জেনারেটিভ এআই (যেমন চ্যাটজিপিটি) আমাদের কাজ দ্রুত করতে, নতুন কিছু ভাবতে বা দক্ষতা বাড়াতে দারুণ সাহায্য করে। কিন্তু এই প্রযুক্তি শুধু ভাল কাজেই সীমাবদ্ধ নেই। এআই এর ক্ষমতা এখন সাইবার অপরাধীদের হাতেও পৌঁছে গেছে। প্রতারক বা হ্যাকাররা এআই ব্যবহার করে খুব কম সময়ে এমন নিখুঁত সব প্রতারণা সাজায়, যেগুলি খালি চোখে ধরতে পারা প্রায় অসম্ভব।

ফ্রডজিপিটি (FraudGPT) আর ওয়ার্মজিপিটি (WormGPT) এর মত ডার্ক এআই (Dark AI) টুলগুলি দেখতে চ্যাটজিপিটি এর মত হলেও, এগুলিকে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে প্রতারণা আর সাইবার অপরাধে সাহায্য করার জন্য। এমনকি এগুলি ব্যবহার করতে কোনো বিশেষ প্রযুক্তিগত দক্ষতারও প্রয়োজন হয় না।

এই সহজলভ্য ক্ষমতা এখন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের জন্যও বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষণা বলছে, ২০২৩ সালে জেনারেটিভ এআই ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হওয়া শুরু করার পর থেকেই বৈশ্বিক সাইবার আক্রমণ প্রায় ৩০% বেড়েছে। তাই ডার্ক এআইভিত্তিক প্রতারণা চেনা আর নিজেকে সুরক্ষিত রাখা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে জরুরি। ডার্ক এআই আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য, ডিভাইস আর গোপনীয়তার ওপর সরাসরি হুমকি তৈরি করছে।

ডার্ক এআই বলতে সেই ধরনের এআই প্রযুক্তিকে বোঝায়, যা খারাপ, ক্ষতিকর ও বেআইনি কাজে ব্যবহার করা হয়। চ্যাটজিপিটি বা জেমিনাই-এর মত উন্নত ও নিরাপদ এআই টুলগুলির মধ্যে নানা নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা থাকে। কিন্তু ডার্ক এআই-এর মধ্যে এগুলি নেই। ফলে কেউ যদি ডার্ক এআই-কে নির্দেশ দেয়, “অফিসের বস সেজে টাকা চাওয়ার একটা ইমেইল লিখে দাও,” তাহলে এআই কোনো বাধা ছাড়াই নিখুঁত ভাষায় এবং অফিসিয়াল ভাষায় সেই মেইল লিখে দেবে।

ডার্ক এআই
আপনার পরিচিত কোনো মানুষের ৫-১০ সেকেন্ডের অডিও পেলেই ডার্ক এআই সেই কণ্ঠ পুরোপুরি নকল করতে পারবে। এরপর সেই কণ্ঠে আপনাকে ফোন করে টাকা, পাসওয়ার্ড বা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চাইতে পারে। এগুলি এমনভাবে করবে যে আপনার মনে হবে সত্যিই আপনার পরিচিত সেই মানুষটিই কথা বলছে।

ডার্ক এআই ব্যবহারকারীর নির্দেশ অনুযায়ী ফিশিং মেসেজ, ভুয়া ব্যাংক লগইন পেজ, হ্যাকিং কোড এমনকি কোনো ব্যক্তির ভয়েস বা ভিডিওর ডিপফেইক (নিখুঁত নকল) তৈরি করতে পারে। যেমন আপনার পরিচিত কোনো মানুষের ৫-১০ সেকেন্ডের অডিও পেলেই ডার্ক এআই সেই কণ্ঠ পুরোপুরি নকল করতে পারবে। এরপর সেই কণ্ঠে আপনাকে ফোন করে টাকা, পাসওয়ার্ড বা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চাইতে পারে। এগুলি এমনভাবে করবে যে আপনার মনে হবে সত্যিই আপনার পরিচিত সেই মানুষটিই কথা বলছে।

