ভার্দা স্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ মাইক্রোগ্র্যাভিটি কাজে লাগিয়ে মহাকাশে ওষুধ তৈরি করার জন্য স্পেস ক্যাপসুল আকারের একটি ল্যাব তৈরি করেছে।

ওষুধ তৈরির পর এই ক্যাপসুল প্যারাসুটের মাধ্যমে অবতরণ করবে আমেরিকার ইউটা রাজ্যের বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে।

ভবিষ্যতে পৃথিবী ছাড়িয়ে নির্মাণ শিল্পের কাজ চলতে হবে মহাকাশেও। সেই সম্ভাবনার ওপর বাজি রেখেই ‘স্পেসএক্স’ এর প্রাক্তন কিছু কর্মকর্তা মিলে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘ভার্দা স্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামের একটি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান।

মহাকাশে যে ফার্মাসিউটিক্যাল ল্যাব তৈরি করার উদ্যোগ তারা হাতে নিয়েছেন, সেখানে কাজ করবে রোবট। সেই ল্যাব যেকোনো স্যাটেলাইটের মতই পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে ঘুরবে।

ওষুধগুলি ঠিক কীভাবে তৈরি হবে ও কীভাবে মহাকাশ থেকে সেগুলিকে পৃথিবীতে পাঠানো হবে তা বুঝতে আমাদের আগে জানতে হবে ‘মাইক্রোগ্র্যাভিটি’ সম্পর্কে।

গ্র্যাভিটি ও মাইক্রোগ্র্যাভিটি
মাইক্রোগ্র্যাভিটি হলো অভিকর্ষের প্রভাবমুক্ত ভারহীন অবস্থা। একে অনেক সময় ‘জিরো গ্র্যাভিটি’ও বলা হয়। মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে অণু ও পরমাণু পৃথিবীর তুলনায় ভিন্নভাবে আচরণ করে।

মাইক্রোগ্র্যাভিটি কাজে লাগিয়ে মহাশূন্যে তৈরি করা হবে নতুন ধরনের ওষুধআর গ্র্যাভিটি হলো মহাবিশ্বের যেকোনো প্রান্তে থাকা দুটি ভরের বস্তুর মধ্যে আকর্ষণ। পৃথিবীর মত অনেক ভরের কোনো বস্তুর কাছে থাকলে গ্র্যাভিটি সবচেয়ে স্পষ্ট বোঝা যায়। গ্র্যাভিটি বা মাধ্যাকর্ষণের কারণেই পৃথিবীর আশেপাশে থাকা যেকোনো বস্তু ভূমির দিকে ছুটে যায়।

পৃথিবী পৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকা গ্র্যাভিটিকে ‘স্বাভাবিক মাধ্যাকর্ষণ’ বা ‘1g’ বলা হয়। যেখানে পৃথিবীর ভূমির দিকে কোনো বস্তুর ত্বরণের হার থাকে ৩২.২ ফিট / সেকেন্ড² বা ৯.৮ মিটার / সেকেন্ড²। একে ‘অভিকর্ষজ ত্বরণ’ও বলা হয়। অথচ পৃথিবী থেকে দূরে যেতে থাকলে এই হার কমতে থাকে।

আর মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে ত্বরণের এই হার উপেক্ষার মত পর্যায়ে চলে যায়। পৃথিবীর ভূমির কাছে স্বাভাবিক মাধ্যাকর্ষণকে ‘1g’ ধরা হলে মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে মাধ্যাকর্ষণকে বলা যেতে পারে 1×10^-6 g, যা স্বাভাবিক মাধ্যাকর্ষণের তুলনায় নগণ্য।

এ কারণে পৃথিবীর তুলনায় মাইক্রোগ্র্যাভিটি পরিবেশে যেকোনো উপাদান স্ফটিকে পরিণত হওয়ার হার থাকে আলাদা, তরলের মিশ্রণও হয় আলাদা ভাবে। এছাড়া গ্যাস ও তরল পদার্থ পৃথক করা, তাপ স্থানান্তর, কোনো উপাদানকে কঠিন অবস্থায় নিয়ে আসা কিংবা দহনের মত প্রক্রিয়াও সেখানে ঘটে পৃথিবীপৃষ্ঠের চেয়ে ভিন্নভাবে।

মহাকাশ-নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা
এখান থেকেই মহাকাশ-নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ও ওষুধ এমনভাবে সংশ্লেষণ বা সিন্থেসাইজ করা যাবে, যা পৃথিবীতে করা কঠিন। ফলে মহাকাশে এ পদ্ধতিতে প্রস্তুত করা সম্ভব হবে নতুন ধরনের ওষুধ।

অবশ্য বড় বড় অনেক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি বেশ কয়েক বছর ধরেই সীমিত আকারে মহাকাশে ওষুধ উৎপাদন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে আসছে। যেমন ম্যার্ক অ্যান্ড কো. নামের একটি আমেরিকান ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানি তাদের ক্যান্সার চিকিৎসার একটি ওষুধ আরো সূক্ষ্মভাবে তৈরির জন্য ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনকে কাজে লাগিয়েছে। শুধু ‘কিট্রুডা’ (Keytruda) নামের এই ওষুধ বিক্রি করেই বছরে প্রতিষ্ঠানটির আয় হয় ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে কাজ করার জন্য অনেক টাকা খরচ করতে হয়। তাছাড়া সেখানকার ছোট আর আবদ্ধ জায়গায় বিপজ্জনক সব রাসায়নিক নিয়ে কাজ করতে হয় নভোচারীদের। যে কারণে নভোচারীরাও এ ধরনের কাজ করতে খুব একটা আগ্রহী থাকেন না।

