ভ্যাকসিন হচ্ছে এক ধরনের ওষুধ, যা শরীরকে ভবিষ্যৎ রোগের বিরুদ্ধে প্রস্তুত করে। শত শত বছর ধরে ভ্যাকসিন মানুষের জীবন রক্ষা করে আসছে।

মানুষের শরীর যাতে ভবিষ্যতে রোগের হাত থেকে নিজেকে প্রতিরোধ করতে পারে, সেজন্য ভ্যাকসিন মানুষের শরীরকে প্রস্তুত করে তোলে।

মানুষ অসুস্থ হলে আমরা তাদের ওষুধ দেই, কিন্তু ভ্যাকসিন দেয়া হয় সুস্থ মানুষদের। এই একটি মাত্র কারণেই ভ্যাকসিনকে নানান ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

ভ্যাকসিন শরীরের মধ্যে এক ধরনের ছদ্ম বা নকল সংক্রমণ তৈরি করে। এটা সত্যিকারের কোনো সংক্রমণ না। কিন্তু এই সংক্রমণই আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শেখায় কীভাবে পরবর্তীতে একই ধরনের প্যাথোজেন বা জীবাণুকে চিহ্নিত করে নিষ্ক্রিয় করতে হবে।

যদি আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসের পুনরুৎপাদন বন্ধ করতে পারে, তাহলে ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে এমন লোকদের প্রতি এই ভাইরাস আর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে না।

এই কৌশল ব্যবহার করে আমরা শত শত বছর ধরে অনেক ভ্যাকসিন তৈরি করেছি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চীন ও ভারতের লোকেরা নিজেদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এভাবে শক্তিশালী করে তুলেছে।

১৭ শতকের প্রথম দিকে লোকেরা “ভেরিওলেশন” নামের একটি পদ্ধতিতে ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের সন্তানদেরকে গুটিবসন্তের অল্প ডোজ দিয়ে তাদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটাত। শতকরা দুই থেকে তিন ভাগ ক্ষেত্রে ভেরিওলেশন-এর পরিণতি মারাত্মক হতো। কিন্তু এটা শিশুদেরকে সংক্রামক গুটিবসন্ত রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী করে তুলত, যা শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ ক্ষেত্রে ভয়াবহ আকার ধারণ করত।

১৭১৭ সালে তুরস্কে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী লেডি মেরি মন্টেগু এই কৌশলটির সঙ্গে ব্রিটিশ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলির পরিচয় ঘটিয়ে দেন। পদ্ধতিটি তিনি অটোম্যান চিকিৎসকদের কাছ থেকে শিখেছিলেন। এবং তারপর তিনি নিজের সন্তানদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্যে পদ্ধতিটি প্রয়োগ করেছিলেন।

লেডি মেরি ওয়ার্টলি মন্টেগু ও তার ছেলে (ক্যানভাসে তেল, ১৭১৭)

তারও কয়েক দশক পরে চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার জানতে পেরেছিলেন যে, ব্রিটেনের দুগ্ধ খামারগুলিতে কাজ করা শ্রমিকরা গুটিবসন্ত বা স্মলপক্স-এর বিরুদ্ধে আরো নিরাপদ একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা আবিষ্কার করেছে। এটা করা হতো মানুষের শরীরে গো-বসন্ত বা কাউপক্স-এর জীবাণু প্রয়োগ করার মাধ্যমে। গুটিবসন্তের চেয়ে একটু কম ভয়ানক এই গো-বসন্ত নামক রোগটি সমগোত্রীয়। ফলে গো-বসন্তের জীবাণু গুটিবসন্তের বিরুদ্ধেও মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে।

জেনার এই তথ্যটি পরীক্ষা করে দেখার জন্যে সারাহ নেলমস নামের একজন গোয়ালিনীর শরীর থেকে গো-বসন্তের ফলে দেখা দেয়া ফোস্কার তরল সংগ্রহ করে তা আট বছর বয়সী এক ছেলের শরীরে প্রয়োগ করেছিলেন। সৌভাগ্যবশত, এই পদ্ধতিটি ভালোভাবে কাজ করেছিল।

যখনই আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কোনো ভাইরাস শনাক্ত করে, তখন এটা অ্যান্টিবডি তৈরি করে ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়ার চেষ্টা করে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ভাইরাসকে বাধা দেয়া, যাতে সংক্রামক সেই ভাইরাস কোনো সুস্থ কোষের সাথে সংযুক্ত হতে না পারে। কাজেই ভাইরাস আর তখন রেপ্লিকেট বা নিজের প্রতিরূপ তৈরি করতে পারে না।

