এইটা কামরাঙ্গির চরে থাকতে তোলা ছবি। ভোর পার হয়ে সকাল শুরু হইতেছে এইরকম সময়ে। বুড়িগঙ্গার তীরে। মাতবর বাজার ঘাট থেকে একটু আগে-পিছে কোনো একটা জায়গায়।

শীতকাল হবে তখন। প্রায়শই নদীতীরের রাস্তাটা ধইরা আমি হাঁটতে যাইতাম। রাস্তাটা চমৎকার। অনেক বাতাস পাওয়া যায়। তাই বিকালে বা সন্ধ্যায় লোকে লোকারণ্য থাকে। কিন্তু সকলেই কেমন হাল্কা মেজাজে নড়াচড়া করে, তাই খারাপ লাগে না। নিম্ন মধ্যবিত্তদেরই পরিমাণ বেশি। তাদের রঙবেরঙের জামাকাপড়৷ গলা উঁচু। গায়ে-পায়ে হালকা-পাতলা এবং অত্যন্ত অ্যানার্জেটিকও বটে। অবসরের টাইমটা এদের কাছে একদম অবসরের টাইমই। তখন মানসিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব আপডাউনের তেমন জায়গা আছে বইলা দূর থেকে মনে হয় না। যদিও তা থাকারই কথা। কিন্তু ঐসব প্রকাশভঙ্গি হয়ত আমার অবজার্ভেশনের আওতার বাইরেই। সুতরাং সবসময় তাদের একই রকম লাগে। তখনকার সময়ে আমি যেরকম ছিলাম, তার একদম উল্টাটা।

আমার তখন পুরাটাই অবসর। কাজও নাই, টাকাও নাই, সেগুলার ব্যাপারে দৌড়াদৌড়িও করি না। মনে আছে, রাত্রিবেলা ১০ টাকায় ডিনার করা যাইত এই কামরাঙ্গির চরে। বড় একটা তন্দুর রুটি, আর একবাটি সবজি। খারাপ না, যথেষ্ট ভাল। আমি শুধু বিপদে থাকতাম আমার মিনিটে-মিনিটে সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস নিয়া। অনেক ব্যয়বহুল ব্যাপার, অথচ এইটা না হইলেও আমি একদম অচল। তবে কোনোভাবে অতটুকু জুইটাও যাইত, আর আমিও শুধু একটু ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বুড়িগঙ্গার পাড় ধইরা হাঁটাহাঁটি করতে পারলেই খুশি। মূলত বাঁধের রাস্তাটা। এইমাথা থেকে ঐমাথা। আর ঐমাথা থেকে এইমাথা। কত দৃশ্য। একই দৃশ্য যদিও, তবুও তা দেখতে না দেখতেই মস্তিষ্ক অন্য কোথাও চলে যাইতে চেষ্টা করে। তাই বার বার কইরা দেখতেই থাকতে হয়।


ছবির গল্প
মনজুরুল আহসান ওলী


সবচে ভাল হইত ভোর থেকে সকাল পর্যন্ত যে সময়টা। বেলা ওঠার আগপর্যন্ত আরকি। খুব কম লোক থাকত তখন। অল্প কিছু পারাপারের যাত্রী, তারা তো আর কেউ রাস্তায় স্থায়ী হচ্ছে না। আসতেছে আবার যাইতেছে গা। কিছু দোকানদার, আর তাদের সামান্য কয়টা কাস্টমার। সুন্দর একটা নাস্তা খাওয়ার দোকান পাইছিলাম এইরকম। নদীর দিকে পিঠ দেওয়া, বাঁশ দিয়া বানানো উঁচু মাচার উপরে স্থাপিত। খুদচালের খিচুড়ি বেচত ওরা, মা আর ছেলে। সাথে কালিজিরা ভর্তা, শুটকি ভর্তা, পেঁয়াজ-মরিচের ভর্তা আর ডিমভাজা। গরম গরম খাইতে পারলে একদম অমৃতের মত লাগত। দাম ভুলে গেছি, তবে খুব অল্পই। খুবই অল্প। সকাল-সকাল সস্তায় অত সুন্দর ব্রেকফাস্ট করতে পারলে আর কী লাগে বলেন।

