২৯ আগস্ট, ২০১৭ তারিখে পরিচালক জেমস ক্যামেরনের বিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন সিনেমা ‘টার্মিনেটর টু : জাজমেন্ট ডে’ থ্রিডিতে মুক্তি দেওয়া হবে। এর প্রচারণায় ২৪ আগস্ট ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার সাংবাদিক হেডলি ফ্রীম্যানকে এই সাক্ষাৎকারটি দিয়েছেন তিনি। এতে হলিউডের বর্তমান সব বড় বাজেটের সিনেমা আর সহকর্মীদের প্রতি তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নিজের চিন্তাভাবনা শেয়ার করেছেন ক্যামেরন।

সাক্ষাৎকার: হেডলি ফ্রিম্যান

অনুবাদ: আয়মান আসিব স্বাধীন


জেমস ক্যামেরন। ব্যবসায়িকভাবে বিশ্বের সবচাইতে সফল পরিচালক। ভদ্রলোক নিজের অনুকরণ নিজেই করতে পছন্দ করেন। এর আগের বার যখন আমি তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম তখন শেষের অভিজ্ঞতাটা তেমন সুখকর হয় নাই। ২০১২ সাল, থ্রিডি ব্লুরে-তে টাইটানিক সিনেমা মুক্তির প্রচারণা চালাতে নিউজিল্যান্ডের খামারবাড়ি থেকে বেলফাস্টের টাইটানিক মিউজিয়ামে এসেছিলেন ক্যামেরন। তার ১৪ বছর আগে বানানো এই ছবি নতুন করে এমন একটা ফরম্যাটে (থ্রিডি) মুক্তি দেওয়া হচ্ছিল যা নিয়ে খুব কম মানুষেরই সত্যিকার মাথাব্যথা আছে। কিন্তু তাই বলে যদি আপনি মনে করেন এজন্যে অর্ধেক পৃথিবী পাড়ি দিয়ে কথা বলতে আসার মত আগ্রহ তার নাই—তাহলে আপনি জেমস ক্যামেরন সম্বন্ধে কিছুই জানেন না।

‘টার্মিনেটর টু : জাজমেন্ট ডে’ সিনেমার সেটে আর্নোল্ড শোয়ার্জনেগারের সাথে জেমস ক্যামেরন

আত্মম্মন্য দানবদের দিয়ে ভরা এই শহরেও ক্যামেরনের একগুঁয়েমিতার গল্পগুলি রীতিমত হলিউড কিংবদন্তীর অংশ। ‘অ্যাভাটার’ সিনেমার শুটিংয়ে কর্মীদের মোবাইল বেজে উঠলে তিনি এতটাই রেগে যেতেন যে, নেইলগান দিয়ে একদম গেঁথে দিতেন দেয়ালের সাথে (কর্মীদেরকে না, ওই মোবাইল ফোনগুলি গেঁথে দিতেন; যদিও উল্টাটা হওয়ার ভাল সম্ভাবনা ছিল)। ‘দি অ্যাবিস’ (১৯৮৯) সিনেমার শুটিংয়ের সময় তো ক্রু মেম্বাররা এক বিশেষ টি-শার্ট পরে ঘুরে বেড়াতেন, যাতে লেখা থাকত—”আমাকে ভয় দেখাতে পারবে না। আমি জেমস ক্যামেরনের হয়ে কাজ করি।”

সেই সাক্ষাৎকারে জেমস তার ১২ বছর পুরানো সিনেমার থ্রিডি করা নিয়ে এমন ভাবে কথা বলছিলেন যেন তা চলচ্চিত্রের উন্নয়নে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো সংযোজন। ওইদিন তার মেজাজ বেশ ঠিকঠাক মনে হয়েছিল আমার কাছে। তাই টাইটানিকের যে বিষয়টা আমাকে অনেক ভাবিয়েছে, সে ব্যাপারে একটা প্রশ্ন করে ফেলা নিরাপদই মনে হচ্ছিল : “আচ্ছা, বেচারা জ্যাককে সমুদ্রে জমে দিতে না দিয়ে বরং রোজ তার বিশাল কাঠের বোর্ডটা ওর সাথে শেয়ার করল না কেন?” প্রশ্ন শুনে রাগের চোটে তার চেহারা যেন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠল। “আচ্ছা এক মিনিট। আমি শেক্সপিয়ারকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেছি কেন রোমিও আর জুলিয়েটকে মরতে হয়েছিল!” আপনারাও আমাকে ভয় দেখাতে পারবেন না। আমি জেমস ক্যামেরনের সাক্ষাৎকার নিয়েছি।