স্মলপক্সের ভাইরাসগুলির একটার সাথে আরেকটার সাদৃশ্য থাকার কারণে এবং সুস্থ কোষের সাথে একই প্রোটিন ব্যবহার করে সংযুক্ত হওয়ার কারণে কাউপক্সের অ্যান্টিবডি দিয়ে স্মলপক্সের ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করা যায়। তাছাড়া রোগীদের শরীরে স্মলপক্সের জীবাণুর চেয়ে কাউপক্সের জীবাণু প্রয়োগ করা আরো বেশি নিরাপদ ছিল।

মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্যে এখন আর বিভিন্ন রোগের ভাইরাস ব্যবহার করা হয় না। তার পরিবর্তে আমরা ভ্যাকসিন ব্যবহার করি, যেটা একইভাবে কাজ করে, কিন্তু আরো নিরাপদে।

১৯৩০ এর দশকে গবেষকরা আবিষ্কার করলেন যে, তারা এক ধরনের ফরমালডিহাইড দ্রবণ ব্যবহার করে মৌসুমী ফ্লু ভাইরাস নিষ্ক্রিয় করতে পারেন। ফরমালডিহাইড নিজেই একটা বিষ। কিন্তু নিষ্ক্রিয় ভাইরাসের অংশ যাদের দেহে প্রয়োগ করা হয়েছিল, তারা এসব ফ্লুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে পেরেছিল।

বৃহৎ সংখ্যক মানুষের জন্যে একটা ফ্লু ভ্যাকসিন তৈরি করতে গবেষকদের দরকার পড়েছিল নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি, যাতে তারা প্রচুর পরিমাণ ভাইরাস কণিকা তৈরি করতে পারেন এবং সেসব ভাইরাস নিষ্ক্রিয় করতে পারেন। একইসঙ্গে নিষ্ক্রিয় সেসব ভাইরাস আবার উৎপাদন করতে পারেন।

আগের কিছু পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে গবেষকরা নিষিক্ত হওয়া মুরগির ডিম নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। কারণ সেখানে ভাইরাসগুলি অনেক দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে।

১৯৪০ এর দশকে প্রথম ফ্লু ভ্যাকসিন বাজারে আসে। এমনকি সাম্প্রতিক কোষ গবেষণা প্রযুক্তি উন্নয়নের সাথে সাথে শতকরা আশি ভাগ ফ্লু ভ্যাকসিনই এখন মুরগির ডিম ব্যবহার করে তৈরি করা হচ্ছে। এই উদ্দেশ্যে মুরগির খামার থেকে শত শত মিলিয়ন ডিম সংগ্রহ করা হয়। এবং বিভিন্ন দেশের সরকার এই তথ্য গোপন রাখে, যাতে সেসব ডিম অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করা হয়।

জীবন্ত বা সক্রিয় ভাইরাস ব্যবহার করেও ভ্যাকসিন তৈরি করা যায়। তবে খেয়াল রাখতে হয়, যেন সক্রিয় সেই ভাইরাসের প্রকৃতি দুর্বল হয়, যাতে সেসব ভাইরাস আবার রোগের সংক্রমণ না ঘটায়। এর বিকল্প হিসেবে সংক্রমণ করে না, এমন ভাইরাস ব্যবহার করা যায়। অথবা এমন কণিকা উৎপাদন করা যায়, যা ঠিক প্যাথোজেন বা নিষ্ক্রিয় ভাইরাসের মতো কাজ করে।

আরো পড়ুন: টাস্কিগি এক্সপেরিমেন্ট (১৯৩২-১৯৭২) — কুখ্যাত সিফিলিস গবেষণা

ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক কৌশল হচ্ছে ‘মেসেঞ্জার আরএনএ’ ব্যবহার করা। কোভিড-১৯ এর জন্যে দায়ী ভাইরাস ‘সার্স-কোভ-২’ (SARS-CoV-2) এর বিরুদ্ধে প্রথমবারের মত এই মেসেঞ্জার আরএনএ ব্যবহার করা হয়।

একটি আরএনএ ভ্যাকসিন তৈরি করার জন্যে বিশেষজ্ঞরা ভাইরাসের জিনোমগুলিকে পর্যায়ক্রমে সাজাতে শুরু করেন এবং কীভাবে এসব জিনোম সুস্থ কোষের সাথে সংযুক্ত হতে পারে, তার নির্দেশনা খুঁজতে থাকেন। ‘সার্স-কোভ-২’ এর ক্ষেত্রে দেখা যায়, এই ভাইরাস তার পৃষ্ঠতলের সাথে সংযুক্ত স্পাইক প্রোটিনের সাহায্যে সুস্থ কোষের ভেতরে সংক্রমণ ঘটায়।

