আমাদের কাছে যেসব ধাতব পদার্থ বিষাক্ত বলে মনে হয়, পৃথিবীর কিছু গাছের বন্ধুত্ব সেসব পদার্থের সাথেই।

এসব গাছের শেকড় মাটি থেকে অনেকটা চুম্বকের মতোই ধাতব পদার্থ শুষে নেয়। এখন পর্যন্ত এমন প্রায় ৭০০ উদ্ভিদ পাওয়া গেছে।

এসব গাছ বেড়ে ওঠে ধাতব উপাদান সমৃদ্ধ মাটিতে, যেখানে সাধারণত অন্যান্য প্রজাতির উদ্ভিদ টিকতে পারে না।

এসব গাছের বাকল কাটলে বা পাতা পিষলে এক ধরনের নীলচে সবুজ রস বের হয়। এই রসের এক-চতুর্থাংশই আসলে নিকেল, যা প্রচলিত ধাতু প্রক্রিয়াজাত কারখানায় ব্যবহৃত খনিজে থাকা নিকেলের চেয়েও অনেক বেশি ঘন।

মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর অ্যালান বেকার বলেন, “এসব গাছ মাটি থেকে ধাতব পদার্থ শুধু শুষেই নেয় না বরং প্রচুর পরিমাণে তা মজুদও করে।“

প্রফেসর বেকার ১৯৭০ সাল থেকেই উদ্ভিদের সঙ্গে গোড়ার মাটির মধ্যে থাকা উপাদানের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করছেন। এই ধরনের উদ্ভিদের চাষাবাদ করে বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক এবং সৌর-চালিত ধাতু প্রক্রিয়াজাত কারখানা বানানো যেতে পারে। বর্তমানে প্রচলিত ব্যয়বহুল এবং পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর খনন ও বিগলন প্রক্রিয়ার আংশিক বিকল্প হিসেবেও যদি গাছ থেকে নিকেলের চাষাবাদ শুরু হয়, তাহলে কী ঘটবে?

ধারণাটি যে কেবল একটি মজাদার চিন্তার পরীক্ষা নয় তা বিশ্বকে বোঝানোর জন্য ড. বেকার এবং তার আন্তর্জাতিক সহকর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল এর দৃষ্টান্ত তৈরি করে দেখান।

ইন্দোনেশিয়ার বোর্নিও দ্বীপের মালয়েশীয় সীমান্ত এলাকার একটি গ্রামে এক খণ্ড জমি ভাড়া নিয়ে এই গাছ উৎপাদন করে স্বল্প মাত্রায় হলেও তারা বিষয়টি প্রমাণ করেছেন। প্রতি ৬ থেকে ১২ মাস পর পর একজন কৃষক এই গাছগুলি থেকে এক ফুট করে কেটে নিতেন এবং তা পুড়িয়ে বা নিংড়ে ধাতব রস বের করতেন। সেই রস পরিশোধনের পর, কৃষকরা তাদের হাতে প্রায় ৫০০ পাউন্ড নিকেল সাইট্রেট পেতেন। আন্তর্জাতিক বাজারে যার সম্ভাব্য মূল্য কয়েক হাজার ডলার।

বর্তমানে আরো বড় পরিসরে, প্রায় ৫০ একর জমিতে তারা এই গাছ থেকে নিকেল উৎপাদনের পরীক্ষা চালাচ্ছেন। যা এ সংক্রান্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। গবেষকরা আশা করছেন যে আগামি এক দশকের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী নারকেল ও কফির সমান নিকেল গাছ উৎপাদন করা গেলে বেজ মেটাল বা কম দামের ধাতু এবং বিরল খনিজের যে ঘাটতি আছে বাজারে তার বিশাল অংশই পূরণ করা সম্ভব হবে।

ড. বেকার বলেন, এটি হয়তো প্রচলিত খনিজ শিল্পের বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে না। তবে এর মাধ্যমে পৃথিবীর যেসব এলাকার মাটি বিষাক্ত হয়ে পড়েছে সেসব এলাকাকে পুনরায় উৎপাদনশীল করে তোলা যাবে। ছোট কৃষকরা ধাতব সমৃদ্ধ মাটিতে এই গাছ উৎপাদন করে নিজেদের ভাগ্যও বদলাতে পারবে। আর খনি কম্পানিগুলি এই গাছ লাগিয়ে তাদের পরিত্যক্ত খনি এলাকার মাটি বিষমুক্ত করতে পারবে এবং কিছু বাড়তি টাকাও কামাতে পারবে।

