উপন্যাসের মূল চরিত্র ৩৬ বছর বয়সী এক পোট্রেট পেইন্টার। স্ত্রী ডিভোর্স দেওয়ার পর তিনি শহর ছেড়ে পাহাড় ঘেষা এক পুরানো বাড়িতে চলে যান। সেখানে গিয়ে তার স্ত্রীকে নিয়ে ভাবতে থাকেন, পাশাপাশি এও ভাবেন এরপরে কী করবেন।

জীবনের অনিশ্চিত সময়ে আরো দুজন অচেনা লোকের ভাগ্য এসে জড়িয়ে যায় তার সঙ্গে। তাদের জীবনও কঠিন মুহূর্তে এসে দাঁড়িয়েছে, তাদের সিদ্ধান্ত তাকে ভীত করে। তিনি যেই বাড়িতে এসে উঠেছেন, এর অাগে সেখানে থাকত বিশ্বখ্যাত পেইন্টার তোমোহিকো অ্যামাডা। অ্যামাডা একদম একা থাকত, চিলেকোঠায় সে একটা রহস্যময় পেইন্টিং লুকিয়ে রেখেছিল, যার নাম ‘কিলিং কমেন্ডেটোর’।

এ বছর ফেব্রুয়ারিতে বের হওয়া হারুকি মুরাকামির নতুন উপন্যাস ‘কিশিদানচো গোরোশি’। ৫০০ পাতার এই উপন্যাসের ইংরেজি নামকরণ করা হয় ‘Killing Commendatore’।

অার আন্যদিকে তার অদ্ভূত প্রতিবেশী। যাকে আঁকাটা তার কাছে দুঃসাধ্য বলে মনে হয়। এই লোক দুইজনের মধ্যে ঠিক কী আছে, তার সঙ্গেই বা তাদের সম্পর্ক কী, কী-ই বা লুকাচ্ছে তারা? অার তাদের পেইন্টিংগুলিই বা কী গোপন বার্তা দিচ্ছে তাকে — এই রহস্য নিয়েই মুরাকামি’র নতুন উপন্যাস ‘কিলিং কমেন্ডেটোর’।

‘কিশিদানচো গোরোশি’, দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তে।

তরুণ মুরাকামি ১৯৮৭ সালে তার রোমান্টিক বেস্ট সেলার ‘নরওয়েজিয়ান উড’ দিয়ে লাইম লাইটে আসেন। তার উপন্যাস বাস্তব-অতিবাস্তব, একঘেয়েমি-কল্পরাজ্য, স্বাভাবিক জীবন ও অস্বাভাবিক ঘটনা এসবের সীমারেখা নিয়ে কাজ করে।

৫০০ পাতা করে ২ ভলিউমে লেখা উপন্যাস ‘কিশিদানচো গোরোশি’কে ইংরেজিতে ১ ভলিউমে প্রকাশ করা হয়েছে। 1Q84 উপন্যাস প্রকাশের পর গত ৭ বছরে মুরাকামি এ রকম ভলিউমের বই আর লেখেন নি। যদিও ছোট কিছু কাজ করেছেন তিনি এর মধ্যে।

মুরাকামির লেখা এ পর্যন্ত ৫০ টার বেশি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। উপন্যাস ছাড়াও তিনি ছোটগল্প ও ননফিকশন লেখেন, এবং ইংরেজি থেকে জাপানি ভাষায় বই অনুবাদ করেন। শিনচোশা পাবলিশিং কোম্পানি বইটার প্রথম এডিশনে ১.৩ মিলিয়ন কপি ছাপানোর পরিকল্পনা করে।

বইটার ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ উপলক্ষে অক্টোবরের (২০১৮) প্রথম সপ্তাহে তিনি অল্প কয়েকদিনের জন্যে জাপান ছেড়ে নিউ ইয়র্ক শহরে গেছেন। সেখানে সেন্ট্রাল পার্কে ঘণ্টা খানেক জগ করা শেষে প্রকাশকের অফিসে এসেছিলেন, সাক্ষাৎকার দিতে। সাক্ষাৎকারগ্রহীতা সারাহ লায়াল ।  সারাহ নিউ ইয়র্ক টাইমসে লেখক হিসেবে কাজ করেন।  ইন্টারভিউর নির্বাচিত অংশ ছাপায় নিউ ইয়র্ক টাইমস। এখানে সে অংশের অনুবাদ থাকছে।

কিশিদানচো গোরোশি’র ইংরেজি সংস্করণ ‘কিলিং কমেন্ডেটোর’ এর দুটি প্রচ্ছদ

 

হারুকি মুরাকামির সাক্ষাৎকার

সারাহ লায়াল

 

লায়াল

‘কিলিং কমেন্ডেটোর’ এর আইডিয়াটা কীভাবে পেলেন?

মুরাকামি

আমি জানি না। মনের গভীরের কোনো জায়গা থেকে এটা তুলে নিয়েছি। একেবারেই হঠাৎ করে। প্রথমে একটা বা দু্ইটা প্যারাগ্রাফ লিখতে চেয়েছিলাম। কোনো ধারণাই ছিল না পরবর্তীতে কী হতে যাচ্ছে। এরপর এইটা ডেস্কের ড্রয়ারে ফেলে রেখেছিলাম, তারপর বাকিটা শুধু অপেক্ষা।

 

লায়াল

বইয়ের বাকি অংশ কীভাবে হল?