আরও ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল, এগুলি সব তৈরি করা যায় খুব দ্রুত সময়ে। আগে একটা প্রতারণামূলক ইমেইল বা স্ক্রিপ্ট বানাতে অন্তত আধা ঘণ্টা সময় লাগত। এখন ডার্ক এআই কয়েক সেকেন্ডেই সেই কাজের হাজার হাজার কপি তৈরি করে ফেলতে পারে। ফলে সাইবার অপরাধীরা আগের তুলনায় অনেক বেশি গতিতে এবং একসাথে অনেক বেশি জায়গায় আক্রমণ চালাতে পারছে। এর ফলে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ডেটা চুরি, অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং, পরিচয় চুরির মত নানা ধরনের অনলাইন প্রতারণার ঝুঁকিতে পড়ছে।

ডার্ক এআই-এর বিপদ—অধিক তথ্যভিত্তিক আক্রমণ
ডার্ক এআই সত্যিই বিপজ্জনক, কারণ এটি সাইবার আক্রমণের সংখ্যা এবং প্রভাব দুটিই নাটকীয়ভাবে বাড়িয়ে দেয়। এসব আক্রমণ ব্যক্তিগত দুর্বলতা, বড় প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তিগত ফাঁক এই দুই ক্ষেত্রেই আঘাত হানে। আরও কঠিন বিষয় হল, ডার্ক এআই দিয়ে তৈরি প্রতারণা প্রায়ই এত নিখুঁত হয় যে সাধারণ সতর্কতা কাজে লাগিয়ে এগুলি চেনা প্রায় অসম্ভব।

বিশ্বজুড়ে সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেনারেটিভ এআই যদি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অপরাধীদের হাতে চলে যায়, তাহলে আগামী কয়েক বছরে সাইবার অপরাধের শক্তি এমন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে যেখানে কোনো ডিভাইস বা ডিজিটাল পরিচয়ই আর নিরাপদ থাকবে না।

ডার্ক এআই এর প্রধান ঝুঁকিগুলি কী
১. সহজে হ্যাকিং বা প্রতারণা করতে পারা

আগে স্ক্যাম ইমেইল, ফিশিং ওয়েবসাইট বা ম্যালওয়্যার তৈরি করতে নির্দিষ্ট দক্ষতা লাগত। প্রয়োজন হত প্রোগ্রামিং, নেটওয়ার্কিং, সিকিউরিটি স্ট্রাকচার, কোড ডিবাগিং-এর মত কাজের দক্ষতা। এখন ডার্ক এআই এই সমস্ত দক্ষতা “অটোমেট” বা স্বয়ংক্রিয় করে ফেলেছে। কোনো প্রকার কোডিং জানে না এমন মানুষও ডার্ক এআইকে নির্দেশ দিয়ে হ্যাকিং কোড পেয়ে যাচ্ছে।

স্ক্যাম টেক্সট-ডিজাইন, ইমেইলের হেডার ফরম্যাট, অফিসিয়াল টোন এমনকি কোম্পানির স্বাভাবিক ভাষার ধরন সবকিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয়ে যায় ডার্ক এআই দিয়ে।

তাই এখন স্ক্যাম মেইলে আগের মত ভুল বানান, খাপছাড়া ভাষা, ভাষার কাঠামোগত ত্রুটি থাকে না, যেগুলি প্রতারণা শনাক্ত করার একটা বড় উপায় ছিল। এভাবে শত শত মানুষ প্রতারণায় “দক্ষ” হয়ে উঠছে, যারা আগে কখনোই এমন অপরাধে জড়াতে পারত না।