এবার তার বাসা থেকে একটু সামনে ম্যালিবু’তে একটা হোটেল রুমে দেখা করলাম আমরা। এবারও আমরা তার পুরানো একটা সিনেমা নিয়ে আলাপ করছি, যা নতুন করে থ্রিডি করা হয়েছে: টার্মিনেটর টু জাজমেন্ট ডে। যদিও দেখতে তিনি আগের মতই আছেন—সেই ৬ ফুট ছাড়ানো লম্বা, একগাছি সাদা চুল আর উজ্জ্বল নীল চোখ—কিন্তু এবার কিছু একটা যেন অন্য রকম। রুমের ভেতর ঘুর ঘুর করার বদলে চেয়ারের ওপর আরাম করে বসে আছেন। হ্যান্ডশেকও বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ, আগের মত হাড়ভাঙা না। গত কয়েক বছরে কি তিনি বদলে গেছেন তাহলে?

“হ্যাঁ, কাজের ক্ষেত্রে আমার আচরণ এখন অনেকটাই বন্ধুসুলভ হয়ে গেছে,” সাথে সাথে জবাব দিলেন তিনি, “আমি এটা শিখে নিয়েছি আসলে। ঠিক আছে, সিনেমাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সেই সাথে জীবনের অবস্থানগত বৈশিষ্ট্যগুলিও দরকারি। কিন্তু এই শিল্পটা আমাকে শিখতে হয়েছে। আমার মনে হয় রন হাওয়ার্ডের এটা ভেতর থেকেই আসে—তিনি একজন সহজাত ভাল মানুষ। আমিও সহজাত ভাল লোক, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে ওই দিকটা নিয়ে আসতে আমাকে কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে অনেক।”

দাম্পত্য জীবনে স্থিরতা তাকে এরকম বন্ধুত্বপূর্ণ হতে সাহায্য করেছে কিনা ভাবছি। তার বর্তমান স্ত্রী সুজি এমিস টাইটানিক সিনেমায় নাতনির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তাদের সংসার টিকে আছে আজ ১৭ বছর ধরে—ক্যামেরনের বিবাহিত জীবনে এখনো পর্যন্ত যা কিনা সবচেয়ে লম্বা সময়। কিন্তু এরকম কোনো সংযোগ আসলে জেমস ক্যামেরনের মত মানুষের জন্য একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ের। বরং মানসিক স্থিতির জন্য তিনি একান্তই ক্যামেরনীয় এক কারণ দেখালেন—গভীর সমুদ্র অভিযান। কারণ দুনিয়ার সবচাইতে উচ্চাভিলাষী সিনেমা বানাতে গেলেও ক্যামেরনের শক্তিমাত্রা তেমন উদ্দীপিত হয় না। তাই অবসর সময়ে মিনি সাবমেরিনে চড়ে সমুদ্রের নিচে ঘুরে বেড়ান তিনি। ২০১২ সালে প্রথম ব্যক্তি হিসাবে একক অভিযানে সমুদ্রতলের সবচেয়ে গভীর অংশ ‘মারিয়ানা ট্রেঞ্চ’ ঘুরে এসেছিলেন। যে সাবমেরিনে চড়ে গিয়েছিলেন, সেটার নকশাও তার করা; এঞ্জিনিয়ারদের একটা গ্রুপের সাহায্যে বানানো।

“আমি এ রকম আটটা গভীর সমুদ্র অভিযানে গিয়েছি। এ অভিযানগুলিতে দিনশেষে বড় কোনো সিনেমার আয়োজন থাকে না, কোনো রেড কার্পেট থাকে না। থাকে শুধু গুটিকয়েক মানুষ, যারা জানেন এটা কত কষ্টকর এক কাজ। এই আবহের সাথেই আপনার বন্ধন তৈরি হয়। তাই আমি অনুধাবন করলাম, কাজ শেষে একটা ভাল সিনেমা নিশ্চিত করা ঠিক আছে—কিন্তু এটাই সবচেয়ে জরুরি জিনিস না। বরং কাজ করার পরিবেশটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”