মুরাকামি

আমার একদিন মনে হল যে এইটা লিখতে পারব। শুরু করে দিলাম এবং লেখা চালিয়ে গেলাম। অপেক্ষা করলে, সঠিক সময় আপনার কাছে আসবে। আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে যে আপনি আইডিয়া পাবেন। আমি ৪০ বছর ধরে লিখছি ফলে, জানি কাজটা কীভাবে করতে হয়।

লায়াল

লেখার ব্যাপারটা কি আপনার জন্য কঠিন?

মুরাকামি

যখন নিজের লেখা না লিখে অনুবাদ করি, অপেক্ষা করি তখনকার জন্য খুব ভাল কাজ: নিজেই লিখছি কিন্তু এটা আবার নিজের উপন্যাস না। সুতরাং জিনিসটা অনেকটা ট্রেনিংয়ের মত, বা শারীরিক শ্রমের মত। তাছাড়া, আমি দৌড়াই অার রেকর্ড শুনি, আয়রনিংয়ের মতো পারিবারিক কাজ করি। এমন না যে লেখার সময় আমার মন অবাধ্য থাকে। এইটা মূলত আনন্দের।

এ বছর ফেব্রুয়ারিতে (২০১৮) জাপানে ‘কিশিদানচো গোরোশি’ প্রকাশের পর মুরাকামি ফ্যানদের বই কেনার উৎসব।

লায়াল

আপনি আপনার রিভিউগুলি পড়েন?

মুরাকামি

আমি রিভিউ পড়ি না। অনেক লেখক বলেন যে পড়েন, এবং তারা মিথ্যা বলেন — কিন্তু আমি মিথ্যা বলছি না। যদিও আমার স্ত্রী প্রতিটা রিভিউ পড়ে, এবং খারাপ রিভিউগুলিই কাছে জোরে জোরে পড়ে। আমাকে বলে খারাপ রিভিউগুলি গ্রহণ করতে হবে, ভাল রিভিউগুলি ভুলে যাও।

লায়াল

আপনার বইগুলি সুরিয়াল ও কল্প রাজ্যের জিনিসপত্রে ভর্তি। আপনার জীবনও কি এইরকম?

মুরাকামি

আমি বাস্তববাদী মানুষ, একজন প্র্যাকটিক্যাল মানুষ, কিন্তু আমি যখন ফিকশন লিখি তখন আমি নিজের মধ্যে একটা উদ্ভট অার গোপন জায়গায় চলে যাই। আমি যেটা করছি সেটা হল নিজের অনুসন্ধান — নিজের ভিতরে। আপনি যদি চোখ বন্ধ করে নিজের ভিতরে ডুব দেন তাহলে ভিন্ন একটা জগৎ দেখবেন। এটা অনেকটা মহাবিশ্ব অনুসন্ধান করার মত, তবে সেটা নিজের মধ্যে। আপনি যখন একটা বিপজ্জনক ও ভয়ঙ্কর জায়গায় যাবেন, তখন ফিরে আসার রাস্তাটা জানা থাকা জরুরি।

লায়াল

মনে হচ্ছে, নিজের কাজের অন্তর্নিহিত অর্থ নিয়ে বেশি বলাটা আপনার জন্য কঠিন।

মুরাকামি

লোকজন সবসময়ই আমাকে বই নিয়ে জিজ্ঞেস করে—আপনি এটা দিয়ে কী বুঝিয়েছেন; ওটা দিয়ে কী বুঝিয়েছেন। কিন্তু আমি আদৌ কিছু ব্যাখ্যা করতে পারি না। আমি আমার নিজের সম্পর্কে কথা বলি এবং জগৎ সম্পর্কে কথা বলি, রপকের মাধ্যমে। আপনি রূপক ব্যখ্যা বা বিশ্লেষণ করতে পারবেন না—এটা যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায় আপনাকে গ্রহণ করতে হবে। বইটা হল একটা রূপক।

লায়াল

আপনি বলেছেন যে ‘কিলিং কমেন্ডেটোর’ হল ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবি’র প্রতি একটা সম্মান প্রদর্শন, যে উপন্যাসটা আপনি দশ বছর আগে জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। ‘আমেরিকান ড্রিম’ এর সীমাবদ্ধতার দুঃখগাঁথা হিসেবে ‘গ্যাটসবি’কে পড়া যেতে পারে। আপনার নতুন বইতে এটা কীভাবে কাজ করেছে?

দ্য গ্রেট গ্যাটসবি - এফ. স্কট ফিটজেরাল্ড
দ্য গ্রেট গ্যাটসবি, ১৯২৫ সালে প্রকাশিত প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদের ছবি।
Francis Scott Key Fitzgerald (১৮৯৬ – ১৯৪০)

মুরাকামি

‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবি’ আমার প্রিয় বই। ১৭ বা ১৮ বছর বয়সে আমি এটা পড়েছিলাম, যখন স্কুল থেকে বের হয়ে গিয়েছি। তখন বইটার গল্প পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম কারণ বইটা একটা স্বপ্ন নিয়ে—এবং স্বপ্ন ভেঙে গেলে মানুষ কেমন আচরণ করে তা নিয়ে। আমার জন্য এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা থিম। আমার মনে হয় না জিনিসটা আবশ্যিকভাবেই আমেরিকান ড্রিম, বরং এটা একজন তরুণের স্বপ্ন, সাধারণভাবেই একটা স্বপ্ন।

লায়াল

আপনি কী নিয়ে স্বপ্ন দেখেন?

মুরাকামি

আমি স্বপ্ন দেখি না, হয়ত মাসে এক বা দুইবার—অথবা হয়ত আমি অনেক স্বপ্ন দেখি কিন্তু সেই স্বপ্ন আদৌ মনে করতে পারি না। তবে আমাকে স্বপ্ন দেখতে হয় না, কারণ আমি লিখতে পারি।