২. অবিশ্বাস্য গতিতে প্রচুর সংখ্যক আক্রমণ চালানো

ডার্ক এআই মিলিসেকেন্ডে কনটেন্ট তৈরি করতে পারে। এটি ৫,০০০ মানুষের জন্য আলাদা আলাদা ভাষায় প্রতারণামূলক মেইল তৈরি করতে পারে। এই প্রত্যেকটি মেইলে একেক জনের জন্য একেক রকম ভাষা ব্যবহার করতে পারে। আর মেইলগুলি তৈরি করা হয় যার যার ব্যক্তিগত পছন্দ, অপছন্দের বিষয় মাথায় রেখে।

ডার্ক এআই মানুষের ফেসবুক পোস্ট, লিংকডইন প্রোফাইল, চ্যাট ও ব্রাউজিং হিস্ট্রি দেখে যে কোনো লেখাকে ব্যক্তিভিত্তিক বা পার্সোনালাইজড করতে পারে। এটাকে বলা হয় হাইপার পারসোনালাইজড স্ক্যাম, যা সাধারণ বাল্ক বা গণ স্ক্যামের তুলনায় অনেক বেশি বিপজ্জনক। কারণ মানুষ এই ধরনের স্ক্যাম দ্রুত বিশ্বাস করে ফেলে।

একজন প্রতারক চাইলে একই সঙ্গে লাখো মানুষের কাছে প্রফেশনাল ইমেইল পাঠাতে পারে, হাজার হাজার ভুয়া লগইন পেজ বানাতে পারে। এমনকি সেকেন্ডের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় আক্রমণ ছড়িয়ে দিতে পারে। যার ফলে সোশ্যাল মিডিয়া, ইমেইল, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম, ব্যাংকিং অ্যাপ সব কিছু ঝুঁকিতে পড়ে যায়।

৩. আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ

ডার্ক এআই যেভাবে প্রতিদিন আপডেট হয়, তা ট্র্যাক করা কঠিন। অনেক এআই এমনভাবে লেখা হয়, যাতে এর মাধ্যমে তৈরি ম্যালওয়্যার বা স্ক্যাম বার্তায় কোনো “ডিজিটাল স্বাক্ষর” থাকে না। ফলে এগুলি কোথা থেকে এসেছে তা চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

এছাড়া অপরাধীরা এআই ব্যবহার করে নিজস্ব অবস্থান লুকাতে পারে, ভিপিএন বা বটনেট পরিচালনার কোড তৈরি করতে পারে, ট্রেসিং সিস্টেম পাশ কাটানোর উপায় বের করতে পারে।

এর ফলাফল হল আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে প্রতিনিয়ত “প্রতিক্রিয়ামুলক” ব্যবস্থা নিয়ে তৎপর থাকতে হয়। অপরাধ প্রতিরোধ নয়, বরং অপরাধ ঘটার পর সমাধান খোঁজা নিয়েই তারা বেশি ব্যস্ত থাকে।

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এআইভিত্তিক সাইবার অপরাধ আগামী কয়েক বছরে “নেক্সট জেনারেশন ক্রাইম নেটওয়ার্ক” তৈরি করবে, যেখানে অপরাধ করতে কোডিং জানা লাগবে না। শুধু খারাপ উদ্দেশ্য থাকলেই চলবে।

৪. কথোপকথনভিত্তিক প্রতারণা

মানুষকে ঠকানোর সবচেয়ে কার্যকরী কৌশল হল সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বা কথোপকথনের মাধ্যমে বিশ্বাস অর্জন। ডার্ক এআই এটাকে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছে।

এখানে মানুষের ভাষার টোন, বাক্য গঠনের ধরন, লেখনী স্টাইল, সম্পর্কের ধরন এসব কিছু নকল করা হয়। ধরা যাক, আপনি আপনার বসের কাছ থেকে মেসেজ পেলেন, “নিচের লিংকে গিয়ে ফাইলটা ডাউনলোড করো।” মেসেজ পড়ে আপনার সন্দেহ হল ঠিকই, কিন্তু যদি মেসেজের লেখা যদি বসের আগের মেসেজগুলির স্টাইল, ভাষা, যোগাযোগের ভঙ্গি পুরোপুরিভাবে নকল করে লেখা হয়, আপনার সেই সন্দেহ অনেকটাই মিলিয়ে যেতে বাধ্য।

