বিজ্ঞানীরা ইঁদুরের ফুসফুসে নিউমোনিয়ার জীবাণু ধ্বংস করার জন্য কিছু রোবট তৈরি করেছেন। এই মাইক্রোস্কোপিক রোবটগুলি সাঁতার কেটে শরীরের যেকোনো জায়গায় পৌঁছে যেতে পারে। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এই রোবটগুলিকে পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছেন।

ইঁদুরের শরীরে রোবটগুলি স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারায়, আশা করা হচ্ছে, মানুষের নিউমোনিয়া চিকিৎসায়ও এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যাবে।

মাইক্রোবটের গঠন ও কাজের পদ্ধতি
মাইক্রোবটগুলি শৈবাল কোষ থেকে তৈরি এবং অ্যান্টিবায়োটিক ভর্তি ন্যানো পার্টিকেলের একটি স্তর দিয়ে আবৃত। শৈবাল কোষের এই মাইক্রোবট ফুসফুসের মধ্যে চলাচল করতে পারে। বিজ্ঞানীরা এগুলিকে পরিচালনা করে লক্ষবস্তুর নিকটে নিয়ে যেতে পারবে। এটি ফুসফুসের জন্য একটি কার্যকর চিকিৎসা হতে যাচ্ছে।

এই পরীক্ষায়, যেসব ইঁদুরকে শৈবাল কোষের ক্ষুদ্র বটগুলির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়েছে সেগুলির শরীরে থাকা নিউমোনিয়ার সংক্রমণ সব ধ্বংস হয়ে গেছে। আর যেসব ইঁদুরকে এই চিকিৎসা দেয়া হয়নি, এরা সব তিন দিনের মধ্যে মারা গেছে।

প্রযুক্তিটি এতদিন পর্যন্ত ধারণার পর্যায়ে ছিল, এখন এটি নিয়ে পরীক্ষা হচ্ছে। এর থেকে প্রাথমিক যে ফলাফল আসছে তা খুবই আশাব্যঞ্জক।

আরো পড়ুন: সেলফ রিপেয়ারিং ইলেকট্রনিক্স—বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে শীঘ্রই

“ইঁদুরের ওপর করা এই পরীক্ষার ডেটার উপর ভিত্তি করে আমরা দেখতে পাই, মাইক্রোরোবটগুলি সংক্রামক স্থানের অনেক কাছাকাছি অ্যান্টিবায়োটিক পৌঁছে দিতে পারে। এর ফলে ব্যাকটেরিয়ার প্যাথোজেনগুলি মারা যায়। মাইক্রোবটগুলি এভাবে অসংখ্য রোগীদের জীবন বাঁচাতে পারবে,” বলেছেন ক্যালিফোর্নিয়া সান দিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের পিডিয়াট্রিক্সের অধ্যাপক ভিক্টর নিজেট।

কাজের পদ্ধতি
শৈবাল কোষের এই ন্যানো-পার্টিকেল বা অতি ক্ষুদ্র কণা নিউট্রোফিলের ঝিল্লির সাথে আবৃত থাকা এক ধরনের ক্ষুদ্র পলিমার গোলক দিয়ে তৈরি। নিউট্রোফিল হল একধরনের সাদা রক্তকণিকা। নিউট্রোফিলের এই ঝিল্লি ব্যাকটেরিয়া ও শরীরের নিজস্ব ইমিউন সিস্টেম থেকে যে ক্ষতিকর অণুগুলি তৈরি হয়, সেগুলিকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে পারে। এছাড়া এই ন্যানো-পার্টিকেল ও শৈবাল কোষ উভয়ই একটা সময় পর প্রাকৃতিকভাবে নিজেদের কার্যকারিতা হারায়। ফলে এদের থেকে ঝুঁকির কিছু থাকে না।

এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে চিকিৎসা করার ফলে যেসব ক্ষতিকারক অণু শরীরে উত্তাপ তৈরি করে, তাদের পরিমাণ কমে যায়। সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষমতা অনেক বাড়ে। সর্বোপরি, এই মাইক্রোবটগুলি সাঁতার কেটে যেখানে প্রয়োজন সেখানেই পৌঁছে যেতে পারে। একদম নির্ভুলভাবেই কাজটা করতে পারে। এই নির্ভুলতাই এই প্রযুক্তির সব থেকে বড় শক্তির জায়গা।

অ্যান্টিবায়োটিকের পরিমাণ কমাতে পারে এ রোবটগুলি
গবেষকরা আরো দাবি করেন, শরীরে অ্যান্টিবায়োটিকের জন্য শিরায় ইনজেকশন দেয়ার চেয়ে মাইক্রোবটের মাধ্যমে চিকিৎসা অনেক বেশি কার্যকর। গবেষকরা দেখেছেন, ইঁদুরের ক্ষেত্রে সংক্রমণ ঠেকাতে শৈবাল কোষে যতটুকু অ্যান্টিবায়োটিক লোড করতে হয়, ইনজেকশনের একটি ডোজে তার থেকে ৩,০০০ গুণ বেশি অ্যান্টিবায়োটিক লোড করতে হয়।

ক্যালিফোর্নিয়া সান দিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যানো প্রকৌশলী জোসেফ ওয়াং বলেন, “এসব ফলাফল দেখায়, কীভাবে ‘টার্গেটেড ড্রাগ ডেলিভারি’ আর শৈবাল কোষের ক্ষুদ্র বট চিকিৎসা সেবার কার্যকারিতা আরো উন্নত করতে পারে।”

আরো পড়ুন: মেশিনের মন

গবেষকরা ইঁদুরের শরীরে নিউমোনিয়ার যে ধরনটি নিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন সেটি সৃষ্টি হয় সিউডোমোনাস এরুগিনোসা ( Pseudomonas aeruginosa) নামক ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে। মানুষের ক্ষেত্রে, যারা হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে যান্ত্রিক বায়ুচলাচল বা মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশনে আছে সাধারণত তারাই এই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই সংক্রমণ হাসপাতালে থাকার সময়কে আরো দীর্ঘায়িত করে ও উল্লেখযোগ্যভাবে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়।

পরবর্তী কাজ
গবেষকরা আত্মবিশ্বাসী যে, প্রয়োজন অনুসারে তাদের নতুন পদ্ধতিটির স্কেল বাড়ানো যেতে পারে। যেসব রোগী ভেন্টিলেশনে আছে সরাসরি তাদের ফুসফুসে ওষুধ পৌঁছানো যেতে পারে।  মাইক্রোবটগুলিকে উইন্ডপাইপের একটি টিউবের মাধ্যমে ইঁদুরের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল।

গবেষকদের জন্য পরবর্তীত কাজ হল, মাইক্রোবটগুলি কীভাবে ইমিউন সিস্টেমের সাথে  ইন্টারঅ্যাক্ট করে তা নিয়ে আরো গবেষণা করা। তারপর কাজের স্কেল বাড়ানো ও তা অন্যান্য বড় প্রাণীদের মধ্যে পরীক্ষা করার জন্য প্রস্তুত করা। ধীরে ধীরে এক পর্যায়ে মানুষের ওপরে পরীক্ষা শুরু করা।

ক্যালিফোর্নিয়া সান ডিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসায়নিক প্রকৌশলী লিয়াংফ্যাং ঝাং বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হল ফুসফুসের মতো শরীরের আরো চ্যালেঞ্জিং অংশ টার্গেট করে ঔষধ সরবরাহ করা। আমরা কাজটা এমন একটি উপায়ে করতে চাই যা হবে নিরাপদ, সহজ, শরীরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং দীর্ঘস্থায়ী। এই কাজটিতে আমরা সেটাই দেখিয়েছি।”

গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে নেচার ম্যাটেরিয়াল জার্নালে।

মূল লেখা: ডেভিড নিল্ড, সাইন্স অ্যালার্ট, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২
অনুবাদ: যুবায়েদ দ্বীপ