মাত্র ৩০ সেকেন্ডে বায়োলজিক্যাল টিস্যু প্রিন্ট করার অভিনব এক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে ‘রেডিলি থ্রিডি’ নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সুইজারল্যান্ডের ল্যুজান শহরে অবস্থিত ‘সুইস ফেডেরাল ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি’র বেশ কিছু গবেষক মিলে গত বছর প্রতিষ্ঠা করেন ‘রেডিলি থ্রিডি’ প্রতিষ্ঠানটি।

ইউরোপে চলমান বড় একটি প্রকল্পের অংশ হিসেবে নতুন নতুন ওষুধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্যে অগ্ন্যাশয়ের একটি জীবন্ত মডেল তৈরি করার কাজ চলছে। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবেই টিস্যু প্রিন্ট করার এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে ‘রেডিলি থ্রিডি’।

রেডিলি থ্রিডি’র বায়োপ্রিন্টার ‘টমোলাইট’

বায়োলজিক্যাল টিস্যু প্রিন্ট করার সময় প্রথমে কম্পিউটারের পর্দায় মানব অগ্ন্যাশয়ের একটি ছোট্ট ইলেক্ট্রনিক প্রতিলিপি দেখা যাবে। এই পর্যায়ে এটিকে একটি স্বচ্ছ কাঠামোর মত দেখাবে। মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই মানুষের স্টেম কোষের একটি নমুনা থেকে বায়োপ্রিন্টারে রক্তনালী ও অন্যান্য সব অঙ্গাণুসহ টিস্যুটি প্রিন্ট হয়ে যাবে।

এই অসাধারণ পদ্ধতিটি সম্ভব করে তোলার পেছনে মূল ভূমিকায় আছে ‘সুইস ফেডেরাল ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি’র ‘ল্যাবরেটরি অফ অ্যাপ্লাইড ফটোনিকস ডিভাইসেস’ (এলএপিডি) এর তৈরি একটি বৈপ্লবিক নতুন প্রযুক্তি। ‘রেডিলি থ্রিডি’ এই প্রযুক্তিকে আরো বিকশিত করেছে।

সম্প্রতি এই প্রযুক্তিটি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থায়নে চলমান ‘এনলাইট’ নামক একটি প্রকল্পে ব্যবহারের জন্যে নির্বাচন করা হয়েছে। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো ডায়াবেটিস-এর ওষুধ পরীক্ষায় ব্যবহার করার জন্যে অগ্ন্যাশয়ের একটি নির্ভরযোগ্য জীবন্ত মডেল তৈরি করা।

অগ্ন্যাশয় পাকস্থলীর ঠিক পিছনে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটি হজমের জন্যে প্রয়োজনীয় এনজাইম এবং বাইকার্বনেট উৎপাদন করার মতো বিভিন্ন ধরনের শারীরবৃত্তীয় কাজ করে থাকে। এছাড়াও রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে এটি ইনসুলিন সহ বিভিন্ন ধরনের হরমোন নিঃসরণ করে। ফলে অগ্ন্যাশয়জনিত রোগ থেকে প্রায়শই ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কারণ অগ্ন্যাশয়ের রোগে ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলি আর শরীরের জন্যে প্রয়োজনীয় ইনসুলিন উৎপাদন করতে পারে না।

বিশ্বে প্রায় ৪৫ কোটির চেয়েও বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।

সারাবিশ্বে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষের অঙ্গহানির ঘটনা ঘটে। এজন্য প্রথমত ও প্রধানত বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা দায়ী। তবে অঙ্গহানি যেসব কারণে ঘটে, তার মধ্যে দুর্ঘটনার পরেই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে ডায়াবেটিস। অর্থাৎ ডায়বেটিসের ফলে প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে বহু মানুষ নিজেদের প্রয়োজনীয় অঙ্গ হারায়।

এছাড়াও ডায়াবেটিস হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের আশঙ্কা ৮ গুণ পর্যন্ত এবং কিডনি ফেইলিওর-এর আশঙ্কা ৯ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে তোলে। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অন্ধত্বের জন্যেও প্রধানত দায়ী ডায়াবেটিস। তাই জনস্বাস্থ্য খাত এগিয়ে নিতে ডায়বেটিস নির্ণয় ও চিকিৎসা পদ্ধতিকে উন্নত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।

