপান্তরিত করার জন্য উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ ছাড়া নতুন কোনো অভিনব উপায় আবিষ্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং উদ্ভাবনী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মিশন এবং বর্তমান বিশ্বে তা একটি উল্লেখযোগ্য যুগান্তকারী প্রযুক্তি হবে।

এই সমস্যা সমাধানের জন্য, চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সেস (সিএএস) এর তিয়ানজিন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল বায়োটেকনোলজির (টিআইবি) বিজ্ঞানীরা একটি কেমোএনজাইমেটিক পদ্ধতির পাশাপাশি কৃত্রিমভাবে শ্বেতসার উৎপাদনের একটি অ্যানাবলিক রুট/উপায় উদ্ভাবন করেছেন, যাতে কেবলমাত্র ১১টি মূলগত রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমেই কার্বন ডাই অক্সাইডকে শ্বেতসারে রূপান্তরিত করা সম্ভব হবে।

এই রুট/উপায় একটি ‘বিল্ডিং ব্লক’ বা ‘নির্মাণ ইউনিট’ কৌশলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে গবেষকরা রাসায়নিক এবং জৈবিক বিভিন্ন অনুঘটক মডিউলগুলিকে সংহত করে উচ্চ-ঘনত্ব শক্তি এবং উচ্চ-ঘনত্ব কার্বন ডাই অক্সাইড একটি জৈবপ্রযুক্তিগত উদ্ভাবনী উপায়ে ব্যবহার করেন।

গবেষকরা স্তরীয় প্রতিযোগিতা, পণ্যের নিরোধ এবং তাপগতিবিদ্যাগত অভিযোজনের মতো সমস্যার সমাধান করে স্থানিক এবং সাময়িক বিচ্ছিন্নতা ব্যবহার করে পদ্ধতিগতভাবে এই হাইব্রিড সিস্টেমের অপ্টিমাইজ বা সবচেয়ে কার্যকর ব্যবহার করেন।

কৃত্রিম এই রুট/উপায় ভুট্টায় জৈব সংশ্লেষণের মাধ্যমে শ্বেতসার উৎপাদনের চেয়ে ৮.৫ গুণ বেশি দক্ষতার সাথে কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে শ্বেতসার তৈরি করতে পারে। যা প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ হবে। এটি অভূতপূর্ব কিছু ফাংশন/কার্যকারিতা সহ জৈবিক পদ্ধতি তৈরির একটি নতুন বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও দেয়।

গবেষণার প্রধান লেখক কাই তাও বলেন, “বর্তমান প্রযুক্তিগত প্যারামিটার অনুসারে, তাত্ত্বিকভাবে এক-ঘনমিটার বায়োরিয়েক্টরে কৃত্রিমভাবে এক বছরে যে পরিমাণ শ্বেতসার উৎপাদন করা সম্ভব তা বছরে ১ থেকে ৩ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ থেকে উৎপাদিত শ্বেতসারের সমান। এ ছাড়া ভুট্টার চাষে যে জ্বালানি খরচ আছে তার হিসাবও আছে।”

এই উদ্ভাবন কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে শ্বেতসারের শিল্প উৎপাদনের দরজা খুলে দেবে।

এমএ ইয়ানহে নামে গবেষণাপত্রের একজন সহলেখক বলেন, “ভবিষ্যতে যদি এই প্রক্রিয়ার সামগ্রিক খরচ কৃষি চাষাবাদের পর্যায়ে কমিয়ে আনা যায়, তাহলে চাষযোগ্য জমি এবং মিঠা পানির উৎসের ৯০%-এরও বেশি বেঁচে যাবে বলে আশা করা যায়।”

এ ছাড়াও, কীটনাশক এবং সার ব্যবহারের ফলে পরিবেশের ওপর যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তা থেকে বাঁচতে, মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা আরো উন্নত করতে, কার্বনমুক্ত জৈব অর্থনীতি গড়ে তুলতে এবং অবশেষে একটি টেকসই জৈব-ভিত্তিক সমাজ গঠনে সহায়তা করবে এই পদ্ধতি।

তিয়ানজিন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল বায়োটেকনোলজি (টিআইবি) ২০১৫ সাল থেকেই কৃত্রিম শ্বেতসার জৈব সংশ্লেষণ এবং কার্বন ডাই অক্সাইড ব্যবহারের উপায় উদ্ভাবনে মনোনিবেশ করেছে।

আরো পড়ুন: টমেটোর স্বাদ বাড়াবে যে জিনগুলি তার খোঁজ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা

এই ধরনের চাহিদা-ভিত্তিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণা চালানোর জন্য উদ্ভাবনের সব ধরনের সম্পদ একত্রিত করা হয়েছে এবং গবেষণা প্রচেষ্টাগুলি দক্ষভাবে সমন্বয় করার জন্য ‘শৃঙ্খলা, কাজ এবং প্ল্যাটফর্ম’ সংহত করার প্রক্রিয়াকেও শক্তিশালী করা হয়েছে।

চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সেস (সিএএস) এর প্রধান গবেষণা প্রোগ্রাম এবং তিয়ানজিন সিনথেটিক বায়োটেকনোলজি ইনোভেশন ক্যাপাসিটি ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট এই গবেষণায় সার্বিক সহায়তা করছে।

সূত্র. ইউরেকালার্ট । অনুবাদ: মাহবুবুল আলম তারেক