তারপর বিজ্ঞানীরা এসব জেনেটিক তথ্যগুলিকে কপি করে সুস্থ কোষে ইনজেক্ট বা প্রয়োগ করেন। কাজেই যাদের শরীরে প্রয়োগ করা হয়েছে, তাদের শরীরের কোষগুলি নিজস্ব স্পাইক প্রোটিন তৈরি করতে থাকে। কিন্তু এগুলি কোনো ভাইরাসের সাথে সংযুক্ত থাকে না। এভাবে রোগীরা তাদের শরীরে একটি জটিল প্রজাতির ভাইরাসের ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করে, যাতে তাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সেই ব্লু-প্রিন্ট চিনতে ও নিষ্ক্রিয় করতে পারে।

এর আগে এমআরএনএ ভ্যাকসিন খুব বেশি ব্যবহার করা হয়নি। কারণ কৃত্রিম আরএনএ মেসেঞ্জারকে “হোস্ট-সেল”-এ পৌঁছানোর জন্যে দীর্ঘ সময় ধরে অক্ষত রাখা কঠিন। কিন্তু বিজ্ঞানীরা নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে (বিশেষত, ব্লু-প্রিন্ট সিকোয়েন্সগুলিকে উন্নত করার জন্যে উন্নত এনজাইম সংশ্লেষণ করে) সেই বাধা অতিক্রম করেছেন। এবং এখন তারা অবিশ্বাস্য দ্রুত সময়ে ভ্যাকসিন তৈরি করতে সক্ষম। এর জন্য তারা ‘সার্স-কোভ-২’ এর আরএনএ-তেও পরিবর্তন এনেছেন, যাতে এটা স্পাইক প্রোটিনের খুব স্থিতিশীল একটা সংস্করণ তৈরি করে, যাকে ইমিউন সিস্টেম সহজেই চিনতে পারে। স্পাইক প্রোটিনের স্থিতিশীল সংস্করণ তৈরি করার দরকার, কারণ প্রাকৃতিক ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন খুবই এলোমেলোভাবে চারদিকে ঘোরে।

২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে গবেষকরা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স বের করার সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই এর আরএনএ সংশ্লেষণ ঘটিয়ে সার্স-কোভ-২ এর জন্যে ভ্যাকসিন তৈরি করেছিলেন। এতে করে তারা সেই বছরের মার্চের মধ্যেই এই টিকার প্রথম পর্যায়ের পরীক্ষা চালাতে পেরেছিলেন।

ভ্যাকসিন কোনো রোগ অলৌকিকভাবে নিরাময় করতে পারে না। ভ্যাকসিন প্রতিটা মানুষের রোগ প্রতিরোধেও সমান ভূমিকা রাখে না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভ্যাকসিন কাজ করে।

একটা সফল ভ্যাকসিন বা টিকাদান কর্মসূচির উদ্দেশ্য এটাই যে, তা বেশি সংখ্যক লোকের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে “হার্ড ইমিউনিটি” তৈরি করে। এতে অধিকাংশ মানুষই নির্দিষ্ট রোগের ভাইরাস আর অন্যদের মাঝে ছড়াতে পারে না। এভাবেই সময়ের সাথে সাথে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না এই রোগটি সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হয়। রোগব্যাধি ততক্ষণ পর্যন্তই একটা ঝুঁকির কারণ হিসেবে থেকে যায়, যতক্ষণ পর্যন্ত কোথাও না কোথাও এই রোগটি কারো মাঝে রয়ে যায়।

আরো পড়ুন: গুটিবসন্ত বা স্মলপক্স যেভাবে নির্মূল হল পৃথিবী থেকে 

এই বছরে আমরা পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা হতে দেখছি। ‘সার্স-কোভ-২’ প্রথমে প্রমাণ করেছে যে, কীভাবে রোগব্যাধি খুব দ্রুত সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর আমরা এখন দেখতে চলেছি যে, শত শত বছর ধরে আমরা যে ভ্যাকসিন প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটিয়েছি, তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কতটা কার্যকর। আমরা দেখব যে, সত্যিই বিশ্বব্যাপী “হার্ড ইমিউনিটি” তৈরি করা যাবে, নাকি ভাইরাসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।

অর্থাৎ, এটা শুধুমাত্র এই মহামারী থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যাপারই নয়। বরং একইসাথে একটা দ্রুত ও কার্যকর পদ্ধতিতে ভবিষ্যতের সংক্রমণ মোকাবেলারও ব্যাপার। যেহেতু প্রচুর পরিমাণ ভাইরাস জীবজন্তু থেকে মানুষের শরীরে সংক্রমিত হয়, সেহেতু ভবিষ্যতে নতুন মহামারী শুরু হওয়ার আশঙ্কাও অনেক বেশি।

এখন এবং আগামি দশকগুলিতে ভ্যাকসিনই হতে পারে আমাদের সবার সুস্থতার চাবিকাঠি, এবং খুব সম্ভবত আমাদের টিকে থাকার মূলমন্ত্র।

অনুবাদ: মাহতাবুল আলম