‘সুইস ফেডেরাল ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি’তে তৈরি বায়োপ্রিন্টিং প্রযুক্তিতে একজন রোগীর স্টেম কোষযুক্ত জৈবিক জেল ব্যবহার করা হয়। জেলটিকে পলিমারাইজেশনের মাধ্যমে আরও ঘন করতে লেজার প্রয়োগ করা হয়। এক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত টিস্যু গঠনের জন্যে জেলের যে অংশগুলি প্রয়োজন, শুধু সেটুকুই ঘন করে তোলার জন্যে লেজার বিমের অবস্থান ও তীব্রতা নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে।

‘রেডিলি থ্রিডি’র চিফ টেকনোলজি অফিসার (সিটিও) পল ডেলরট-এর ভাষ্যমতে, “আমাদের পদ্ধতির একটি প্রধান সুবিধা হলো এটি একক ব্লকে টিস্যু তৈরি করতে পারে, যা নরম টিস্যুতে তৈরি অঙ্গ প্রিন্ট করার জন্যে সুবিধাজনক।”

বায়োপ্রিন্টেড টিস্যুর অসংখ্য সুবিধা রয়েছে। এটি পরিকল্পিত পরিসরে তৈরি করা যেতে পারে। কারণ এটি রোগীর নিজস্ব স্টেম সেল থেকে তৈরি হয়েছে। এছাড়াও এটি ব্যবহারের আগে কোনো প্রাণীর ওপরে পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজন হয় না।

অনেক সময় প্রয়োজনীয় ও কার্যকর একটি ওষুধ খুঁজে বের করার জন্যে রোগীদের অসংখ্য ওষুধ পরীক্ষা করে দেখতে হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে একাধিক ওষুধ নিজেদের উপরে প্রয়োগের পরেই কেবল কার্যকর ওষুধটি খুঁজে পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে অনেক সময় ওষুধের অপ্রীতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার শিকার হতে হয়।

‘সুইস ফেডেরাল ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি’ ও ‘রেডিলি থ্রিডি’র নতুন আবিষ্কৃত এই প্রযুক্তি এই সমস্যা থেকে রোগীদের মুক্তি দিবে।

‘ল্যাবরেটরি অফ অ্যাপ্লাইড ফটোনিকস ডিভাইসেস’ (এলএপিডি)-এর প্রধান ক্রিস্টোফ মোসার-এর মতে, “কিউবিক সেন্টিমিটার স্কেলে থ্রিডি টিস্যু প্রিন্ট করতে সক্ষম এবং নির্ভরযোগ্যভাবে জীবন্ত অগ্ন্যাশয়ের কার্যকারিতার প্রতিরূপ তৈরি করতে পারে, এমন একটি প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। আমরা আশা করি, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা তা অর্জন করতে পারবো।”

এছাড়াও ভবিষ্যতে ক্যান্সারের মতো বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় অন্যান্য টিস্যুর বায়োপ্রিন্ট তৈরিতে তাদের এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হতে পারে। এছাড়াও ট্রান্সপ্ল্যান্ট অর্গান তৈরিতেও এই প্রযুক্তি কাজে লাগানো যেতে পারে।

প্রযুক্তিটি যেই প্রকল্পের জন্যে নির্বাচিত হয়েছে, সেই এনলাইট প্রকল্প আগামি ৩ বছরের মধ্যে অগ্ন্যাশয়ের প্রথম জীবিত মডেল তৈরির জন্যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ‘হরাইজন ২০২০ ফ্রেমওয়ার্ক প্রোগ্রাম’ থেকে ৩.৬ মিলিয়ন ইউরো তহবিল পেয়েছে। নেদারল্যান্ডের গবেষণাকেন্দ্র এবং হাসপাতাল ‘ইউএমসি উট্রেখট’-এর নেতৃত্বে একটি ক্রস-ডিসিপ্লিনারি কনসোর্টিয়ামের অধীনে প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছে।

এই প্রকল্পের সাথে আরো যুক্ত আছে সুইজারল্যান্ডের ‘সুইস ফেডেরাল ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি’ এবং ইটিএইচ জুরিখ, ইতালির ‘সেকেন্ড ইউনিভার্সিটি অব নেপলস ফেডেরিকো’, সুইডেনের ‘অ্যাস্ট্রাজেনেকা’, বেলজিয়ামের ‘রুসেলোট’, সুইজারল্যান্ডের ‘রেডিলি থ্রিডি’ এবং ইতালির জিয়ান্নিও বাসেত্তি ফাউন্ডেশন।