এ ছাড়া ক্যামেরন সাগরের তলায় টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ বেশ কয়েকবার ঘুরে দেখে এসেছেন (“অন্য যে কারো চাইতে আমিই ওখানে বেশি গিয়েছি”—জোর দিয়ে বললেন তিনি)। আবার সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে যাওয়ার পরিকল্পনায় নাসা’র সাথেও কাজ করছেন। মঙ্গলগ্রহে মানুষ পাঠানোর মিশন রেকর্ড করবেন তিনি।

তার সবকিছুই কি এত বড় পরিসরে হতে হবে? একটা ছোটখাটো ইন্ডি রোমান্টিক কমেডি বানানো যায় না? বা ডিঙিতে করে মাছ ধরতে যাওয়া?

“আমি এমন সব জিনিস খুঁজে বেড়াই যা আগে কখনো করা হয় নাই। যেসব আমি করতে পারব বলে আমার মনে হয় এবং যে জিনিসগুলি এখনো করা হয় নি—এ দু’য়ের মাঝে ফাঁকটা খুঁজে বের করতে পছন্দ করি আমি। এখন পর্যন্ত আমি যা কিছু করেছি, তার সবই ওই ছোট শূন্যস্থানকে অবলম্বন করে: প্রতিটা অভিযান, আমাদের বানানো রোবোটিকসের প্রতিটা অংশ, প্রত্যেকটা ক্যামেরা সিস্টেম, সমুদ্রতলের যন্ত্রপাতি—সবকিছু ওই এক প্যাটার্নের ভেতর।”

এবার আসি টার্মিনেটর টু এর প্রসঙ্গে—আমার সবচেয়ে প্রিয় ক্যামেরন মুভি। প্রিয় হবার একটা প্রধান কারণ, টার্মিনেটর টু ক্যামেরনের প্রথম ছবি যেটা আমি বড় পর্দায় দেখেছিলাম। আর তিনি এমন একজন নির্মাতা যার চলচ্চিত্র বড় পর্দাতেই উপভোগ করতে হয়। টি-১০০০ (রবার্ট প্যাট্রিক) কে তরল ধাতু থেকে মানুষে রূপ নিতে দেখে আমার মুখ হা হয়ে যায়। এই ইফেক্টের জন্য ক্যামেরন নিজেই নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা এখনো পর্যন্ত আমার চলচ্চিত্র দর্শনের সবচাইতে স্মরণীয়গুলির একটি।

টাইটানিক সিনেমার শুটিংয়ে জেমস ক্যামেরন, লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও ও কেট উইন্সলেট

“দ্যাট ইজ সো কুল,” হাসতে হাসতে বললেন তিনি, “আসলে সে সময়ে নতুনত্ব দিয়ে সিনেমাটা যে চমক সৃষ্টি করেছিল, ওইটা এখন আমাদের পক্ষে করা সম্ভবই না। তবে আপনাদেরকে বেশ জাঁকালো ও সমৃদ্ধ এক অভিজ্ঞতা দেওয়া যেতে পারে।”

এই ‘অভিজ্ঞতা’ সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা থেকেই ক্যামেরন তার পূর্ববর্তী কাজগুলি থ্রিডিতে রূপান্তর করার জন্য এত সময় ব্যয় করছেন। জেমস ক্যামেরনের কোনো সিনেমা আপনাকে তাক লাগাতে ব্যর্থ হবে, এমনটা হতে পারে না—এমনকি মুক্তির তিন দশক পরেও। কিন্তু স্পেশাল ইফেক্টের ওপর যতই মনোযোগ দেওয়া হোক না কেন, দর্শকদের মাঝে তার সিনেমার এতটা দীর্ঘস্থায়ী আবেদনের আসল কারণ তিনি একজন প্রকৃত গল্পকার। এ জন্যেই তার ছবিগুলি থেকে এক ধরনের মজা পাওয়া যায় যা মাইকেল বে’র ছবিতে পাওয়া যায় না।

টার্মিনেটরের প্রথম খণ্ড যে এত বিশাল হিট হবে তা কেউ প্রত্যাশা করে নাই। তাই ডার্টি হ্যারি’র মত বেশ একটা রুক্ষ নৈরাশ্যবাদী আবহ ছিল ছবিটাতে। কিন্তু টার্মিনেটর টু লেখার সময় ক্যামেরন জানতেন, এবারের খণ্ড যতটা সম্ভব জনসাধারণের উপযোগী হতে হবে। তাই শোয়ার্জনেগারের ভয়ঙ্কর খুনী রোবটের চরিত্রকে পাল্টে এক ধরনের কমেডি এক্সচেঞ্জ স্টুডেন্ট বানিয়ে দেওয়া হল; যেন কোনো এলিয়েন ভিনগ্রহে এসে একই সাথে মুগ্ধ ও হতভম্ব হচ্ছে।