আমি ভোরের দিকেই রওনা দিছিলাম বোধহয় ঐদিন, এই ছবিটা যেইদিন তোলা। ঐ দোকানটাতে গিয়া নাস্তা করব এইরকম একটা ইরাদা ছিল। নদী পর্যন্ত পৌঁছাইতে পৌঁছাইতে ভোর আর থাকল না, তবে শীতের সময় হওয়াতে তখনও আলো অনেক নরম, পুরাটুকু কুয়াশাও তখনও মুইছা যায় নাই। ঈষদুষ্ণ আলোর অনেক রকম রিফ্র্যাকশন তাই খুব মায়াবি লাগতেছিল। নদী কিছুটা ধরতেছে, ঐ পাড়ের হাল্কা কুয়াশা কিছুটা ধরতেছে, এমনকি এই বাঁধের পাকা রাস্তাও কিছুটা ধরে রাখতেছে। সোনালি হলুদ, গাঢ় হলুদ, ঈষৎ কমলা, আর সামান্য সবুজ সবুজ ভাব।

আমি দেখতেছিলাম। এখনো সেই দেখা শেষ হয় নাই। এখনো যখন ঐ জায়গায় যাওয়া হয়, দেখতেই থাকি। আর আমার অত্যন্ত ইনকমপ্রিহেনসিবল মনে হইতে থাকে এই দৃশ্যজগৎকে। বিষয়টা, উদ্ভটভাবে বললে, আরামদায়ক ভাবে অস্বস্তিকর। জীবনভর আলস্য যাপনের পক্ষে অপযুক্তি খুঁজতে শুরু করে আমার মস্তিষ্ক। পাশাপাশি এর জন্যে ভিতরে-ভিতরে একটু ক্ষিপ্তও হয়। দৃশ্যজগতের এই এক খেলা। স্থির হয়ে তা মাথার ভিতরে জমতে থাকে, কিন্তু মুহূর্তে মুহূর্তে সেগুলা আবার বদলায়ে যাচ্ছে বাইরের পৃথিবীতে। আমার মনে হয় একধরনের মেকানিক্যাল সমস্যার মুখামুখি হই তখন আমরা। এবং সম্ভবত শুধু মানুষ নয়, বরং অন্যান্য প্রাণীরাও একই ভাবে তা অনুভব করতে পারে।

যেমন এই ছবিটা একটা কুকুরের। নাস্তা খাওয়ার আগেই তুলছিলাম না পরে, তা আর এখন বলতে পারতেছি না। কিন্তু খুব খুশিমনে তুলছিলাম সেইটা স্পষ্ট মনে আছে। আমার ধারণা ছবিটার মধ্যেও সেই ব্যাপারটা রয়ে গেছে। উচ্ছ্বাসমুখর কিছু না, তবে মিহি একধরনের তৃপ্তির ভাব। একটা হারমনির কথা বলতে চাচ্ছি আমি হয়ত। সেইটা এই কুকুরটার দেহভঙ্গির ভিতরেও তখন ছিল। আলস্যমণ্ডিত, তবু উন্মুখ। এমনকি ওর চোখেমুখেও, এই ছবিতে যদিও তার চোখমুখ দেখা যাচ্ছে না। বরং ওর সেলুয়েট ফিগারের নিচে মাটির যে অংশটা আছে, ঐটাই আমার কাছে ছবিটা তোলার পরে সবথেকে বড় আকর্ষণ হয়ে দেখা দিছিল। আর পাশের গাছটার যতটুকু দেখা যাচ্ছে, আর একটু বাঁশের স্ট্রাকচার, সব মিলায়ে একটা চিরবাস্তব সকালবেলার চিরপরিচিত আবেগ আমি টের পাচ্ছিলাম। যেন এইখানে থেকে জাম্পকাট দিয়ে যদি একহাজার বছর পরের কোনো অন্যরকম সভ্যতার মধ্যেও ঢুইকা পড়ি, সবই যেইখানে কাচের বানানো, বা সবই ঝলমল-করা অন্যরকম কোনো ধাতু, তবু পিছনের এই দৃশ্যটা বেমানান লাগবে না। এমনকি প্রানীরাও সবই যদি তখন অন্যরকম হয়, তবুও না।

অনেকেই আপনারা চেনেন ঐ রাস্তাটা, অনেকবার গেছেনও হয়ত। তারপরেও বলি, কোলাহল যখন কম থাকে, তখন ঐ নদীতীরবর্তী রাস্তাটা এমনকি কুকুর-বিড়ালদেরকেও অভিভূত করে। আমি সাক্ষী। ভোরের দিকে যদি যাইতে পারেন, হয়ত আপনি ঐরকম কোনো একটা বিড়াল-টিড়াল দেখতে পাবেন। যাকে দেখলে মনে হবে, এই চমৎকার নদীতীরে আসতে পারায়, থাকতে পারায়, সে অত্যন্ত স্নিগ্ধভাবে খুশি হয়ে বইসা রইছে।

ছবি. মনজুরুল আহসান ওলী, কামরাঙ্গির চর, বুড়িগঙ্গা, ২০/১/২০১৮