বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের নাগরিকদের অনলাইন কার্যকলাপের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করে। এর জন্য তারা গঠন করেছে ফাইভ আইস (The Five Eyes বা FVEY), নাইন আইস (Nine Eyes) এবং ফোরটিন আইস (Fourteen Eyes) নামের তিনটি জোট।

এই তিন জোটের সদস্য দেশগুলি নিজেদের মধ্যে ব্যক্তিগত তথ্য আদান-প্রদান করে থাকে। তাদের দাবি, তারা জনগণের বৃহত্তর স্বার্থেই এমনটি করছে। কিন্তু দেশের নাগরিকদের ওপর এধরনের জোটের প্রভাব কী?

ফাইভ আইস, নাইন আইস ও ফোরটিন আইস আসলে কী?
ফাইভ আইস, নাইন আইস এবং ফোরটিন আইস নামের জোটগুলি হল নির্দিষ্ট কিছু দেশের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের এক ধরনের চুক্তি। এই দেশগুলি জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে এবং সকল তথ্য সদস্যরা নিজেদের মধ্যে শেয়ার করে। প্রধানত এই উদ্দেশ্যেই তারা জোট গঠন করেছে।

ফাইভ আইস জোট যেভাবে বিশ্বব্যাপী নজরদারি চালায়

ফাইভ আইস জোট
ফাইভ আইস জোট, যা এফভিইওয়াই বা FVEY নামেও পরিচিত। এর সদস্য সংখ্যা সবচেয়ে কম হলেও এটি ৩টি জোটের মধ্যে প্রধান এবং সবথেকে পুরোনো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড এর সদস্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এটি গঠিত হয়েছিল।

এর গঠনের ধারণার উৎপত্তি হয়েছিল যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে। চুক্তির ভিত্তিতে ওপরে উল্লেখিত ৫টি দেশ একত্রিত হয়ে একে অপরের সাথে সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স বা SIGINT এর জন্য সহযোগিতা করতে সম্মত হয়।

নাইন আইস জোট
নাইন আইস জোটে ফাইভ আই-এর মূল ৫ সদস্যের পাশাপাশি ডেনমার্ক, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড এবং নরওয়ে যোগ দিয়েছে। এই দেশগুলি নিজেদের নজরদারি ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য একটি গোয়েন্দা তথ্য-শেয়ারিং ব্যবস্থার অংশ হতে জোটে প্রবেশ করেছে। নাইন আইস জোটের লক্ষ্য সন্ত্রাসবাদ ও অন্যান্য নিরাপত্তা হুমকি মোকাবেলা করা।

ফোরটিন আইস জোট
ফোরটিন আইস জোটে রয়েছে ১৪টি দেশ। নাইন আইস জোটের ৯টি দেশের সাথে আরও অতিরিক্ত ৫ দেশ এই জোটে একত্রিত হয়েছে: জার্মানি, বেলজিয়াম, ইতালি, স্পেন এবং সুইডেন। জোটটি ২০১০ সালে গঠিত হয়। সেসময় অংশগ্রহণকারী দেশগুলি নিজেদের গোয়েন্দা তথ্য পরস্পরের মধ্যে শেয়ারের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য একাধিক চুক্তি স্বাক্ষর করে।

ফাইভ আইস জোট যেভাবে বিশ্বব্যাপী নজরদারি চালায়
ফাইভ আইস, উইকিপিডিয়া

ফাইভ আইস, নাইন আইস এবং ফোরটিন আইস জোটের সদস্যরা পরস্পর গোয়েন্দা তথ্য শেয়ার করতে পারে। যা জাতীয় নিরাপত্তা বাড়াতে ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে সহায়তা করে।

যাই হোক, এই জোটগুলির বিরুদ্ধে গোপনীয়তা ও নাগরিক স্বাধীনতা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। সেই সাথে তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবের জন্য অনেকে জোটগুলির সমালোচনাও করছেন।

এসব দেশের সদস্য দেশগুলি আইএসপি ও অন্যান্য অনলাইন ট্র্যাকারের মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের অনলাইন কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে। ফোন ট্যাপিংয়ের মাধ্যমেও ডেটা সংগ্রহ করে।

২০১৩ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির (NSA) ফাঁস হওয়া নথী থেকে জানা গেছে, কীভাবে ফাইভ আইস জোট গোপন নজরদারি স্কিম পরিচালনা করছে, নাগরিকদের ওপর বেআইনিভাবে গুপ্তচরবৃত্তির প্রমাণও সেখানে পাওয়া গেছে।

জোটগুলির মধ্যকার পার্থক্য
ফাইভ আইস, নাইন আইস এবং ফোরটিন আইস জোটের মধ্যে প্রধান পার্থক্য অংশগ্রহণকারী দেশের সংখ্যায়। এছাড়া নজরদারি ও গোয়েন্দা তথ্য শেয়ার করে নেওয়ার ক্ষমতার দিক থেকেও এদের মধ্যে পার্থক্য আছে।

আগেই বলা হয়েছে, ফাইভ আইস জোট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে গঠিত হয়। স্নায়ুযুদ্ধের পর যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের গোপন কার্যকলাপে বাধা দিতে পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এর ফলে ব্যাপক নজরদারিভিত্তিক ডেটা শেয়ারিংয়ে একে অপরকে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়।

নিজেদেরকে ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের অংশ করে নেওয়ার উদ্দেশ্যে আরও ৪টি দেশ নাইন আইস জোটে যোগ দেয়।