জর্জিয়াস অ্যাগ্রিকোলা (১৪৯৪-১৫৫৫)

আধুনিক খনিজ স্মেল্টিং- এর জনক জর্জিয়াস অ্যাগ্রিকোলা ৫০০ বছর আগেই এই সম্ভাবনা দেখেছিলেন। তিনি তার অবসর সময়ে গাছ থেকে ধাতু সংগ্রহের কাজ করতেন। সেই ষোড়শ শতকেই তিনি লিখেছেন, গাছের পাতায় কী খুঁজতে হবে তা যদি আপনি জানেন তাহলে মাটির নিচে কোন ধাতুর মজুদ রয়েছে তাও বুঝতে পারবেন।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগে ৪৭ বছর ধরে কাজ করা রুফুস শেইনি (Rufus Chaney) নামের একজন কৃষি অর্থনীতিবিদ ১৯৮৩ সালে ‘ফাইটোমাইনিং’ (phytomining) শব্দটি উদ্ভাবন করেন। আর ১৯৯৬ সালে ড. বেকার ওরেগনে এর প্রথম পরীক্ষা চালান। মালয়েশিয়ার সেই গ্রামের নিকেল শোষক গাছের বাগানের একটি গাছেও তার নাম খোদাই করে রাখা হয়েছে। তবে তারা এই প্রযুক্তির কোনো প্যাটেন্ট না করে বরং সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। ফলে এখন বিজ্ঞানীরা আশা করছেন নিকেল গাছের বাগান করে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার ছোট কৃষকরা তাদের ভাগ্য ফেরাতে পারবেন।

অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই খনিজ ইন্সটিটিউটের উদ্ভিদ বিজ্ঞানী অ্যান্টনি ভ্যান ডার অ্যান্ট বলেন, “আশার কথা হল আমরা বিষয়টি এখন করে দেখাতে পারি, মানে ধারণাটির বাস্তব প্রমাণও আছে এবং কীভাবে এটি কাজ করে তা লোককে আমরা দেখিয়েছি এবং তা কার্যকরও হয়েছে।” এই বিষয়ে তার গবেষণামূলক প্রবন্ধটিও শুরু হয়েছে মালয়েশিয়ার গ্রামের সেই নিকেল গাছ চাষের প্রকল্পের বিবরণ দিয়ে।

স্টেইনলেস স্টিলের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিকেল। এর রাসায়নিক উপাদানগুলি ব্যাটারি, ইলেকট্রিক যানবাহন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ব্যবহৃত হয় এবং দিনকে দিন এর ব্যবহার বাড়ছেই। নিকেল মানুষের জন্য যেমন তেমনি গাছেদের জন্যও বিষাক্ত। যেখানে নিকেলের খনি এবং পরিশোধন করা হয় সেখানে এর বিষাক্ত বর্জ্য পড়ে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়। পৃথিবীর যেসব অঞ্চলের মাটি নিকেল সমৃদ্ধ, বিশেষ করে ক্রান্তীয় এবং ভূমধ্যসাগরীয় অববাহিকায়, সেসব এলাকার উদ্ভিদরাজি হয় এর সঙ্গে নিজেদের অভ্যস্ত করে নিয়েছে আর নয়তো মরে গেছে।

দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের নিউ ক্যালেডোনিয়ায় উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা এমন ৬৫ ধরনের উদ্ভিদ শনাক্ত করেছেন যেগুলি নিকেল শুষে নিয়েও বেঁচে থাকতে পারে। নিউ ক্যালেডোনিয়া একটি ফরাসি অঞ্চল যা বিশ্ববাজারে নিকেল সরবরাহের একটি প্রধান উৎস।

নিকেল ছাড়াও কোবাল্ট, জিংক এবং নানা ধরনের বিরল খনিজ শোষণকারী গাছও আছে। ইলেকট্রনিকস খাতে বিরল খনিজের চাহিদা উত্তরোত্তর বেড়ে চলায় বড় বড় কম্পানিগুলি পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে এবং সমুদ্রের তলায়ও এখন সেসবের সন্ধান করছেন। ভবিষ্যতে হয়তো এমন এক দিন আসতে চলেছে যখন উদ্ভিদ এবং মেশিন একসঙ্গে বাস করবে। জৈব আকরিক, ধাতুর খামার, ধাতব ফসল প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার সেদিকেই যেন ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ফাইটোমাইনিং-এর প্রবক্তারা এই শিল্প বিকাশের সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইনে। দেশ দুটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় নিকেল আকরিক উৎপাদক। এই দুটি দেশে শত শত নিকেল খনি রয়েছে এবং বহু প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে যেগুলি উচ্চমাত্রায় নিকেল শুষে নিতে সক্ষম। এই উদ্ভিদগুলি ধাতব পদার্থ শুধু সহ্যই করতে পারে তা না বরং তাদের শেকড়গুলি যেন ধাতব পদার্থ ছাড়া বাঁচতেই পারবে না এমন হয়ে গেছে!