“আর্নল্ডের তো প্রথমে গল্পটা একদমই পছন্দ হয় নাই। তিনি আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যাতে এই প্রজেক্ট নিয়ে আর না আগাই আমরা। কিন্তু আমি বললাম: ‘না, আমরা এটাই করব। দিস ইজ রিয়েলি কুল।’ তারপর ধীরে ধীরে তিনি গল্পের গভীরতা দেখা শুরু করলেন,”স্বয়ং কোনানও তাকে রুখতে পারেন নাই বলে হয়ত”, কিছুটা গর্ব নিয়েই কথাগুলি বললেন জেমস।

সে সময়কার সবচেয়ে ব্যয়বহুল সিনেমাগুলির মাঝে অন্যতম ছিল টার্মিনেটর টু, যার নির্মাণে খরচ হয়েছিল প্রায় ২০ কোটি ডলার। আবার আয়ের দিক থেকেও ছিল শীর্ষ তালিকাভুক্ত—প্রায় ৫০ কোটি ডলারেরও বেশি। অবশ্য এ দুই বৈশিষ্ট্যই এরপর ক্যামেরনের প্রায় সব ছবির নিয়মিত অনুষঙ্গ হয়ে যায়। তবে একজন প্রযোজক একটু উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে এর সবকিছুই হয়তো ভেস্তে যেতে পারত।

“ওরিয়ন পিকচার্সের মাইক মেডেভয় এক রাতে আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, ‘এই মাত্র একটা পার্টির সাথে কথা বলে তোমার সিনেমার জন্য অভিনেতা নির্বাচিত করে ফেললাম!’ যে কোনো নির্মাতারই এ খবর শুনে খুশি হওয়ার কথা যে, হোমড়া চোমড়া এক প্রযোজক তার সিনেমার কাস্টিং করে ফেলেছেন। কিন্তু তিনি বললেন, ‘ওকে, টার্মিনেটরের চরিত্রে থাকবেন ওজে সিম্পসন।’ আমি বললাম: ‘হেই মাইক, খুবই বাজে আইডিয়া। আপনি সিনেমাতে দেখাতে চান, একজন কালো অ্যাথলিট হাতে ছুরি ও বন্দুক নিয়ে সাদা চামড়ার এক মহিলাকে লস অ্যাঞ্জেলেসের রাস্তায় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছেন? না, এ রকম কিছু করা যাবে না।’ ভাগ্য ভাল সে রকম কিছু হয় নাই। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, শিল্পের বশবর্তী হয়ে শেষ পর্যন্ত বাস্তবেই যেন এ রকম ঘটনা ঘটে গেল।”

তবে ওজে সিম্পসনের বদলে শোয়ার্জনেগারকে নেওয়ার ব্যাপারে ক্যামেরনের সিদ্ধান্ত যতটা বুদ্ধিমান হোক না কেন, সারাহ কনোরের ভূমিকায় লিন্ডা হ্যামিলটনের জন্যই ছবিটা এত আলাদা হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে। পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গিকে তোয়াক্কা করার তো প্রশ্নই আসে না, বরং কাউকেই তুষ্ট করতে আগ্রহী না এই বলিষ্ঠ নারী চরিত্র ১৯৯১ সালে যদি বিরল হয়ে থাকে—তবে আশ্চর্যজনকভাবে তা আজকেও অনন্য। এলিয়েন সিনেমার রিপলি এই চরিত্রের একমাত্র পূর্বসূরী। এর ঠিক পাঁচ বছর আগেই রিডলে স্কটের কাছ থেকে এলিয়েনের দ্বিতীয় খণ্ড এলিয়েন্স নির্মাণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন জেমস ক্যামেরন। আর যথারীতি তিনি রিপলিকে পার্শ্বভূমিকা থেকে নিয়ে আসেন একেবারে কেন্দ্রে।

সারাহ কনোরের ভূমিকায় লিন্ডা হ্যামিলটন

তাই যতই পৌরুষ থাকুক না কেন, ক্যামেরন প্রায় সব সময় সত্যিকার দৃঢ় নারী চরিত্রদেরকে তার সিনেমাগুলির কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে থাকেন। দি অ্যাবিস-এর ড. লিন্ডসে ব্রিগম্যান থেকে শুরু করে টাইটানিক-এর রোজ—সব ক্ষেত্রেই তেমনটা দেখা যায়। তো সম্প্রতি ওয়ান্ডার ওম্যান নিয়ে যে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছিল, সে ব্যাপারে তার মন্তব্য কী?