ডার্ক এআই এই কাজই করে। আসল মানুষের আগের ইমেইল বিশ্লেষণ করে, একই ভাষা, শব্দ, আচরণ অনুকরণ করে যেকোনো কথোপকথনকে বাস্তবের মত তৈরি করে। এটাকে বলা হয় অ্যাডাপ্টিভ ইম্পারসোনেশন (adaptive impersonation), যেখানে প্রতারণার ভাষা কথোপকথনের সঙ্গে সঙ্গে “উন্নত ও নিখুঁত” হতে থাকে।

এই প্রতারণার ফাঁদে পড়লে এক ক্লিকে আপনার অ্যাকাউন্ট, ডেটা বা পাসওয়ার্ড অপরাধীদের কাছে চলে যায়।

৫. এআই দিয়ে তৈরি ম্যালওয়্যার বা ভাইরাস

ডার্ক এআই প্রোগ্রামিং ভাষা বোঝে, কোড স্ট্রাকচার এর মান উন্নত করে, এমনকি ত্রুটি ঠিকও করে দিতে পারে। এ কারণে নিম্নমানের হ্যাকারও উচ্চমানের ম্যালওয়্যার তৈরি করতে পারে। এই ম্যালওয়্যার দিয়ে কারও ডিভাইসের ছবি, ভিডিও, নথি চুরি করা যায়। আবার এগুলি ব্রাউজারে সংরক্ষিত পাসওয়ার্ড কপি করতে পারে, ব্যাকআপ ডেটা ট্রান্সফার করতে পারে, ক্লাউড স্টোরেজে ঢুকে যেতে পারে, এমনকি ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক কি বা ব্যাংকিং ওটিপি নিয়ে যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডার্ক এআই-জেনারেটেড কোড প্রায়ই “সিগনেচার লেস” হয়, অর্থাৎ অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার এটা সহজে শনাক্ত করতে পারে না। এটিকে বলা হয় পলিমরফিক ম্যালওয়্যার, যেটি প্রত্যেকবার কাজ করার সময় নিজের স্ট্রাকচার বদলে নেয়।

৬. ডিপফেইক এবং ভয়েস ক্লোনিং

ডিপফেইক এবং ভয়েস ক্লোনিং প্রযুক্তি তৈরি করতে আগে বড় সিস্টেম লাগত। আর প্রয়োজন হত প্রচুর সময় এবং বিশেষ দক্ষতা। কিন্তু এখন ডার্ক এআই মাত্র কয়েক সেকেন্ডের অডিও বা অল্প কিছু ভিডিও পেলেই অত্যন্ত নিখুঁতভাবে কারও মুখ, কণ্ঠস্বর বা ভিডিও তৈরি করতে পারে। ফলে যে কেউ চাইলে এই নকল কণ্ঠ বা ভিডিও ব্যবহার করে নানা ধরনের ক্ষতিকর কাজ করতে পারে। যেমন কারো আত্মীয় সেজে বিপদের কথা বলে জরুরি টাকা চাইতে পারে, কোনো রাজনৈতিক নেতার নামে ভুয়া বিবৃতি ছড়িয়ে সমাজে বিভ্রান্তি বা উত্তেজনা তৈরি করতে পারে, ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা সম্মান নষ্ট করতে ডিপফেইক ভিডিও ছেড়ে দিতে পারে। আবার কোনো প্রতিষ্ঠানের সিইও সেজে কর্মচারীর কাছ থেকে অর্থ বা গোপন তথ্য চাওয়ায় বিচিত্র নয়। এই প্রযুক্তি শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ায় না বরং জাতীয় নিরাপত্তা, নির্বাচন এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপরও বড় ধরনের হুমকি তৈরি করে।

