২০১৬ সালে মার্কিন সোলার ইন্ডাস্ট্রি অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে ১৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অবদান রেখেছিল। যখন এই ধরনের গুরুতর পরিমাণে নগদ টাকা একটা শিল্পে খরচ হতে শুরু করে, ধরে নিতে পারেন যে নতুন কোনো উদ্ভাবন ঘটবার আর বেশি দেরি নাই।

আর ‘সোলার পেইন্ট’-এর চেয়ে বেশি উদ্ভাবনী আর কী হতে পারে? এটা এমন একটা পেইন্ট যা বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারে, আবার সাধারণ পেইন্ট হিসাবেও কাজ করে। এছাড়াও এটা কেবল বাড়ির ছাদ নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ ভবনকে সৌর-উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত করার ক্ষমতা রাখে।

যদি এটা নতুনত্বের দাবিদার না হয়, তাহলে উদ্ভাবন কী সেটাই আমরা জানি না। এতদিন পর্যন্ত, সৌরশিল্পের মূল উপাদান হিসেবে কাজ করেছে চিরাচরিত ফোটোভোলটাইক সোলার প্যানেল। সোলার প্যানেল একটা আদর্শ এবং প্রমাণিত প্রযুক্তি যা বাড়ির মালিকদের ব্যাপক পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করে। যাই হোক, ছাদ প্যানেল স্থাপনের ঝামেলা এবং ব্যয় বিবেচনা করে অনেকেই সৌরশক্তি ব্যবহার করতে আগ্রহী হন না।

এখন এমন একটা বিশ্বের কথা কল্পনা করুন যেখানে আমরা কেবল আমাদের ছাদ ও দেয়ালে এমন এক ধরনের পেইন্ট দিতে পারি যা বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। যদিও আমরা এখনও এই প্রযুক্তি বাস্তবায়ন থেকে অনেক দূরে, তবুও এটা সম্পর্কে ভাবতে বেশ রোমাঞ্চ হয়।

তো, সোলার পেইন্ট আসলে কী? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে এটা একটা একক পণ্য নয়; বর্তমানে তিনটা ভিন্ন প্রযুক্তি রয়েছে যাদেরকে ‘সোলার পেইন্ট’ বলা হয়।

তিন ধরনের সোলার পেইন্ট

বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পেইন্টের মতো পদার্থ ব্যবহারের ধারণা বহু বছর ধরে বৈজ্ঞানিক মহলে আলোচিত হয়েছে। তবে, সাম্প্রতিক সময়েই বাস্তব জগতে এটি ব্যবহারের সম্ভাবনা তৈরি হলো।

৩টি পৃথক উদ্ভাবন রয়েছে যেগুলিকে সোলার পেইন্ট হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। এখানে আমরা অনুসন্ধান করব এগুলি কী এবং সৌরশক্তির ভবিষ্যতের জন্যে এদের গুরুত্ব কতটুকু।

১. সোলার পেইন্ট হাইড্রোজেন

সোলার পেইন্ট: নবায়নযোগ্য শক্তির নতুন ধাপ
আরএমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দলের অধ্যাপকরা যারা হাইড্রোজেন-এক্সট্রাক্টিং সোলার পেইন্ট তৈরি করেছেন।

রয়েল মেলবোর্ন ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি’র (RMIT) গবেষকদের একটি দল সোলার পেইন্ট তৈরি করেছে যা জলীয় বাষ্প থেকে শক্তি উৎপন্ন করে।

সোজা কথায়, রঙটি বায়ু থেকে আর্দ্রতা শোষণ করে এবং সৌরশক্তি ব্যবহার করে জলের অণুগুলিকে হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনে ভেঙে ফেলে। এই হাইড্রোজেন তখন বিশুদ্ধ শক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

রঙটি আসলে এইভাবে কাজ করে: এতে  সিন্থেটিক মলিবডেনাম-সালফাইড নামক একটি নতুন সৃষ্ট পদার্থ রয়েছে। বাতাস থেকে আর্দ্রতা শোষণ করার মাধ্যমে এটি সিলিকা জেলের মতোই কাজ করে, যা কনজ্যুমার প্রোডাক্টকে শুষ্ক রাখার জন্যে ব্যবহার করা হয়।