এ সমস্যাই সমাধান করতে পারে মহাকাশে ওষুধ উৎপাদনের নতুন এই উদ্যোগ। ‘ভার্দা স্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও উইল ব্রুয়াই বলেন, “প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনার নতুন উপায় বের করেছি আমরা। আর পৃথিবীর সবচেয়ে দামি রাসায়নিক ব্যবস্থা হলো ওষুধ। আমরা জানতাম মাইক্রোগ্র্যাভিটি কাজে লাগিয়ে মহাকাশে দুর্দান্ত পদ্ধতিতে ওষুধ তৈরি করা যাবে।”

যেভাবে কাজ করবে ভার্দা
ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের মত বড় আকারের কোনো স্থাপনা মহাকাশে তৈরি করবে না ভার্দা। অর্থাৎ, মহাকাশে রাতারাতি কোনো ওষুধ তৈরির কারখানা নির্মাণ করতে যাচ্ছেন না তারা। বরং তাদের ক্যাপসুল আকৃতির ল্যাবের আকার হবে মাত্র ৩ ফিটের মত, যেখানকার কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করবে রোবট। সেখানে প্রোটোটাইপ হিসেবে পরীক্ষামূলক ওষুধ প্রস্তুত করে পৃথিবীতে ফেরত পাঠানো হবে।

ক্যাপসুলটি দেখতে মোচক বা কৌন আকৃতির একটি মহাকাশযানের মত। অনেকটা এই আকৃতির মহাকাশযানে চড়েই নভোচারীরা ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন থেকে পৃথিবীতে ফেরেন।

হাইপারসনিক প্রযুক্তি নির্ভর গবেষণায় এর প্রভাব
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ভার্দার ক্যাপসুল যখন পুনঃপ্রবেশ করবে, তার ওপর গবেষণা শুরু করবে মার্কিন বিমান বাহিনী ও নাসা। কারণ এসব ক্যাপসুল শব্দের ২৫ গুণ গতিতে ছুটে আসবে পৃথিবীর দিকে। ফলে ভার্দার ক্যাপসুল পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া তথ্য কাজে লাগানো হবে শব্দের চেয়ে দ্রুতগতির হাইপারসনিক প্রযুক্তি নির্ভর গবেষণায়ও। এজন্য তাদের সাথে ৬০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়াও এ পর্যন্ত বিনিয়োগকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৫৩ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে ভার্দা।

প্রথম ক্যাপসুল পরীক্ষা
ভার্দার সবচেয়ে বড় সাফল্য আসতে পারে বিভিন্ন জটিল আর দুরারোগ্য ব্যাধির যুগান্তকারী ওষুধ তৈরিতে।

প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটি ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ওবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার ওষুধ উদ্ভাবনের জন্য কাজ করার পরিকল্পনা করছে।

‘ভার্দা স্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ’ এর ক্যাপসুল আকৃতির স্যাটেলাইট মহাকাশের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরুর কথা রয়েছে এ বছরের (২০২৩) জুন মাসে। প্রথমবারের এই উৎক্ষেপণের মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখা হবে, ক্যাপসুলগুলি মহাকাশ থেকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার সময় আগুন ধরার হাত থেকে বাঁচতে পারে কিনা।

মাইক্রোগ্র্যাভিটি কাজে লাগিয়ে মহাশূন্যে তৈরি করা হবে নতুন ধরনের ওষুধ
ভার্দার দুজন প্রতিষ্ঠাতা ডেলিয়ান অ্যাসপারুহভ (বাঁয়ে) এবং উইল ব্রুয়াই

কোনো বস্তু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার সময় এর সামনে থাকা বাতাস অনেক দ্রুত সংকুচিত হয়। আর কোনো গ্যাস সংকুচিত হলে তার তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এভাবেই সেই বস্তুতে আগুন ধরার আশঙ্কা তৈরি হয়।

মোটকথা, মহাকাশে ওষুধ তৈরির পর পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে তা নিয়ে প্রবেশ করার সময় যাতে সেই ওষুধ ঠিক থাকে, সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টাই করা হবে প্রথম মহাকাশ যাত্রায়।

ভার্দা’র সাথে যুক্তদের দাবি, মহাকাশে অল্প পরিমাণে কোনো ওষুধ সফলভাবে তৈরি করা গেলে তা দিয়েই পৃথিবীতে থাকা কারখানাগুলিতে বড় পরিসরে একই ওষুধ উৎপাদন করা যাবে। তবে মহাকাশে তৈরি করা বিভিন্ন ওষুধ কতটা সফলভাবে পৃথিবীতে উৎপাদন করা যাবে, সেই প্রশ্নের মীমাংসা হবে ভার্দা’র পরীক্ষামূলক অভিযানের পরেই।

ভবিষ্যতে ওষুধ তৈরির জন্য বেশ কিছু ক্যাপসুল মহাকাশে পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে ভার্দা’র। একদিন হয়ত শুধুমাত্র ওষুধ উৎপাদনে সাহায্য করার জন্যই মহাকাশে মানুষ পাঠানো হবে, এমনটা মনে করেন কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আর্থার বনি।

তার মতে, “ভবিষ্যতে মাইক্রোগ্র্যাভিটির সুবিধা কাজে লাগিয়ে ওষুধ ছাড়াও অন্যান্য পণ্য তৈরি করা সম্ভব হবে মহাকাশে।” চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো মহাকাশে উৎপাদন বা নির্মাণকাজের প্রচলন স্বাভাবিক করে তোলা।

অনুবাদ: ফারহান মাসউদ
সূত্র: ফিউচারিজম ও ব্লুমবার্গ