৭. নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেদ করা

নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেদ করা ডার্ক এআই এর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সক্ষমতাগুলির একটি, কারণ এটি সিস্টেম বা সফটওয়্যারের দুর্বলতা অত্যন্ত দ্রুত বিশ্লেষণ করতে পারে, যাকে বলে অটোমেইটেড ভালনারেবিলিটি টেস্টিং। এই প্রযুক্তি নিজে থেকেই খুঁজে বের করতে পারে কোন পোর্ট দিয়ে সিস্টেমে ঢোকা যেতে পারে। এছাড়া কোন এনক্রিপশন ভাঙা সম্ভব, কোন সফটওয়্যার বা অ্যাপ্লিকেশনে কী ধরনের ত্রুটি আছে, কিংবা কোনো ওয়েবসাইটে কী ধরনের সিকিউরিটি সমস্যা আছে সেটাও খুঁজে বের করতে পারে।

অনেক সময় ডার্ক এআই সরাসরি নির্দেশও দেয় যে “এই পথ দিয়ে ঢোকা যাবে বা এই ফাইলটি চালালেই সিকিউরিটি ভেঙে যাবে।” ফলে ফায়ারওয়াল পাশ কাটানো, অ্যান্টিভাইরাস এড়িয়ে যাওয়া বা ডিটেকশন সিস্টেম ব্লক করাসহ সব ধরনের নিরাপত্তা ভেদ করা আগের তুলনায় অনেক সহজ হয়ে গেছে।

ডার্ক এআই টুলগুলি কীভাবে অপরাধে ব্যবহার করা হয়
সাধারণ নির্দেশ কাজে লাগিয়েই ডার্ক এআই এখন প্রতারকদের হাতে শক্তিশালী অস্ত্রে পরিণত হচ্ছে। এসব এআই টুল দিয়ে যে কেউ খুব সহজেই ফিশিং মেসেজ লিখতে পারে, ভুয়া পরিচয় বানাতে পারে, ক্ষতিকর কোড তৈরি করতে পারে, এমনকি মানুষের মত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাও বলতে পারে। সব মিলিয়ে একটা সফল সাইবার আক্রমণের মূল উপকরণগুলি কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তৈরি করে দিচ্ছে ডার্ক এআই।

এখন দেখে নিন ডার্ক এআই ঠিক কোন কোন কাজে ব্যবহার করা হয়:

১. ফিশিং মেসেজ তৈরি করা

ফিশিং বলতে এমন ভুয়া বার্তা, যেটা দেখে মনে হয় এটি সত্যিই কোনো ব্যাংক, অফিস বা পরিচিত মানুষের পাঠানো বার্তা। ডার্ক এআই খুব সহজেই এমন বার্তা লিখে দিতে পারে, যেখানে ভাষা, টোন, শব্দ বাছাই সবই প্রফেশনাল এবং নিখুঁত।

২. ভুয়া ওয়েবসাইট বানানো

ডার্ক এআই শুধু লেখা নয়, সম্পূর্ণ ওয়েবসাইটও বানাতে পারে। এমন সাইটগুলি দেখতে ঠিক আসল ব্যাংক, ই-কমার্স বা অফিসের সাইটের মতই লাগে। কিন্তু এর লোগো, ডিজাইন, মেনু, বাটন সবই নকল।

আপনি যদি বিশ্বাস করে ওই সাইটে লগইন করেন বা কার্ড নম্বর দেন, তাহলে কিন্তু আপনার সব তথ্য চুরি হয়ে যাবে।

৩. নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভাঙার উপায় বের করা

ডার্ক এআই কেবল আক্রমণই তৈরি করে না, এটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতাও খুঁজে বের করতে পারে।