কিন্তু নিকেল শুষে গাছগুলির কী লাভ হয়? নিকেল শুষে নিয়ে গাছগুলি হয়তো কীট-পতঙ্গের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। অথবা নিকেলের মাধ্যমে হয়তো মাটি থেকে তারা আরো সহজে পটাশিয়ামও শুষে নিতে পারে। কেননা মাটিতে পটাশিয়ামের পরিমাণ খুবই কম থাকে।

আর গাছগুলির নিকেল শোষণ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সেগুলিতে কোনো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা সিলেক্টিভ ব্রিডিং করারও দরকার নেই। প্রাকৃতিকভাবেই সেগুলি ততটাই দক্ষ যতটা দক্ষ শিল্প কারখানার মেশিনগুলি।

খনি শিল্পের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল পরিত্যক্ত খনি, যা পরিবেশ ও পানিদূষণের অন্যতম কারণ। আর সেই সমস্যা সমাধানে কাজে লাগানো যেতে পারে এই ধাতব শোষক উদ্ভিদগুলিকে। পরিত্যক্ত খনি এলাকায় এই গাছ লাগিয়ে ধাতব সংগ্রহ করে তা থেকে আবার কিছু টাকাও উপার্জন করা যাবে। এই বাড়তি অর্থ উপার্জনের সম্ভাবনা কম্পানিগুলিকে পুনর্বাসন বা খনি-বর্জ্য পরিষ্কারের ক্ষেত্রেও বিনিয়োগ করতে রাজি করাতে পারে।

বর্তমানে ইলেকট্রনিকস শিল্পের জন্য খনি থেকে নিকেল সংগ্রহের বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতিতে কয়লা বা ডিজেল থেকে উৎপাদিত প্রচুর শক্তি ব্যয় হয়। এ ছাড়া প্রচুর পরিমাণে এসিডযুক্ত বর্জ্যও তৈরি হয় নিকেল খনি থেকে। একটি সাধারণ ধাতু বিগলন কারখানা দিতে প্রায় কোটি ডলার খরচ হয়। এবং সেসব কারখানায় যেসব নিকেল আকরিক আনা হয় সেগুলিতে নিকেল থাকে মাত্র ১.২%।

অন্যদিকে, ০.১ শতাংশ নিকেল রয়েছে এমন মাটি থেকেও নিকেল শুষে নিতে পারে এই গাছগুলি। যেগুলি থেকে ছয় মাস পর পরই নিকেল রস সংগ্রহ করা যায়। যেই রসে নিকেলের হার প্রায় ২৫%। এ ছাড়া নিকেল গাছ লাগানোর মাত্র ২০ বছর পরই সেই মাটিতে আর কোনো নিকেল খুঁজে পাওয়া যাবে না এবং মাটি আগের মতোই উর্বর হয়ে যাবে। ফলে সেই মাটিতে পুনরায় অন্যান্য সাধারণ সব ফসলও ফলানো যাবে।

ওদিকে আশঙ্কা জেগেছে, নিকেল চাষ এতটা উৎপাদনশীল এবং লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা হয়তো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন উজাড় করে এর চাষাবাদের দিকে ঝুঁকতে পারে। যেভাবে আরেক নগদ অর্থকরী ফসল পাম তেলের গাছ চাষ করে কৃষকরা বোর্নিওর আদি স্থানীয় বনাঞ্চল ধ্বংস করে দিয়েছে।

তবে গবেষকরা বলছেন, এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কেননা সর্বাধিক ফাইটোমাইনিং সম্ভাব্য অঞ্চলগুলিতে প্রচুর ঘাস থাকে এবং খনিজ চাষাবাদের জন্য নির্বাচিত জমিতে আরও কিছু গাছও জন্মায়।

ড. বেকার বলেন, “আমরা এই গাছ এমন জমিতেও চাষাবাদ করতে পারি যেখানে ইতোমধ্যেই বন উজাড় হয়ে গেছে। এই গাছের চাষাবাদ প্রাকৃতিক বনাঞ্চল কেড়ে নেওয়ার বদলে বরং ফিরিয়েই দেবে।“