আবারও আমার উল্টা রাস্তাখানি আপনাদের সামনে হাজির করতেই হচ্ছে। যেহেতু আমি কারো দ্বারা প্ররোচিত না হইয়া, সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে জানিয়েছিলাম যে কাকে অধুনা কালে সামাজিক গবেষণা বলা হয়ে থাকে, তাই তার ক্ষয়ক্ষতিটাও আমার নিজের কাঁধে নেয়া উচিত। যে ক্ষতিটি হয়ে থাকতে পারে তা হলো আপনারা হয়তো অসামাজিক হবার ভয়ে আর সামাজিক গবেষণা করতে চাইলেন না। কিংবা হয়তো ছাগল দিয়ে হালচাষের প্রমাণের মতো পেঁচানো গবেষণাতে উৎসাহ বোধ করলেন না; কিংবা নিছকই নিরর্থক বোধ করলেন ইত্যাদি।

এসবে গবেষণা বিষয়ে আপনাদের গুরুতর বিষাদ দেখা দিতে পারে। কিংবা নতুন-নতুন উপলব্ধি কীভাবে গড়ে উঠবে সেই বিষয়ক দুশ্চিন্তা দেখা দিতে পারে। গবেষক হতে চাইবার তাগিদ বোধ করা সত্ত্বেও কিছুতেই আর উদ্যম বোধ না করতে পারার দুর্যোগও দেখা দিতে পারে। আমরা যদি চাই যে আপনি ‘গবেষণা’ জারি রাখুন, তাহলে আপনার এই মনোভাব বা মনোবেদনকে দীর্ঘকাল আমাদের প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না। আমাদের উচিত হবে, আপনাকে গবেষণার সেসব উপায়ের দিকে উৎসাহ প্রদান করা যেখানে বাস্তবিকই ওইরকম প্রমাণের জন্য ছাগল আর চাষবাস বিষয়ে সরেজমিন না-নামতে হয়।

তো, বলাই বাহুল্য, আপাতত তাহলে আপনাকে আরোহী তথা ইনডাকটিভ গবেষণার পইপইমূলক সরেজমিন রাস্তা থেকে দূরে সরতে বলছি। এই কারণে বলছি না যে, ওটা মন্দ বা নিন্দনীয় রাস্তা। বরং, এই কারণে বলছি যে, ওটার প্রাতিষ্ঠানিক আত্মীকরণ অধুনা দুনিয়ায় এমন জায়গায় গেছে যে আপনি আর দুচারদিনে ওগুলোকে অবমুক্ত করে একটা কার্যকরী রাস্তা বানাতে পারবেন না। ফলে, আপাতত আপনাকে অবরোহী পদ্ধতির গবেষণায় তালিম নিয়ে ঘাপটি মেরে থাকার বুদ্ধিটিই দিতে হচ্ছে।

এখানে ‘ঘাপটি মারা’র বিষয়টি অতীব গুরুত্বের সঙ্গে আজ আলাপ করব। কতকাল ঘাপটি মারবেন? কার সামনে ঘাপটি মারবেন? কেন মারবেন বা এই ঘাপটি মারা থেকে আপনি কী হাসিল করতে চান? এগুলো কিন্তু অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ সব প্রশ্ন। আপনার দীর্ঘকাল ঘাপটি মারা লাগতে পারে। আপনার এক জীবন শেষ হয়ে গেল তাতে, সেটাও মেনে নিতে হবে। যতক্ষণ না তামাম বিশ্বে আরোহী পদ্ধতির স্থূল তথাপি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা কমজোর হয় ততক্ষণ পর্যন্ত ঘাপটি মারা লাগতে পারে। যাঁদের সামনে ঘাপটি মারবেন তাঁরা অবশ্যই প্রথিতযশ গবেষক এবং গবেষণা-প্রতিষ্ঠানের তল্পিবাহী। কেন মারবেন সেটাই বরং আরো মনোযোগের দাবিদার আলাপ।