ফায়ারওয়াল, অ্যান্টিভাইরাস বা সিকিউরিটি সিস্টেম কীভাবে পাশ কাটানো যায় সেসব বিশ্লেষণ করার উপায়ও বলে দিতে পারে ডার্ক এআই। তালা ভাঙার আগে তালার ডিজাইন বুঝে সেটার দুর্বল অংশ চিহ্নিত করে ফেলার কাজটাই ডার্ক এআই করে। ফলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও নিরাপত্তা ভাঙা সহজ হয়ে যায়।

ডার্ক এআই থেকে কীভাবে নিজেকে সুরক্ষিত রাখবেন
ডার্ক এআই এর প্রতারণা থেকে বাঁচতে শুধু সতর্কতা নয়, সঠিক সাইবার সিকিউরিটি অভ্যাস আর প্রযুক্তিগত সুরক্ষা থাকা দরকার। কারণ কিছু আক্রমণ আপনার চোখের সামনে ঘটে ফেইক মেইল বা ভুয়া কল হিসাবে। আবার কিছু আক্রমণ ঘটবে ডিভাইসের ভেতরে আড়ালে, যেখানে আপনি বুঝতেই পারবেন না যে আপনার ফোন বা কম্পিউটার হ্যাক হয়েছে।

তাই নিচের অভ্যাসগুলি ডার্ক এআই-এর ঝুঁকি কমাতে সবচেয়ে কার্যকর:

১. ছদ্মবেশ শনাক্ত করার উন্নত সফটওয়্যার ব্যবহার করুন

আজকাল প্রতারণা শনাক্ত করার সফটওয়্যারগুলিতে “ভাল উদ্দেশ্যে এআই” ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলি স্ক্যাম ডিটেক্টর-এর সিস্টেম এআই দিয়ে ফিশিং মেসেজ, ভুয়া লিংক বা ম্যালওয়্যার শনাক্ত করে ব্যবহারকারীকে সতর্ক করে দিতে পারে। ডার্ক এআই যখন নিখুঁত ভাষায় স্ক্যাম বানায়, তখন মানুষের পক্ষে সেটা বোঝা কঠিন হয়। সেই সময় এই সফটওয়্যারগুলি দারুণ সাহায্য করে।

২. অপরিচিত কারও বার্তায় সহজে সাড়া দেবেন না

সাইবার আক্রমণ বাড়ার কারণে এখন যেকোনো অবাঞ্ছিত ফোন কল, এসএমএস, ইমেইল বা ইনবক্স বার্তা সবকিছুকেই সম্ভাব্য ঝুঁকি হিসাবে ভাবাটাই নিরাপদ অভ্যাস। কেউ যদি পরিচিত মানুষের মত কথা বলে টাকা বা ব্যক্তিগত তথ্য চায়, সবার আগে অন্য কোনো মাধ্যম দিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিন।

যেমন যদি “বস” সেজে কেউ লিংক পাঠায় তবে ফোনে সরাসরি বসের সাথে কথা বলুন। ফাঁদ এড়ানোর সহজ কৌশল হল, সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো লিংকে ক্লিক করবেন না।

৩. শক্তিশালী ও ভিন্ন ভিন্ন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন

ডার্ক এআই পাসওয়ার্ড ভাঙতে খুব দক্ষ। গবেষণায় দেখা গেছে, ৫০% পাসওয়ার্ড ডার্ক এআই এক মিনিটেরও কম সময়ে ভেঙে ফেলেছে আর ৮০% পাসওয়ার্ড ভাঙে এক সপ্তাহের মধ্যে। তাই বড় হাতের অক্ষর, ছোট হাতের অক্ষর, সংখ্যা এবং বিশেষ চিহ্ন মিলিয়ে শক্তিশালী পাসওয়ার্ড তৈরি করুন।