“ওয়ান্ডার ওম্যানকে নিয়ে আত্মতুষ্ট হয়ে হলিউড নিজেই যেভাবে নিজের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে—তাতে গোটা ব্যাপারটা অনেক বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠছে সবার জন্য। ওয়ান্ডার ওম্যান একটা অবজেক্টিফাইড আইকন। ফলে তাকে পুরুষশাসিত হলিউড সেই আগের মতই নিয়ন্ত্রণ করছে। আমি বলছি না যে সিনেমাটা আমার পছন্দ হয় নাই, কিন্তু এই ছবি দিয়ে আমরা উল্টো পিছিয়ে গেলাম। সারাহ কনোর কোনো সৌন্দর্যের আইকন ছিল না। সে শক্তিশালী হলেও মানসিকভাবে ছিল জর্জরিত। আর মা হিসাবে তার অবস্থা একেবারেই শোচনীয়, কিন্তু তারপরও সে সম্পূর্ণ দৃঢ়তা দিয়ে দর্শকদের শ্রদ্ধা আদায় করে নিয়েছে। আর আমার কাছে সারা কনোরের মত চরিত্র থাকার সুবিধা একদম স্পষ্ট—কারণ দর্শকদের অর্ধেক নারী।”

তাহলে প্রকৃত শক্তিশালী নারী চরিত্র প্রদর্শনে সিনেমাগুলি এখনো কেন ভাল করতে পারছে না?

প্রথম বারের মত ক্যামেরন যেন কথা বলার শব্দ হারিয়ে ফেললেন। “আমি—আমি জানি না। হলিউডে ক্ষমতাসীন অনেক নারী আছেন। কী ধরনের সিনেমা নির্মিত হবে তার নকশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তারা। আমার মনে হয়… না, এর কৈফিয়ত আমি দিতে পারব না। কারণ আর কতবার একই জিনিস করে দেখাতে হবে আমাকে? মনে হচ্ছে আমি যেন কোনো উইন্ড টানেলের মুখে চিৎকার করছি।”

ক্যামেরন দৃঢ় নারী চরিত্র লিখতেই শুধু পছন্দ করেন না, দৃঢ় চরিত্রের নারীদেরকে বিয়ে করার অভ্যাসও তার আছে। এখনো পর্যন্ত পাঁচবার বিয়ে করেছেন তিনি। এদের মাঝে আছেন পরিচালক ক্যাথরিন বিগেলো। এছাড়া আছেন টার্মিনেটর সিরিজের সাথে যুক্ত আরো দুইজন: প্রযোজক গেইল অ্যান হার্ড, তারপর লিন্ডা হ্যামিলটন।

“শক্তিশালী স্বাধীন নারীতে আকৃষ্ট হবার অসুবিধাটা হলো, তারা স্বনির্ভর ও শক্তিশালী নারী—আপনাকে তাদের দরকারই নাই!” হেসে হেসে বললেন তিনি। “সৌভাগ্যক্রমে এমন এক স্বাধীন শক্তিশালী নারী এখন আমার স্ত্রী যিনি আসলেই বিশ্বাস করেন আমাকে তার দরকার আছে।” (তাদের বিচ্ছেদের ব্যাপারে লিন্ডা হ্যামিলটন অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণ দেখিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে তিনি বলেন, “তার বাসায় গিয়ে ওঠার সাথে সাথেই আমি বুঝে ফেলেছিলাম, আমার ভুল হয়েছে। সে তখন কর্তৃত্ববান পরিচালকের ভূমিকায়। সিনেমার সেটে যে লোকটাকে আমি দেখতাম, তিনি যেন ব্যক্তিগত জীবনেও চলে আসলেন। পুরো পরিবেশ ছিল তার নিয়ন্ত্রণে, আমার কথার তেমন দামই ছিল না।”)

টার্মিনেটর টু এর শুটিংয়ের সময়ই কি লিন্ডা ও ক্যামেরনের প্রেম শুরু হয়?