এই ৪টি অতিরিক্ত দেশ (ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স এবং নরওয়ে) ফাইভ আইয়ের প্রধান দেশগুলির মত একই রিসোর্স ব্যবহার করতে পারে, তবে তাদের দ্বারা সংগৃহীত সকল ডেটায় অ্যাক্সেস করতে পারে না। নাইন আইস জোটের দেশগুলি এনএসএ বা জিসিএইচকিউ গোপন সংস্থাগুলির সাথেও তাদের তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে।

এরপর আরও ৫টি দেশ নাইন আইস জোটে যোগ দিয়ে ফোরটিন আইস তৈরি করে। ফোরটিন আইস জোটের কার্যক্রমে ফাইভ আইসের মত শক্তিশালী নয়। তাদেরকে জোটের সহযোগী হিসাবে দেখা যেতে পারে। তবে তারা যে গণ নজরদারি এবং গোয়েন্দা তথ্য শেয়ারের ক্ষেত্রে কম জড়িত এমন বলা যায় না।

জোটগুলির ভয়ঙ্কর দিক
এই গোয়েন্দা জোট ও গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিকগুলির একটা হল তারা প্রক্সির মাধ্যমে নিজস্ব লোকদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্যে নিজের দেশের নাগরিকদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করা বৈধ নাও হতে পারে, তবে যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে তারা আবার নিজের দেশের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি চালাতে পারে। যেহেতু উভয়েই ফাইভ আইস জোটে রয়েছে।

যুক্তরাজ্যে নিজের দেশের নাগরিকদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করা বৈধ নাও হতে পারে, তবে যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে তারা আবার নিজের দেশের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি চালাতে পারে।

ফাইভ আইস, নাইন আইস এবং ফোরটিন আইস জোটের মধ্যে বিশ্বের অধিকাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের অন্য দেশগুলিতে প্রতিনিয়ত অনলাইন স্বাক্ষরতা বাড়ছে। ফলে অন্য দেশগুলিরও ফোরটিন আইস জোটে যোগদানের চাহিদা বাড়ছে।

এ থেকে বিশ্বের সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে যে জরুরী প্রশ্ন উঠেছে তা হল, বিশ্ব কি তাহলে সর্বগ্রাসী নজরদারি জগতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে?

এখনও পর্যন্ত জানা যায়, নিচের দেশগুলিও ফোরটিন আইস গোয়েন্দা জোটের ঘনিষ্ঠ মিত্র:

  • ইজরায়েল
  • জাপান
  • দক্ষিণ কোরিয়া
  • সিঙ্গাপুর
  • ব্রিটিশ ওভারসিজ টেরিটরি

আপনার জন্যে এর অর্থ কী?
যদি উল্লিখিত এসব দেশের কোনো একটিতে আপনি বাস করেন, তাহলে আপনার অনলাইন স্বাধীনতা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার।

এসব দেশের নাগরিক হিসেবে আপনি অনলাইনে যা’ই করেন, তা ট্র্যাক করার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। আপনি কী কী ওয়েবসাইট দেখেন, অনলাইনে কত সময় ব্যয় করেন, সার্চ ইঞ্জিনে আপনি কী টাইপ করেন এসবের সাথে সাথে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য, আইপি ঠিকানা এবং এরকম আরও অনেক কিছুর ওপর এই জোটগুলির অ্যাক্সেস থাকছে৷

এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে যে ফাইভ আইস জোট অন্য জোটগুলিকে সঙ্গে নিয়ে সকল ধরনের প্রতারণামূলক নজরদারি স্কিম পরিচালনা করে থাকে। তারা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি করে। তারা যে কতটা গভীরভাবে নজরদারি করতে পারে তা ধারণা করা যাচ্ছে না!

ফাইভ আইস ইন্টেলিজেন্স যেসব তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলি তারা অনন্ত সময়ের জন্যে সংরক্ষণ করে রাখতে পারে। যেকোনো সময় এই তথ্য তারা ব্যবহার করতে পারবে। তবে সব থেকে খারাপ অবস্থা হবে যখন সার্চ হিস্ট্রির কারণে আপনি সরকারের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবেন।

ফাইভ আইস জোট এড়াতে যা করতে পারেন
অনলাইন কার্যকলাপ লুকিয়ে রাখার অনেক উপায় আছে। তবে একটি টুল বিশেষ করে ফাইভ আইস জোটের অন্যায্য নজরদারি মোকাবেলায় আপনাকে সাহায্য করতে পারে: ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক বা ভিপিএন। সমস্ত ফাইভ আইস দেশে ভিপিএন বৈধ।

অনেক ধরনের ভিপিএন সার্ভিস সহজেই অনলাইনে পাওয়া যায়।

ভিপিএন সার্ভিসগুলি পাবলিক আইএসপির মালিকানাধীন বাণিজ্যিক সার্ভারের পরিবর্তে তাদের নিজেদের এনক্রিপ্ট করা সার্ভারের মাধ্যমে ইউজারের ইন্টারনেট কার্যকলাপ লুকিয়ে রাখে। যদি কেউ ইউজারের ট্রাফিকের পাঠোদ্ধার করার চেষ্টা করে তবে তাদের কাছে ইউজারের ডেটা সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর মনে হবে।

সূত্র. জেন বাহার, নর্ড; অনুবাদ: জুবায়েদ দ্বীপ