সব পাসওয়ার্ড মাথায় রাখার দরকার নেই। বরং একটি নিরাপদ পাসওয়ার্ড ম্যানেজারে সেগুলি সংরক্ষণ করাই নিরাপদ।

৪. মাল্টি ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন (এমএফএ) চালু করুন

ধরুন আপনার পাসওয়ার্ড কোনোভাবে ডার্ক এআই ভেঙে ফেলল। তবুও এমএফএ বা ২-ধাপে যাচাই করার ব্যবস্থা থাকলে অ্যাকাউন্টে ঢোকা অনেক কঠিন হয়ে যায়। কারণ এখানে পাসওয়ার্ডের পর একটি অতিরিক্ত নিরাপত্তা ধাপ লাগে যেমন এসএমএস কোড, ইমেইল ওটিপি ও বায়োমেট্রিক। এগুলি চুরি করা বা নকল করা অপরাধীদের জন্য অনেক কঠিন।

৫. নতুন প্রতারণার ট্রিক সম্পর্কে সচেতন থাকুন

ডার্ক এআই-ভিত্তিক প্রতারণা প্রতিদিনই আরও নতুন রূপ নিচ্ছে। মাসে একবার হলেও সাইবার সিকিউরিটি রিপোর্ট বা খবর দেখে আপডেট থাকলে অনেক প্রতারণা এড়ানো যায়। এক মিনিটে পড়া খবর, অনেক সময় লক্ষ টাকার ক্ষতি থেকে বাঁচাতে পারে।

৬. ডিপফেইক এবং ভয়েস ইম্পারসোনেশন সম্পর্কে সতর্ক থাকুন

ডিপফেইক ফোন কল বা ভিডিওতে বিভ্রান্ত হয়ে কখনোই টাকা পাঠাবেন না বা ব্যক্তিগত তথ্য দেবেন না। অন্য মাধ্যম দিয়ে ব্যক্তিটি আসলেই তিনি কিনা, যাচাই করে নিন।

৭. অনলাইনে অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করবেন না

ডার্ক এআই সবার সামাজিক প্ল্যাটফর্ম, পাবলিক সোর্স বা ওয়েবসাইট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ব্যবহার করতে পারে। আপনি যদি নিজের জন্মতারিখ, ঠিকানা, পরিবার, চাকরি, অফিসের পদবি বা বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য খোলাখুলি শেয়ার করে থাকেন তাহলে প্রতারকরা এগুলি ব্যবহার করে আপনার চরিত্র, অভ্যাস এবং দুর্বলতা বুঝে আরও ব্যক্তিভিত্তিক প্রতারণা তৈরি করবে।

শুধু “কোথায় থাকেন বা কী করেন” এমন সহজ তথ্য থেকেও ডার্ক এআই ভয়ঙ্কর আক্রমণ চালাতে পারে।

আরো পড়ুন: যেভাবে হ্যাকিং অসম্ভব করে তুলবে প্রজাপতি 

৮. অ্যান্টিভাইরাস এবং অ্যান্টিম্যালওয়্যার টুল ইনস্টল করুন ও আপডেট রাখুন

ডার্ক এআই যেমন একদিকে ম্যালওয়্যার বানাচ্ছে, তেমনি অ্যান্টিভাইরাসগুলিও নিজেদের উন্নত করছে। আজকাল উন্নত সিকিউরিটি সফটওয়্যারগুলি ডিপফেইক শনাক্তকরণ এবং এআই পাওয়ারড স্ক্যাম সুরক্ষা ব্যবহার করে অনেক নতুন ধরনের আক্রমণ শনাক্ত করতে পারে। সুতরাং ফোন, ল্যাপটপ ও অফিস সিস্টেমে নিয়মিত আপডেটেড সিকিউরিটি টুল ব্যবহার করাই ভবিষ্যতের হুমকি থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখার বড় উপায়।

অনুবাদ: সাম্প্রতিক ডেস্ক, সূত্র: নর্টন ডটকম