এই সোলার পেইন্টে টাইটানিয়াম অক্সাইডও রয়েছে, যা প্রচলিত পেইন্টে ব্যবহৃত একটা পদার্থ। টাইটানিয়াম অক্সাইড রঙকে সাহায্য করে সৌরশক্তি ব্যবহার শোষিত আর্দ্রতাকে হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন কণায় ভেঙে ফেলতে। হাইড্রোজেন তখন বিশুদ্ধ শক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

আরএমআইটি’র প্রধান গবেষক ড. টোর্বেন ডায়েনেক বলেন, “আমাদের নতুন আবিষ্কারটির নানাবিধ সুবিধা রয়েছে। সিস্টেমকে চালনা করার জন্যে পরিষ্কার বা ফিল্টার করা পানির প্রয়োজন নেই। এটি বাতাসে জলীয় বাষ্প আছে এমন যেকোনো জায়গা, এমনকি জলাশয় থেকে দূরে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও জ্বালানি তৈরি করতে পারে।”

এই প্রযুক্তিকে যা বিশেষ করে তোলে তা হ’ল এই যে এটি হাইড্রোজেন তৈরি করে যা জ্বালানী এবং শক্তি সঞ্চয়ের একটি বিশুদ্ধ উৎস। যদি তারা বাণিজ্যিকভাবে এই সোলার পেইন্ট ব্যবহারের জন্যে প্রস্তুতি নিতে পারেন,  তাহলে এই হাইড্রোজেন-সংগ্রাহক সোলার পেইন্ট হতে পারে পরিবেশ বান্ধব উপায়ে শক্তি উৎপাদনের জন্যে হাইড্রোজেন সংগ্রহের সাশ্রয়ী একটা পদ্ধতি।

২. কোয়ান্টাম ডট সৌর কোষ বা ফোটোভোলটাইক পেইন্ট

সোলার পেইন্ট: নবায়নযোগ্য শক্তির নতুন ধাপ
যে বিজ্ঞানীরা এনআরইএলকে সাহায্য করেছেন কোয়ান্টাম ডট সোলার সেলের নতুন দক্ষতা রেকর্ড ১৩.৪% স্থাপন করার জন্যে।

কোয়ান্টাম বিন্দু, যা ফোটোভোলটাইক পেইন্ট নামেও পরিচিত, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি করা হয়েছিল। এগুলি ন্যানোস্কেল সেমিকন্ডাক্টর যা আলো ধারণ করতে এবং এটিকে বৈদ্যুতিক স্রোতে পরিণত করতে পারে।

এর পূর্ণাঙ্গ নাম হল ‘কোলয়েডাল কোয়ান্টাম ডট ফটোভোলটাইকস’। এগুলির উৎপাদন কেবল সস্তাই নয়, বরং প্রচলিত সৌর কোষের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি কার্যকর।

গবেষণাপত্রের লেখক সুসানা থনের মতে, “কোলয়েডাল কোয়ান্টাম ডটের দুটি সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, এগুলি অনেক সস্তা, তাই তারা প্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কমায়। কিন্তু এর প্রধান সুবিধা হল কোয়ান্টাম বিন্দুর আকার পরিবর্তন করে, আপনি এর আলো-শোষণকারী বর্ণালী পরিবর্তন করতে পারেন।

এই বিন্দুগুলি প্রথাগত সৌর প্যানেলের চেয়ে ১১ শতাংশ বেশি কার্যকরী হতে পারে। তত্ত্বীয়ভাবে, ভবিষ্যতে কোনো এক সময়ে, আমরা সূর্যের আলোকে বিদ্যুতে রূপান্তর করার জন্য আমাদের ছাদ এবং অন্যান্য স্থানে এই কোয়ান্টাম বিন্দুগুলি ব্যবহার করতে পারব।

৩. পেরোভস্কাইট সোলার পেইন্ট

এমআরইএল – এর বিজ্ঞানী ডেভিড মুর কাচের উপর একটি পেরোভস্কাইট দ্রবণ পেইন্ট করছেন

পেরোভস্কাইট এই ধরনের সোলার পেইন্টকে সম্ভব করে তোলে। এগুলি স্প্রে-অন সোলার সেল হিসেবেও পরিচিত।