“না। অবশ্যই না। শুটিং শেষ হবার পর পরই আমরা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। কিন্তু শুটিং চলাকালীন কোনো অভিনেত্রীর সাথে প্রেম না করা এমন একটা নিয়ম যা আমি কখনোই ভাঙব না। বিবাহিত জীবন নিয়ে এখন বেশ সুখী আমি। বাকি জীবনও তেমনটাই থাকবে। একজন পরিচালক হিসাবে এই নিয়ম আপনি ভঙ্গ করতে পারেন না। এমনকি টাইটানিকের সময় যখন সুজি আর আমার প্রথম দেখা হয়, আমরা… আমরা কিন্তু—” আবারো কিছুটা থেমে গেলেন তিনি, যেন শব্দ হারিয়ে ফেলেছেন। “আমার মনে হয়, শুটিং শেষ হবার দশ সেকেন্ডের মাথায়ই…।”

স্ত্রী সুজি এমিসের সাথে জেমস ক্যামেরন

হ্যামিল্টন আর ক্যামেরনের একটি মেয়ে আছে আর এমিসের সাথে তার সন্তান আছে তিনজন। তারা নিউজিল্যান্ড ও ম্যালিবুতে ভাগাভাগি করে সময় কাটান। জায়গাটা নিশ্চয়ই খুব মনোরম, কিন্তু আমার মনে হয় না ক্যামেরনের সাথে থাকা তেমন স্বস্তিদায়ক কোনো অভিজ্ঞতা। “বিশ্রাম করার ক্ষেত্রে আমি তেমন সুবিধার না, এটা সত্যি।” বললেন তিনি, “আমার কাছে ছুটি কাটানো হল পুরা পরিবারকে নিয়ে তাহিতিতে গিয়ে জলযানে করে পানির নিচে ছবি তুলে গোটা সপ্তাহ পার করা।”

আগামী আট বছর তিনি অ্যাভাটারের আরো চারটা—চারটা!—সিনেমা বানানো নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন, এটা চিন্তা করলে তো তাকে বেশ শান্ত বলেই মনে হয়। তাছাড়া পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়েও তেমন একটা আশাবাদী না তিনি। নিরামিষাশী ও পরিবেশবাদী এই ভদ্রলোক ট্রাম্পের ভক্তও নন। ব্যাপারটা বিস্ময়কর।

অ্যাভাটার (২০০৯)—আরো চারটি খণ্ড আসছে এই ছবির

“দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এমন কিছু তিনি করেন নাই যা কাউকে অবাক করে দিতে পারে; কিন্তু যা যা করেছেন তার সবই ভয়াবহ। ইতিহাসের এই সঙ্কটপূর্ণ সময়ে যখন আমাদের সামনে এগোনোর কথা, সেখানে আমরা ভুল দিকে হাঁটছি। ভবিষ্যতে মানুষের দুর্দশা এমনিতেও বাড়ত, এখন তা আরো বেশি হতে যাচ্ছে,” বললেন তিনি।

আর এই উচ্ছ্বসিত মুহূর্তে এসেই আমাদের সময় শেষ হয়ে গেল। কিন্তু ক্যামেরনের মাঝে আসলেই পরিবর্তন এসেছে কিনা তা এখনো নিশ্চিত হতে পারি নাই আমি। তাকে পরীক্ষা করে দেখার একটা উপায় আছে শুধু।

“আচ্ছা,” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “একটা জিনিস নিয়ে আমি সবসময়ই চিন্তা করে এসেছি। টাইটানিকের শেষে পানিতে ভাসার সময় রোজ তার ওই বোর্ড জ্যাকের সাথে শেয়ার করতে পারল না কেন?”

হুট করে যেন অশুভ এক নীরবতা নেমে এলো চারিদিকে।

“ঠিক আছে, ঠিক আছে। এই কথা প্রায়ই শুনতে হয় আমাকে,” শেষ পর্যন্ত মুখ খুললেন তিনি, “এখন মনে হচ্ছে, বোর্ডটা আরো ছোট বানানো উচিৎ ছিল আমার,” তার মুখে হাসি।

ওহ জেমস ক্যামেরন, আসলেই আপনার উন্নতি হয়েছে।