আপনার গবেষক-পরিচয় কিংবা গবেষণা-উপলব্ধি ফুঁ দিয়ে সেসব প্রতিষ্ঠান ও গবেষক উড়িয়ে দেবেন সেই আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত হয়ে অবশ্যই আপনি ঘাপটি মারতে পারেন। সেই কারণ অতিশয় ন্যায্য বটে। কিন্তু এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। আপনি দম ধরে রাখার জন্য, আরও ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে মনুষ্য-গবেষণাকে রক্ষা করার জন্য এই ঘাপটি মারার কাজটি করবেন। ধরা যাক, আপনি ৮০’র দশকে আবাহনী মোহামেডান খেলা দেখতে গেছেন। আপনি মোহামেডানের সমর্থক, কিন্তু দৈবাৎ বসে পড়েছেন আবাহনীওয়ালাদের মধ্যে, কিংবা বিপরীতটা। তখন উত্তেজনা-প্রবাহের যে মানচিত্র সেখানে আপনি ‘তোমাদের লোক’ সাজলে তো ৯০ মিনিট ধরেই সাজতে হবে। সহজ নয়, এবং তাতে আপনার গুরুতর মানসিক ক্ষতিও হয়। বরং, আপনি যদি একটা আরামবাগ, ফরাশগঞ্জ, পুলপাড়া জার্সি সঙ্গে রাখতেন, টুপুস করে সেটা পড়ে ফেলতেন, তাহলে আপনি ৯০ মিনিট তামাশার শিকার হলেও প্রহারের শিকার হবার সম্ভাবনা আপনার কমে যেতো। ঘাপটি মারাকে তাই দেখতে হবে এমন একটা কৌশল হিসাবে যেখানে হৈহৈরৈরৈ গবেষণা-কর্মকাণ্ডের মধ্যে নিজের ‘গবেষক’ পরিচয়কে নিজেই লঘু করতে করতে বিলীন করে দেয়া যায়। যাতে করে, হৈহৈওয়ালারা আপনাকে পিটানোর সুযোগ না পান। অবশ্য গবেষণা-বিদ্যা জগতে সাবেক ফুটবল জগতের মতো একই প্রকারের পিটানি দেবার সম্ভাবনা বরাবরই কম থেকে আছে।

কখনো আপনার গবেষণা পদ্ধতির দিন আসবে এই আশায় অপেক্ষা ছাড়াও, আপনি চামেচিকনে আপনার উপলব্ধি সবসময়েই প্রকাশিত করতে পারবেন। তাতে আপনার পুরস্কার বা বিদেশভ্রমণ, বা ফান্ডিং না জুটলেও, অতি ধীর গতিতে হলেও, ‘গবেষণা-ফলাফল’ ট্রান্সমিট/সঞ্চালন করতে পারবেন পরিচিত-অপরিচিতদের মাঝে। কিন্তু অবশ্যই আপনার অগবেষকের মতো থাকতে হবে। গবেষকের ইউনিফর্ম পড়লেই মরেছেন। ওই যে দম ধরে রাখার মতো। দম ধরা প্রায় ভং ধরাই। যুদ্ধ ক্ষেত্রে বেঁচে থেকেও মৃতের মতো পড়ে থাকা যাতে আরেকটা গুলি ফুটুশ করে না দেন কেউ – হ্যাঁ জনাব, ঘাপটি-মারার কথাই হচ্ছে। ধরা যাক, ২০ বছর আগে আমি যদি চলচ্চিত্র গবেষক, সংস্কৃতি গবেষক কিংবা নন্দন গবেষকের উর্দি পড়ে মাঠে নামতাম তাহলে তথাকথিত অশ্লীলতা নিয়ে আমার “উপলব্ধি” যে দুচারজনের কাছে ‘ট্রান্সমিট’ করতে পেরেছি, তার কিছুই পারতাম না। “ওইডারে গবেষণা কয়?” “তুমি গবেষণার বুঝো অমুকটা” ইত্যাদি সব অভিব্যক্তির চোটে ভাবনাটা/উপলব্ধিটাই আর বলা সম্ভব হতো না। ফলে, ঘাপটি মেরে আমার ‘গবেষণা’ চালিয়েই বরং আমি ওই উপলব্ধিও হাজির করতে পেরেছিলাম।

আদাবর, ২২ আগস্ট ২০২০