রাশিয়ান খনিজবিদ লেভ পেরোভস্কির নামানুসারে এই পদার্থটির নামকরণ করা হয়েছে। পেরোভস্কাইট উপাদান ক্যালসিয়াম টাইটানিয়াম অক্সাইড খনিজ থেকে উদ্ভূত। পেরোভস্কাইটের কাঠামো ১৮৩৯ সালে প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল, কিন্তু মাত্র বছর দশেক আগে জাপানের একটি গবেষক দল সৌর কোষ উৎপাদনের জন্য পেরোভস্কাইটের প্রথম প্রয়োগ করে।

যা পেরোভস্কাইট সৌর কোষকে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় করে তোলে তা হল যে এগুলি তরল আকার ধারণ করতে পারে, যার ফলে এগুলি সৌর পেইন্টের জন্য আদর্শ উপাদান।

প্রকৃতপক্ষে, গবেষকরা তরল পেরোভস্কাইট কোষগুলি পৃষ্ঠতলে স্প্রে করার একটি উপায় তৈরি করেছেন, যা স্প্রে-অন সোলার সেল নামে পরিচিত। ২০১৪ সালে শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম স্প্রে-অন সোলার সেল তৈরি করা হয়েছিল। একটি পেরোভস্কাইট-ভিত্তিক মিশ্রণ একটি পৃষ্ঠের উপর স্প্রে করে সৌরশক্তি-নিয়ণত্রক স্তর তৈরি করা হয়েছিল।

সোলার পেইন্টের ভবিষ্যৎ

ভবিষ্যতে সোলার পেইন্ট ব্যবহৃত হতে পারে এমন তিনটি ক্ষেত্র হল :

ইতিমধ্যে বিদ্যমান সোলার সেটআপগুলিতে সোলার পেইন্ট যুক্ত করা। সোলার পেইন্ট বিদ্যমান সোলার সেটআপগুলিকে উন্নত করার একটি দুর্দান্ত উপায় হিসাবে কাজ করতে পারে। যাদের বাসাবাড়িতে ইতিমধ্যে সোলার প্যানেলের সংযোগ আছে তারা সোলার পেইন্ট দিয়ে তাদের ছাদ এবং দেয়াল রঙ করার মাধ্যমে অতিরিক্ত শক্তির উৎস তৈরি করতে পারেন।
সোলার পেইন্টেড যানবাহন। কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসার মাধ্যমে সোলার পেইন্ট যানবাহনে সৌর উৎপাদন ক্ষমতা যোগ করার একটি দুর্দান্ত উপায় হতে পারে।

সোলার পেইন্ট: নবায়নযোগ্য শক্তির নতুন ধাপ
একজন ব্যক্তি ভবিষ্যতের দেয়াল বা সোলার ইনস্টলার আঁকছেন?

একটি স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সোলার সেটআপ। যেহেতু সোলার পেইন্টের রয়েছে বর্ধিত দক্ষতার মাত্রা এবং এটির উৎপাদন খরচ অনেক কম, তাই উচ্চমানের সোলার পেইন্ট একদিন বাড়ি এবং ব্যবসার জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে।

সোলার পেইন্ট প্রসঙ্গে শেষ কথা

এখানে আলোচিত সোলার পেইন্ট প্রযুক্তির নবায়নযোগ্য জ্বালানি শিল্পে পরিপূর্ণ বিপ্লব ঘটানোর ক্ষমতা রয়েছে।

যেকোনো ধরনের সোলার পেইন্ট সারা বিশ্বে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে সর্বব্যাপী করে তুলতে পারে, কারণ সব ধরণের ছাদেই সোলার পেইন্ট প্রয়োগ করা যায়।

আরো পড়ুন: চীনা বিজ্ঞানীদের যুগান্তকারী আবিষ্কার: কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে শ্বেতসার

তবে, এটি শুধুমাত্র ভবিষ্যতেই সম্ভব, কারণ আমরা এখনও সোলার পেইন্ট প্রযুক্তির বাণিজ্যিক প্রয়োগ থেকে বহু বছর পিছিয়ে রয়েছি।

ততদিন পর্যন্ত, যদি আপনি বিদ্যুৎ বিলের খরচ কমিয়ে কিছু টাকা সঞ্চয় করতে চান, এবং নিজস্ব উপায়ে বিশুদ্ধ শক্তি উৎপাদনে আগ্রহী হন, তাহলে ছাদে থাকা সৌর প্যানেলগুলি নিঃসন্দেহে একটি ভাল উপায়।